কর বৃদ্ধি: সহজ পথেই হাঁটল সরকার, সাধারণ মানুষের ওপর চাপাল বাড়তি ১২,২৭০ কোটি টাকার বোঝা
বছরের পর বছর ধরে প্রগ্রোসিভ করের কথা বলে এলেও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এর শর্তানুযায়ী ১২ হাজার ২৭০ কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আদায় করতে গিয়ে রিগ্রেসিভ করের পথেই হাঁটল সরকার।
প্রগ্রেসিভ করব্যবস্থায় উচ্চ-আয়ের ব্যক্তিরা তুলনামূলকভাবে বেশি কর দেয়, যার ফলে ধনীরা আরও বেশি অবদান রাখায় আয় বৈষম্য কমে। অন্যদিকে রিগ্রেসিভ করব্যবস্থায় নিম্ন-আয়ের ব্যক্তিরা আনুপাতিক হারে ধনীদের তুলনায় আয়ের বেশিরভাগ অংশ কর দেওয়ায় তাদের ওপর অসামঞ্জস্যপূর্ণ চাপ বাড়ে।
সাধাণণভাবে যারা বেশি আয় করবেন, তারা বেশি কর দেবেন—বিশ্বব্যাপী এটাই স্বীকৃত। সারা বিশ্বে বিভিন্ন দেশের সরকারের রাজস্বের বড় অংশই আদায় হয় আয়করের মতো প্রত্যক্ষ কর থেকে। কিন্তু বাংলাদেশে এটি উল্টো। বাংলাদেশে এখনও পরোক্ষ কর থেকেই বেশি আদায় হয়। এই পরোক্ষ কর নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর বেশি প্রভাব ফেলছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাব অনুযাযী, চলতি অর্থবছরে ৪.৮০ লাথ কোটি টাকার রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৬৩ শতাংশই আদায় হবে পরোক্ষ কর, যেমন ভ্যাট, ও বিভিন্ন ধরনের আমদানি শুল্ক থেকে। প্রায় ১০ বছর আগে পরোক্ষ করের অংশ ছিল ৬৫ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইএমএফের চাওয়া অনুযায়ী বাড়তি ১২ হাজার ২৭০ কোটি টাকা আদায়ের পুরো চাপটাই দেওয়া হয়েছে পরোক্ষ করের ওপর, যা প্রগ্রেসিভ করব্যবস্থার মূলনীতির বিপরীত। পরোক্ষ করের মাধ্যমে এই বাড়তি টাকা আদায়ের ফলে পরোক্ষ করের অংশ আরও বাড়বে, অন্যদিকে আরও কোণঠাসা হয়ে পড়বে প্রগ্রেসিভ করব্যবস্থা।
কর ফাঁকি বন্ধ করার চেষ্টা না করে ঢালাওভাবে প্রায় ১০০ পণ্যের উপর ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে সরকার। এই চাপের বড় অংশই যাবে নিম্ন-আয়, সাধারণ ভোক্তাদের ওপর।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুইশড ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেছেন, 'এনবিআরের উচিত ছিল প্রত্যক্ষ কর বাড়ানো। কিন্তু ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোয় তা সাধারণ মানুষের ওপর ব্যয়ের চাপই বাড়াবে কেবল। এই সিদ্ধান্ত প্রগ্রেসিভ করের বদলে রিগ্রেসিভই হয়ে গেল।'
তিনি আরও বলেন, 'এমনিতেই আয় বৈষম্য বাড়ছে। আয়কর বাড়ানো এবং কর ফাঁকি বন্ধের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর চেষ্টা থাকা দরকার ছিল, তা দেখা যায়নি। গত তিন বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। এর মধ্যে কর বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের ওপর চাপ আরও বাড়িয়ে দেবে।'
যেভাবে বেড়েছে চাপ
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, , 'একসময় আমদানিতে প্রতি ডলারের মূল্য ছিল ৮৬ টাকা। এর ওপর ছিল ৭.৫ শতাংশ ভ্যাট। এখন ডলারের মূল্য ১২০ টাকা, এর ওপর দিতে হবে ১৫ শতাংশ ভ্যাট। তাহলে বুঝুন চাপ কেমন বেড়েছে।'
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ টিবিএসকে বলেন, 'উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে থাকা মানুষের ওপর এই সময়ে নতুন করে কর বাড়ানো ঠিক হয়নি। স্বল্প-আয়ের মানুষের খরচ আরও বাড়বে, ছোট পুঁজির ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ আরও বাড়াবে।'
তিনি আরও বলেন, 'অর্থবছরের মাঝে এসে এভাবে ঢালাওভাবে কর বাড়ানো মোটেই উচিত হয়নি।'
নিম্ন-আয়ের মানুষের ওপর কর বৃদ্ধির প্রভাব বেশি
মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট এখন সব শ্রেণির মানুষের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সেবা। ধনী, গরিব, শিক্ষার্থী—সবার জন্যই। মাত্র সাত মাসের ব্যবধানে এই খাতে কর বেড়েছে ৩ শতাংশ, যার জন্য বছরের বাকি ছয় মাসে ভোক্তাদের বাড়তি ৮০০ কোটি টাকা কর গুনতে হবে।
মাত্র সাত মাস আগে এই খাতে কর বাড়ানো হয়েছিল ৫ শতাংশ। একইভাবে তামাকের ওপর কর বাড়িয়ে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা বাড়তি আদায়ের লক্ষ্য নেওয়ার পর নতুন করে এ খাত থেকেই আরও ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।
এলপি গ্যাস, ওষুধ, বিভিন্ন ধরনের ফল, সাবান, ডিটারজেন্ট, প্লাস্টিকের টিফিন বক্স, প্লাস্টিক ও রাবাবরের হাওয়াই চপ্পল, বিস্কুট সাধারণ মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহার্য পণ্য। এগুলোর ওপর ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্কও বাড়ানো হয়েছে।
দোকানের যেকোন পোশাক আইটেম, কিংবা সাধারণ মানের একটি রেস্টুরেন্টেও ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে—যেখানে স্বল্প-আয়ের মানুষই মূল ক্রেতা।
বিমান ভ্রমণ শুনলে মনে হতে পারে ধনীদের বাহন। কিন্তু বিদেশে ভ্রমণ করা যাত্রীদের বড় অংশই শ্রমিক শ্রেণি; এখন তাদের খরচও বাড়ল।
দৈনিক গড়ে ১৩ হাজার ৯৬৮ টাকার বেশি এখন গলির সাধারণ দোকানেও বিক্রি হয়। এমন দোকানও এখন ১৫ শতাংশ ভ্যাটের আওতায় এল।
টয়লেট পেপার বিলাসদ্রব্য নয়, কিন্তু এর খরচও বাড়ছে।
তামাকজাত পণ্যের কর বাড়িয়ে সরকার বাড়তি ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা আদায় করতে চায়।
তামাকের বড় ভোক্তা নিম্ন-আয়ের মানুষও। অবশ্য এই কর বাড়ানো নিয়ে কোনো আপত্তি নেই। তবে এভাবে কর বাড়িয়ে তামাক সেবন কমছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এটি বরং স্বল্প-আয়ের তামাক সেবনকারীদের ব্যয় বাড়াবে।
বিভিন্ন পণ্য ও সেবার ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর ফলে ধনীদের পাশাপাশি কম আয়ের মানুষেরও ব্যয় বাড়বে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর কারণে নিম্ন-আয়ের মানুষের ওপর তেমন একটা প্রভাব পড়বে না।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে ভ্যাটের তুলনায় আদায়ে সবচেয়ে পিছিয়ে আয়কর আদায়। এ সময়ে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৩০ শতাংশ কম আয়কর আদায় হয়েছে। অথচ আয়কর আদায় বাড়ানোতে মনযোগ দেওয়া হয়নি।
এনবিআরের সাবেক আয়কর নীতি সদস্য ড. সৈয়দ মো. আমিনুল করিম টিবিএসকে বলেন, 'এনবিআর এখন যেভাবে পরোক্ষ কর বাড়াল, তাতে রাজস্বে প্রত্যক্ষ করের হার আরও কমে যাবে।'
বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ কর কম হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, 'এখানে পরোক্ষ কর আদায় করা সহজ। সে তুলনায় প্রত্যক্ষ কর আদায় কিছুটা কঠিন। সহজ পথে হাঁটতে গিয়ে এনবিআর প্রত্যক্ষ করেই মনোযোগ রাখে।'
তিনি আরও বলেন, 'এখানে ধনীদের ওপর কর বাড়ানো যেত। সম্পদ কর নির্ভর করে সম্পত্তির মূল্যের ওপর। কিন্তু এখানে সম্পত্তির ৫০ বছর আগে যা দাম ছিল, এখনও তা-ই দেখানো হয়। এছাড়া এখানে ব্যক্তি শ্রেণির করদাতাদের করহারও তুলনামূলক কম।'
তামাক, বিমান ভাড়া, মোবাইল টকটাইম, ইন্টারনেট থেকে বেশি আদায়ের লক্ষ্য
এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী, তামাকপণ্যে কর বাড়ানোর মাধ্যমে অর্থবছরের বাকি সময়ে বাড়তি আদায় হবে প্রায় ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
তামাকপণ্যসহ কার্বনেটেড, নন-কার্বনেটেড বেভারেজ, জুস, পেইন্ট থেকে মোট আদায় হবে ৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা।
বিমান ভাড়ায় ১ হাজার কোটি, মোবাইল ফোনের টকটাইম, ইন্টারনেট ব্যবহারে ৮০০ কোটি টাকা, হোটেল-রেস্তোরাঁয় ৩০০ কোটি টাকা; পোশাকপণ্য, নন-এসি হোটেল, মিষ্টান্ন ভান্ডার, প্রকিউরমেন্ট প্রোভাইডারের কাছ থেকে আদায় হবে ২ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা; এবং ট্রেডার, মেডিসিন ও এলপি গ্যাস থেকে ৫০০ কোটি টাকা আদায় হবে।
এছাড়া ভ্যাট হার ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ১৫ শতাংশে উন্নীত করায় ১৯ ধরনের আইটেম থেকে আসবে আরও প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। সব মিলয়ে প্রায় ১০০ ধরনের পন্য ও সেবা থেকে ১২ হাজার ২৭০ কোটি টাকা আদায় করতে চায় এনবিআর।