সর্বকালের সেরা ধনী মানসা মুসা: কেন তার হজ কাফেলা এখনও উদাহরণ
মানসা মুসার সাম্রাজ্যের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে এক বছর সময় লেগে যায়। খ্রিষ্টজন্মের অন্তত ১০ হাজার বছর আগে থেকেই পশ্চিম আফ্রিকার মালিতে জনবসতি। তখন সাহারা ছিল কর্ষণযোগ্য উর্বরভূমি এবং বন্য প্রাণীতে পূর্ণ। উত্তম জীবনযাপনের জন্য মালি অফ্রিকার গায়ে খাটা মানুষকে স্বাভাবিকভাবে আকর্ষণ করত। বলা হয়, ইসলাম ধর্মের মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রিয় মুয়াজ্জিন হাবসি যুবক বিলালের বংশধরদের একজন মালিতে আসেন এবং সে সময় ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন। পরবর্তীকালে মুসলমানরা এ অঞ্চলে শাসনও কায়েম করেন। একাদশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দীতে বেলাল-ইবন-রাবাহ বা বেলালের উত্তরসূরিরা সেখানে মুসলিম রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে মালিকে সাম্রাজের রূপ প্রদান করেন বলে ঐতিহাসিকেরা মনে করেন। উত্তর আফ্রিকার আরব ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন, মরক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতা, ষোড়শ শতাব্দীর ভ্রমণকারী লিও আফ্রিকানাস প্রমুখ এ সাম্রাজ্যের কিছু বিবরণ লিখে গেছেন।
একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মৌখিক কাহিনির মাধ্যমে টিকে গেছে। সাম্রাজ্যের ভৌগোলিক বিবরণ দিয়েছেন আল-ইদ্রিসি। বিলালের পরবর্তী বংশধরদের সৃষ্টি কিইতা রাজবংশ। এ বংশের নবম সম্রাট মানসা মুসার খ্যাতি সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তরকালে যখন ব্যক্তিগত সম্পদের মূল্যায়নের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। বিশেষ করে কয়েক দশক ধরে ফোর্বস ম্যাগাজিন শ্রেষ্ঠ ধনীদের তালিকা প্রকাশ করতে শুরু করে। বিভিন্ন সময় ইলন মাস্ক, বিল গেটস, বার্নার্ড আরনো, কার্লোস স্লিম, জেফ বেজোস ও অন্য অনেকের নাম একালের শীর্ষ ধনীর তালিকায় উঠে আসে। কিন্তু যখন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট ধনীর নাম উচ্চারণ করতে হয়, তখন সকলকে ডিঙিয়ে চলে আসে মানসা মুসার নাম।
লক্ষণীয়, মুসা রাজপুত্র ছিলেন না, এমনকি রাজদৌহিত্রও নন। তবে তিনি রাজপরিবারেরই সদস্য; অভ্যুত্থান ঘটিয়ে বা ষড়যন্ত্র করে পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতাসীন হননি। কিন্তু তিনি কেমন করে ক্ষমতা পেলেন এবং মানসা (রাজা, সম্রাট) হলেন, সে কাহিনি শুনিয়েছেন মিসরের গভর্নরকে।
হজব্রত পালনের উদ্দেশ্যে মক্কার পথে তিনি ১৩২৪ সালে প্রায় তিন মাস কায়রোতে অবস্থান করেন। তিনি যে জেলায় সাময়িক নিবাস স্থাপন করেছিলেন, সেখানকার গভর্নর আবু আল-হাসান আলী ইবনে আমির হাজিবের সঙ্গে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হন। মুসা তাকে মালির ক্ষমতারোহণের যে কাহিনি শুনিয়েছিলেন, ইবনে আমির হাজিব মুসার বয়ানে সেই বর্ণনা দিয়েছেন:
আমরা এমন একটি পরিবারের সদস্য, যেখানে রাজত্ব উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্য। আমার আগে যিনি রাজা ছিলেন (দ্বিতীয় আবু বকর), তিনি এটা বিশ্বাস করতেন না যে আটলান্টিক মহাসাগরের দূরতম প্রান্ত আবিষ্কার করা অসম্ভব। সুতরাং, তিনি ২০০ জাহাজভর্তি মানুষ প্রচুর সোনাদানা, খাবার ও পানি দিয়ে তাদের যাত্রা করতে নির্দেশ দিলেন। যতক্ষণ না তোমরা শেষ প্রান্তে পৌঁছাতে পারছ এবং তোমাদের পানি শেষ হয়ে এসেছে, তার আগে তোমরা ফিরতে পারবে না। কয়েক বছর চলার মতো খাবার ও পানীয় দেওয়া হয়েছিল। বহু সময় অতিবাহিত হলেও কারও ফেরার নাম নেই। কেবল একটি জাহাজ ফিরে এলে জাহাজের ক্যাপ্টেন আবু বকরকে বললেন, 'হে সুলতান, বহুদিন জাহাজ চালানোর পর আমাদের জাহাজগুলো যখন এক এক করে খোলা সমুদ্রে পড়ল, তীব্র স্রোতে তারা যেখানে গিয়ে পৌঁছাল, সেখান থেকে আর ফিরতে পারল না, তাদের কী হয়েছে, আমার জানা নেই। আমি ছিলাম সবার শেষে, খোলা সমুদ্রে পড়ার আগেই আমি জাহাজ ঘুরিয়ে ফেরার পথ ধরি।'
কিন্তু সুলতান তার কোনো কথা বিশ্বাস করলেন না। তারপর তিনি নিজেই দুই হাজার জাহাজ নিয়ে রওনা হলেন। এক হাজার জাহাজ অভিযাত্রীর জন্য আর এক হাজার খাবার ও পানীয়র জন্য। যাওয়ার সময় তিনি আমাকে তার পক্ষে শাসন করার দায়িত্ব দিয়ে আটলান্টিকে জাহাজ ভাসালেন। তার সঙ্গে আমার সেটাই শেষ দেখা। কাজেই আমি আমার নিজের অধিকারবলেই রাজা হয়েছি।
এ কথোপকথন রেকর্ড করেছেন ঐতিহাসিক আল ওমারি। মুসার ও দ্বিতীয় আবু বকরের দাদা আপন দুই ভাই, তবে আবু বকরের দাদা রাজা হয়েছিলেন, তার বাবাও।
এ বর্ণনা নিয়ে কিংবা বর্ণনাটি আরবি থেকে সঠিকভাবে অনূদিত হয়েছে কি না — এ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। ভিন্ন মতাবলম্বীরা বলছেন, মানসা মুসার পূর্বসূরি মুহাম্মদ ইবনে কু। সুতরাং, আটলান্টিকের সফরটি তারই হওয়ার কথা। আর দুই হাজার জাহাজ এবং তাদের হারিয়ে যাওয়াও প্রশ্নের উদ্রেক করে। তবে নতুন পৃথিবীর খোঁজে কলম্বাসের অভিযানের আগেই মালির সুলতানের এ ব্যর্থ অভিযাত্রা হয়েছিল।
মুসা ক্ষমতা গ্রহণ করলেন ১৩১২ সালে। চতুর্দশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ইউরোপ যখন বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছে, সে সময় আফ্রিকার কোনো কোনো রাজত্ব সমৃদ্ধির দিকে এগোচ্ছে: পশ্চিম আফ্রিকার মালির সমৃদ্ধি লক্ষণীয়। মানসা মুসা দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করলেন আর একটার পর একটা সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে তার রাষ্ট্র সীমানা বৃদ্ধি করলেন। একসময় তার সাম্রাজ্যে দৈর্ঘ্যে দুই হাজার মাইল ছাড়িয়ে যায়। তার সময়ের মালি সাম্রাজ্যে আজকের মৌরিতানিয়া, সেনেগাল, গাম্বিয়া, গিনি, বারকিনা ফাসো, মালি, নাইজার, নাইজেরিয়া ও চাদ অন্তর্ভুক্ত ছিল।
১৩২৪ সালে চার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে যখন ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি হজ পালন করতে বেরোলেন, তখনই কেবল দূরদূরান্তের মানুষ জানতে পারে, মালি কতটা সমৃদ্ধ রাষ্ট্র এবং মানসা মুসা কত বিত্তশালী ও কেমন অবিশ্বাস্য এক দানবীর। ডেভিড শানজ তার মক্কা গমন ও প্রত্যাবর্তন নিয়ে লিখেছেন 'দ্য লায়ন অব মালি: দ্য হজ অব মানসা মুসা'।
২৫ বছর রাজত্ব করার পর ১৩৩৭ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং তার পুত্র প্রথম মাঘান সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হন।
ঐতিহাসিকেরা তাকে বিভিন্ন বিশেষণে চিত্রিত করেছেন। ইউরোপের ঐতিহাসিকদের কাছে তিনি 'মুসা দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট'। তাকে ন্যায়বিচারক ড্যানিয়েলও বলা হয়েছে। আমেরিকার কাছে অজানা এ দেশটির শাসক মুসা সম্পর্কে একালের মালির একজন সম্ভ্রান্ত নাগরিক বলেছেন, আমাদের মানসা মুসা তোমাদের আব্রাহাম লিঙ্কনের চেয়ে কম কিছু নন।
১৩০০ সালের আগেও মালিতে মুসলমানরা সংখ্যালঘু ছিল, মালি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সুনজিতা কিতা নিজে মুসলমান ছিলেন না, কিন্তু মানসা মুসা একই সঙ্গে শাসক ও ধর্ম প্রচারকের কাজ করেছেন। সুশাসন ও সম্রাট হিসেবে তার সাফল্য মানুষকে এতটাই প্রভাবিত করেছে যে ধর্মাচরণের মাপকাঠিতে এখন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুসলিম দেশ বলা হয় মালি, বর্তমানে প্রায় ৯৫ ভাগ নাগরিকই মুসলমান: তাদের মধ্যে দশমিক ৮ ভাগ কেবল শিয়া আর সবাই সুন্নি। অনস্বীকার্য — মানসা মুসার উদ্যোগই মালিকে মুসলমান-অধ্যুষিত একটি সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করেছে।
১৩২৪ সালে মানসা মুসার মক্কা গমনের কাহিনি ইসলামি দেশগুলোতে এবং মধ্যযুগীয় ইউরোপের দূরবর্তী প্রান্তে আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। পশ্চিম আফ্রিকা থেকে পূর্ব দিকে মক্কার উদ্দেশে যখন তিনি যাত্রা করেন, তার সফরসঙ্গী ৬০ হাজার সভাষদ ও পরিচারক প্রত্যেকে চোখ ঝলসানো দামি পোশাক পরিহিত। ৮০টি উটের প্রতিটির ওপর ৩০০ পাউন্ড ওজনের স্বর্ণের বোঝা। প্রতি শুক্রবার যেখানে তার কাফেলা থামত, সেখানেই একটি মসজিদ নির্মাণে যাবতীয় আয়োজন তিনি করেছেন। তিনি যে পথে গিয়েছেন, তার উদারতার দান সবাই পেয়েছেন। যাত্রাপথের স্মৃতি সবচেয়ে বেশি ধারণ করে আছে কায়রো। তার দান ও ব্যয় দুই-ই তুলনাহীন বিষয়। ১৬ শতকের মিসরীয় পণ্ডিত ইবনে-আল-আইয়াস বলেছেন, ১৩২৪ সালে হজযাত্রাপথে মানসা মুসার কায়রো ভ্রমণ সমগ্র মিসরের জন্য সবচেয়ে স্মরণীয় ও ঘটনাবহুল অধ্যায়। তার আগেও পশ্চিম আফ্রিকার কোনো কোনো দেশের মুসলমান শাসক কায়রো অতিক্রম করে মক্কা গমন করেছেন, কিন্তু এত বিপুল ব্যয় ও আড়ম্বর কেউ করেননি, তাদের সেই সামর্থ্যও ছিল না। কায়রোর যে দরিদ্রজন তার বহরের কাছাকাছি আসতে পেরেছে, ভাগ্য বদলে গেছে তারই। তিনি এত বেশি পরিমাণ স্বর্ণ দান করেছেন যে এতে আকস্মিকভাবে কায়রোতে মুদ্রা ও স্বর্ণের চালান এত বেশি বেড়ে যায় যে অল্প দিনের মধ্যে সেখানে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়, দ্রব্যমূল্য হু হু করে বেড়ে যায়। কায়রোর বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। ফলে মানসা মুসার সফরের সুফল যারা ভোগ করেননি, সেই দরিদ্ররা তার অজ্ঞাতে তারই কারণে আরও দরিদ্র হয়ে ওঠে। মুসার এ সফরের ফলে সৃষ্ট মুদ্রাস্ফীতি কাটিয়ে উঠতে মিসরের এক দশকের বেশি সময় লেগে যায়। পৃথিবীর অর্থনৈতিক ইতিহাসে কোনো একজন ব্যক্তির সৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যয় আর্থিক বাজারে ও পণ্যবাজারে এমন দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারেনি।
মানসা মুসা মক্কা নগরীতে হজ পালন করেন। পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হলেও ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী সাধারণ মানুষের কাতারে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করেন।
মানসা মুসার কাল, কীর্তি ও ব্যক্তিজীবন আলোচনায় অনেক ঐতিহাসিক বিষয় উঠে আসে:
* ইউরোপ যখন দুর্ভিক্ষপীড়িত, গণযুদ্ধে জর্জরিত, সে সময় তুলনামূলকভাবে অনেক কম শিক্ষিত, অনাধুনিক (ইউরোপীয় বিচারে) একটি আফ্রিকার দেশকে তিনি স্থিতিশীল রেখে ব্যবসা-বাণিজ্য সমৃদ্ধির দিকে পরিচালিত করতে পেরেছেন।
* হত্যা করে ক্ষমতারোহণ যেমন মধ্যযুগের আরব ও আফ্রিকার মুসলমান রাজত্বে একটি গ্রহণীয় ধারা হয়ে উঠেছে, সেখানে মানসা মুসা বিনা রক্তপাতে ক্ষমতারোহণ করেছেন; রাজ্য জয় করেছেন অনেকটা বিনা বাধায়, নিষ্ঠুরতার কোনো অভিযোগ তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত হয়নি। নিরুদ্দিষ্ট রাজা দ্বিতীয় আবু বকরই তাকে ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন। যেখানে মানসা মুসার পূর্বপুরুষ হাবসি ক্রীতদাস, হজরত বেলাল দাসত্বমুক্ত হয়েছিলেন, সেখানে তার আমলে জমজমাট দাস ব্যবসা একালের বিচারে অবশ্যই গ্রহণযোগ্য নয়। তার ব্যক্তিগত অধিকারে ১২ হাজার দাস ছিল। তিনি যখন মক্কা গমন করেন, তার সামনে ছিল ৫০০ শোভন পোশাক পরিহিত ক্রীতদাস, তাদের হাতে স্বর্ণও ছিল। মুসার দাসরা উত্তম জীবন যাপন করলেও মালির বন্দর থেকে বিক্রীত দাসদের দুর্বিষহ জীবন সম্ভবত তিনি বিবেচনায় আনেননি।
* পৃথিবীর সামরিক ইতিহাস মানসা মুসাকে অসাধারণ একজন সামরিক নেতা ও সমরকৌশলী বিবেচনা করে। তিনি তার সাম্রাজ্যকে তিন গুণেরও বেশি বড় করতে সমর্থ হন। তিনি অত্যন্ত আধুনিক ও প্রশিক্ষিত একটি সেনাবাহিনী তৈরি করেন। ১০ হাজার অশ্বারোহী সৈন্যসহ তার বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল এক লাখ। অবশ্য এটা অনস্বীকার্য—মুসা একটি সুশৃঙ্খল ও প্রশিক্ষিত বাহিনী উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছিলেন। তার পূর্ববর্তী দুজন সম্রাট মানসা সাকুরা ও মানসা চতুর্থ মাহমুদ নিজেরাই সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছেন। ইবনে বতুতা সৈন্যদের কৌশলের প্রশংসা করেছেন। মানসা মুসা ক্ষমতাসীন হয়ে মালি সাম্রাজ্যের মর্যাদা বাড়িয়ে দেন, ১৩২৫ সালের একটি বিদ্রোহ জেনারেল সামান্দিরের মাধ্যমে প্রশমন করেন। তার সাম্রাজ্যে আয়তন দাঁড়ায় ১ দশমিক ২৯ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার।
* মানসা মুসার সাম্রাজ্য এতটাই বিস্তৃত হয়েছিল যে লোকমুখে প্রচলিত ছিল তার সাম্রাজ্যের যেকোনো এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছাতে এক বছর লেগে যায়। এ বর্ণনায় খুব বেশি অতিরঞ্জন আছে বলে মনে হয় না। চতুর্দশ শতাব্দীতে ইবনে বতুতা লিখেছেন, মালি সাম্রাজ্যের উত্তরের একটি সীমান্ত থেকে দক্ষিণাঞ্চলে রাজধানী শহর নিরানি পৌঁছাতে চার মাস সময় লেগেছে। তার শাসনামলে ২০টি শহর মালি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।
* তার জেনারেল সামান্দিরা সোংঘাইয়ের রাজধানী শহর 'গাও' দখল করার সংবাদ পেয়ে মানসা মুসা নিজের রাজধানী নিরানি না গিয়ে গাও চলে আসেন এবং বিনয়ের সঙ্গে পরাজিত রাজার আত্মসমর্পণ গ্রহণ করেন। বিজয়ীরা যাতে কোনো লুটতরাজ ও অনাচার না করে, তা নিশ্চিত করেন। পরাজিত রাজা ভবিষ্যতে যাতে ষড়যন্ত্র ও বিদ্রোহ করতে না পারে, সে জন্য জিম্মাদার হিসেবে রাজার দুই পুত্রকে তার সঙ্গে নিয়ে আসেন। তাদের সঙ্গে বরাবরই রাজপুত্রের প্রাপ্য আচরণ করা হয়।
* পৃথিবীর অর্ধেক যখন আর্থিক বিপর্যয়ে মানসা মুসার রাজত্বে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি স্বর্ণ উৎপাদন হতো। তা ছাড়া লবণ উৎপাদনের খ্যাতি আগে থেকেই ছিল। তার সঙ্গে যোগ হয় দাস ব্যবসার কমিশন। সব মিলিয়ে সে সময় মালির মতো আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যে কোনো দেশই ছিল না। মালির সমৃদ্ধিতে তার ব্যক্তিগত বাণিজ্যেও জোয়ার আসে। তিনিও বিপুল সম্পদের মালিক হন। বিশ শতকের শেষে তার সম্পদের অর্থমূল্য ধরা হয়েছে ৪০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২৩ সালের হিসাবে বর্তমান বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পাঁচজন ধনী ব্যক্তি:
বার্নার্ড আর্ননো: ২১৫ বিলিয়ন ডলার
জেফ বেজোস: ২০১ বিলিয়ন ডলার
ইলন মাস্ক: ১৯১ বিলিয়ন ডলার
মার্ক জাকারবার্গ: ১৫৬ বিলিয়ন ডলার
বিল গেটস: ১৪৮ বিলিয়ন ডলার
[সূত্র: ইনভেস্টোপেডিয়া ২ মে ২০২৪]
তবে সব মিলিয়ে ৮০০ বছর ধরেই শীর্ষ স্থানে রয়েছেন মালির কৃষ্ণবর্ণ মুসলমান রাজা মানসা মুসা।
* মধ্যযুগের পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানচিত্র 'ক্যাটালান ম্যাপ'-এ সাব-সাহারা আফ্রিকা অংশে মানসা মুসাকে অঙ্কন করা হয়েছে, সিংহাসনে বসে আছেন, মাথায় স্বর্ণের মুকুট, হাতে স্বর্ণের ভূগোলক, বৈভবের প্রতীক। সে যুগে তার সম্পদের বিবরণ রূপকথার মতো সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল।
* মানসা মুসার অন্যতম কৃতিত্ব দখলে আনা রাষ্ট্র ও শহরের উন্নয়ন। এ কারণেই সাধারণ মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়নি। টিম্বাকটু দখলে আনার পর শহরটি তিনি রাজধানীর মর্যাদায় ভূষিত করেন। আফ্রিকা ও আরবের উচ্চশিক্ষার সর্বোচ্চ জ্ঞানকেন্দ্রে পরিণত করেন। তার প্রতিষ্ঠিত টিম্বাকটু মসজিদসংলগ্ন লাইব্রেরিতে ১০ লাখের অধিক পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। ফলে শহরটি বিদ্বান ও গবেষকদের প্রধান আকর্ষণ হয়ে ওঠে। শহরটি ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়। ভেনিস, গ্রানাডা, জেনোয়ার সঙ্গে নিয়মিত বাণিজ্য শুরু হয়। মুসার রাজপ্রাসাদ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও তার সৃষ্ট মসজিদ ও বিশ্ববিদ্যালয় এখনো বিরাজ করছে। সেকালে তার ধর্মীয় মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ২৫ হাজার।
* তিনি কোমল ব্যবহারের জন্য সুপরিচিত ছিলেন। তার কায়রো সফরের এক দশক পর একজন পর্যটক সেখানে গিয়ে শোনেন, সাধারণ মানুষ তার দয়া, উদারতা ও সদাচরণের প্রশংসা করছে। নিজের দেশেও তিনি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
* স্থপতি, শিক্ষাবিদ, ইসলাম ধর্মীয় পণ্ডিত পণ্ডিত, গ্রন্থকার প্রমুখ তার কাছে বিশেষ মর্যাদা পেয়েছেন।
* মানসা মুসা ১৩৩৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন, এটা অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মত; কিন্তু কেউ কেউ মনে করেন, তার মৃতুর বছর ১৩৩২; কেউ এমনও বলেছেন, তিনি মক্কা থেকে আর ফিরতে পারেননি, সেখানেই সমাহিত হয়েছেন।
* মালির স্বর্ণযুগের শাসক মানসা মুসার হজ কাফেলার সাথে তুলনীয় কোনো কাফেলা পৃথিবীতে আর দেখা যায়নি।