চাটগাঁর চায়ের আড্ডা
চট্টগ্রাম শহরের বকশীরহাটের মোড়ে দাঁড়িয়ে এখন কেউ কল্পনা করতে পারবে—কয়েক শ বছর আগে ঠিক এই জায়গায় কর্ণফুলী নদীর ঢেউ আছড়ে পড়ত কিংবা নোঙর করে আছে সারি সারি দেশি-বিদেশি নৌযান? নদী এখন ভরাট হতে হতে দুই মাইল পূর্বে সরে গেছে। অথচ একসময় এটাই ছিল চট্টগ্রামের পূর্ব সীমান্তের শেষাংশ। সেই সীমা কোতোয়ালি থেকে সোজা উত্তরে বহদ্দারহাট পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। নদীর ঘাটে ঘাটে গড়ে উঠেছিল বেশ কিছু ছোট-বড় হাটবাজার। তাদের মধ্যে বকশীরহাট ছিল সবচেয়ে পুরোনো। দুই শ বছর আগের ব্রিটিশ জরিপ মানচিত্রেও তার সাক্ষ্য মেলে। পূর্ব দিকে নদীর মাঝে বাকলিয়ার চর জেগে ওঠার পর নদীর গতিপথ বদলে গেছে এবং পুরোনো নদীটা সংকুচিত হয়ে চাক্তাই খালে পরিণত হয়েছে।
নদীর ঘাটে ঘাটে জমে ওঠা বাজারগুলোই পরবর্তী সময়ে প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল। সেই বাজারগুলোতে দেশি-বিদেশি বণিকদের জন্য গড়ে উঠেছিল সরাইখানা। যেখানে আবাসিক ব্যবস্থার পাশাপাশি পান-ভোজনেরও বন্দোবস্ত থাকত। বিশ শতকে হোটেল-রেস্তোরাঁ সংস্কৃতির জন্ম হওয়ার আগে চাটগাঁ শহরে সেগুলোই ছিল ঘরের বাইরে খানাপিনার প্রথম ব্যবস্থা। সেই সাথে ছিল কিছু পানশালা। মোগল ব্রিটিশ যুগে পানশালা বাদে বাইরের খাবারের আরেকটি জোগান ছিল বাজারে ময়রা দোকানে তৈরি মিষ্টি-বাতাসা-নিমকি। বেকারি যুগ আসার আগে বাইরের নাশতাপানির মধ্যে এগুলোই ছিল প্রধান।
চট্টগ্রামে বেকারি সংস্কৃতির যাত্রা শুরু হয়েছিল চন্দনপুরার গণি বেকারির মাধ্যমে। চট্টগ্রাম ক্লাবের ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের জোগান দেওয়ার জন্য ১৮৮০ সালের দিকে একজাতীয় কুকিজ তৈরি শুরু করে সেই বেকারি। বেলাল কারিগরের নামে সেই কুকিজ জনপ্রিয় হয় বেলা বিস্কুট হিসেবে। মূলত বেলা বিস্কুটের মাধ্যমেই চট্টগ্রামের বেকারি সংস্কৃতি যাত্রা শুরু করেছিল।
বেকারির পাশাপাশি চা দোকানের ব্যবসা শুরু হয় বিশ শতকে এসে। উনিশ শতকে চট্টগ্রামে চায়ের আবাদ শুরু হলেও ঘরে ঘরে চায়ের যুগ আসতে আরও সময় লেগেছিল। কারণ, ত্রিশ দশকের আগে স্থানীয় বাজারে চা বিক্রি হতো না। সব চা রপ্তানি হয়ে যেত। ত্রিশ দশকে বিশ্বমন্দার কারণে রপ্তানি কমে গেলে দেশের বাজারে চা বিক্রি শুরু হয়েছিল। কিন্তু মিঠাই-মণ্ডা খাওয়া বাঙালির কাছে চায়ের মতো তিতকুটে জিনিস জনপ্রিয় হওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। তাই শুরুতে ব্রিটিশ সরকার কৌশলে সাধারণ মানুষকে বিনা মূল্যে চা খাওয়ানোর চেষ্টা করে। তাতে কাজ না হওয়াতে চায়ের সাথে দুধ-চিনির স্বাদ যুক্ত করে সফল হয়েছিল। সেখান থেকে দুধ চায়ের উৎপত্তি। মানুষের বিলাসদ্রব্যের মধ্যে চায়ের অনুপ্রবেশ ঘটে।
তারপর বাজারের নিমকি-জিলাপির দোকানগুলোয় আস্তে আস্তে চায়ের প্রচলন হতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল থেকে চায়ের দোকান জমতে শুরু করে চট্টগ্রাম শহরে। সেই চায়ের দোকানগুলো পরবর্তীকালে মাছ-ভাতের জোগান দিতে শুরু করলে পরিপূর্ণ রেস্তোরাঁয় পরিণত হয়। তবু একটা সময় পর্যন্ত চায়ের দোকান এবং ভাতের হোটেল দুটো আলাদা বিষয় ছিল। এখনো চট্টগ্রামের পুরোনো এলাকাগুলোতে কিছু কিছু রেস্তোরাঁ আছে যেখানে শুধু ভাতের ব্যবস্থা আছে। চা বিক্রি করে না।
চট্টগ্রামের রেস্তোরাঁ ব্যবসার আদি পর্ব শুরু হয়েছিল বকশীরহাট এলাকা থেকে। মোগল আমলের আগ থেকেই জমজমাট ছিল বকশীরহাট-আছদগঞ্জ এলাকা। প্রাচীনকালে বদর পীরের আস্তানা ঘিরে যে বাজার গড়ে উঠেছিল, মোগল আমলে চকবাজারের দাপট শুরু হলেও বকশীর হাটের আধিপত্য অক্ষুণ্ন ছিল শত শত বছর ধরে। ব্রিটিশ আমলে এখানে গড়ে ওঠা হোটেল-রেস্তোরাঁগুলো বাড়তে বাড়তে বিশ শতকের মাঝামাঝিতে লালদীঘি ছাড়িয়ে কে সি দে রোড পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল।
চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে গড়ে ওঠা বকশীরহাটের ছমদিয়া হোটেল, কে সি দে রোডের নোভেলটি রেস্টুরেন্ট, লালদীঘির আমানিয়া হোটেল, ইম্পেরিয়াল হোটেল কিংবা কোর্ট বিল্ডিংয়ে ওঠার মুখে কর অ্যান্ড কোং ইত্যাদি ছিল খুব জনপ্রিয়। পাকিস্তান আমলে এই ব্যবসা সম্প্রসারিত হয় শহরের আরও কিছু এলাকায়। যার মধ্যে আছে রেয়াজুদ্দিন বাজারে ঢোকার মুখে হাশেমিয়া রেস্টুরেন্ট, গুলিস্তান রেস্টুরেন্ট, স্টেশন রোডের গনি রেস্টুরেন্ট, নিউমার্কেটের ঠিক উল্টো দিকে ডায়মন্ড রেস্টুরেন্ট (পরে নিউমার্কেটের দোতলায় স্থানান্তরিত), সিটি কলেজের পাশে ম্যালাবার ক্যাফে। এ ছাড়া জুবিলী রোডের সফিনা হোটেল, কাবুলী হোটেলও ছিল পাকিস্তান আমলের জনপ্রিয় রেস্তোরাঁ।
শহরের কেন্দ্রস্থলে এখনো টিকে থাকা আন্দরকিল্লার চৌরঙ্গী রেস্তোরাঁ, মোমিন রোডের দস্তগীর হোটেলের ইতিহাসও অর্ধশতাব্দী পেরিয়েছে। জলসা সিনেমার পাশে দোতলায় চমৎকার পরিবেশে গড়ে তোলা চিম্বুক রেস্টুরেন্টের কথা ভুলে গেছে সবাই। আশির দশকে চট্টগ্রাম শহরে অভিজাত রেস্তোরাঁ ব্যবসা চালু হওয়ার প্রথম যুগে ওটাই ছিল অন্যতম প্রধান রেস্তোরাঁ। বলা বাহুল্য, আরও অনেক রেস্তোরাঁর নাম হারিয়ে গেছে। এই স্বল্প পরিসরে সব হোটেলের নামধাম দেওয়া সম্ভব নয়।
এসব রেস্তোরাঁর মধ্যে বেশ কয়েকটি আড্ডার জন্য বিখ্যাত ছিল। সবগুলোকে রেস্তোরাঁ বলা যাবে না, কিছু ছিল বড়জোর চায়ের দোকান। যেখানে চা-নাশতার চেয়েও গল্পগুজব বেশি চলত। কাজেম আলী স্কুলের পাশে ১৯৪০ সালে প্রতিষ্ঠিত আফিন্যার দোকান সে রকম একটা উদাহরণ। ব্রিটিশ-পাকিস্তান যুগে রাজনৈতিক আড্ডাবাজদের বিশেষ প্রিয় দোকানটা পরবর্তী সময়ে 'রফিক্কার হোটেল' নামে টিকে ছিল সত্তর-আশির দশকেও। এ ছাড়া জুবিলী রোডের সফিনা হোটেল, বকশীরহাটের তানিয়া হোটেল, সদরঘাটের ডিলাইট রেস্টুরেন্ট, ফিরিঙ্গীবাজারের কাদেরিয়া হোটেল ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিপ্রিয় তরুণদের আখড়া। চকবাজারের সবুজ হোটেল এখনো চট্টগ্রামের কবি-সাহিত্যিকদের অন্যতম প্রধান আড্ডার জায়গা।
আগ্রাবাদ এলাকায় সদ্য বিলুপ্ত কাফে নেওয়াজ কিংবা তার পাশের রূপালী ক্যানটিন কয়েক বছর আগেও এলাকার তরুণদের নিয়মিত গোল পাকানোর জায়গা ছিল। কমার্স কলেজ রোডে সেজান রেস্টুরেন্ট আশি-নব্বই দশকে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। একই সময়ে বারিক বিল্ডিং মোড়ের বিউটি রেস্তোরাঁ ছিল দেশি-বিদেশি নাবিকদের পছন্দের জায়গা। সেই রেস্তোরাঁগুলো এখন বিলুপ্ত।
পঞ্চাশ দশকে গড়ে ওঠা স্টেশন রোডের মিসকা হোটেল ছিল চট্টগ্রামের সবচেয়ে অভিজাত রেস্তোরাঁ। মিসকা চট্টগ্রামের প্রথম লিফটওয়ালা হোটেল হিসেবেও পরিচিত ছিল। তখনো আগ্রাবাদ হোটেলের জন্ম হয়নি। ষাটের দশকে মিসকা হোটেলে নিয়মিত আড্ডা মারতেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ প্রভাষক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তার বন্ধুরা। তারা বন্ধনী নামের একটা সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন সেই আড্ডা থেকে।
তবে চট্টগ্রামের প্রাচীনতম আড্ডাখানার উদাহরণ হিসেবে সবচেয়ে এগিয়ে থাকবে নন্দনকাননের বোস ব্রাদার্স। নির্জন পাহাড়ের কোলে গড়ে ওঠা বোস ব্রাদার্সের তরুণ সমাবেশকে মিনি 'কফি হাউসের আড্ডা' বলা যায়। সেকালে অনেক বিখ্যাত লোকের আনাগোনা ছিল ওখানে। বোস ব্রাদার্সের চেয়ার-টেবিলগুলো ১৯৩০ সালের চট্টগ্রাম বিদ্রোহের অনেক গোপন আলাপের সাক্ষী ছিল। বিপ্লবীদের অনেকে সেখানে বসে তাদের পরিকল্পনার খসড়া করতেন।
বোস ব্রাদার্সের জন্মের ইতিহাসটা বেশ চমকপ্রদ। উনিশ শতকে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলা থেকে ভাগ্যন্বেষণে চট্টগ্রাম চলে এসেছিলেন সারদা চরন বোস। তিনি মিষ্টান্ন তৈরিতে পারদর্শী ছিলেন। ঘরে তৈরি মিষ্টি হাড়িতে ভরে ছোট ভাই আনন্দ বোসকে নিয়ে পায়ে হেঁটে ফেরি করে বেড়াতেন। দুই ভাইয়ের এই মিষ্টি ব্যবসা খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। পরবর্তীকালে সারদা বোসের পুত্র সুধাংশু ঘোষ ১৯২০ সালে বাবার স্বপ্নপূরণে মিষ্টান্ন বিক্রির একটা দোকান খুলে বসেন। তাঁর বাবা-কাকা দুই ভাইয়ের স্মরণে দোকানের নাম হয় বোস ব্রাদার্স।
কয়েক বছর আগে বোস ব্রাদার্স নিয়ে একটা অম্ল-মধুর স্মৃতিচারণা করেছিলেন চট্টগ্রাম কমার্স কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর শায়েস্তা খান:
আমার জীবনে সবচেয়ে সোনালি দিনগুলো দখল করে আছে নন্দনকাননের টিঅ্যান্ডটি ভবনের সামনের ঐতিহাসিক বোস ব্রাদার্স। সম্ভবত ১৯৬০ সালে প্রথম শুরু। এখন বয়স, সামাজিক অবস্থান, 'পাঠকের মৃত্যু'র কারণে তা বন্ধ হলেও ১৯৮৭-৮৮ সাল পর্যন্ত সেই 'প্রেম' অব্যাহত ছিল। ঐতিহাসিক বোস ব্রাদার্সের ঐতিহাসিক আড্ডা, এ বিষয়ে লিখতে গেলে একটি ছোটখাটো পুস্তিকাই রচনা করা যায়। ১৯৬০-৬১ সালে আমি ও আমার বন্ধুবান্ধব যখন এখানে নিয়মিত আড্ডা দিতে শুরু করি, তখন আমাদের এক 'সিনিয়র ব্যাচও' এখানে আড্ডা দিতেন। তারা সবাই ছিলেন তৎকালীন চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র। প্রখ্যাত বাঁশিশিল্পী ও গল্পকার সুচরিত চৌধুরী (যিনি প্রথম দিকে 'সুরাইয়া চৌধুরী' ছদ্মনামে লিখতেন), আধুনিক গানের শিল্পী এস এম ইউসুফ (বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও বর্তমানে প্রয়াত আইনজীবী), আধুনিক গান ও পল্লিগীতি গায়ক এ কে মান্নান (চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অবসরপ্রাপ্ত সচিব), আধুনিক গানের শিল্পী নাসির উদ্দিনের কথা মনে পড়ে তাদের মধ্যে। আমরা বয়সে তাদের অনেক ছোট ছিলাম বলে তারা প্রথম দিকে আমাদের আড্ডার সময় (বিকেলে ও ছুটির দিনে দিনের বেলায়ও) এড়িয়ে অন্য সময়ে আসতেন। পরে বয়সের কারণে হোক বা আমাদের 'আগ্রাসনেই' হোক, তাদের আড্ডা ভেঙে যায়। কিন্তু সুচরিত চৌধুরী আসতেন একটা নির্দিষ্ট সময়ে নাশতা করতে। বোস ব্রাদার্সের টেবিলগুলোও ছিল প্রাগৈতিহাসিক আমলের। এর এক পাশের কোনায় একটা ছোট্ট রুম ছিল, একেবারে undisturbed secluded, তাই আমাদের জম্পেশ আড্ডা এখানে জমে উঠত। উল্লেখ্য, এখানে শুধু মিষ্টি ও চা বিক্রি হতো। কোনো ঝাল বা বেকারি আইটেম ছিল না। কখনো কাস্টমারের উপচে পড়া ভিড় এখানে ছিল না, কিছুটা ভিড় হতো টিঅ্যান্ডটি অফিসের ছুটির সময়। তাই undisturbed আড্ডা দেওয়া সম্ভব হতো আমাদের পক্ষে। মাঝেমধ্যে কিছু কাস্টমার এসে এক-দুই সের মিষ্টি নিয়ে যেতেন (প্যাকেটে বা মাটির হাঁড়িতে) আত্মীয়স্বজনের বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। বর্তমানে নতুন প্রজন্মের পরিচালনায় (বড়দা সুধাংশ বোসের পুত্র) পুরোনো দিনের বোস ব্রাদার্স আর নেই। এখন বিস্কুট ও অন্যান্য বেকারিসামগ্রী এবং ঝাল আইটেম বিক্রি করা হয় এখানে। ভিড়ও থাকে কমবেশি।
বোস ব্রাদার্সের মালিক ছিল একান্নবর্তী হিন্দু পরিবার—বোস পরিবার। তাদের আদি বাড়ি আনোয়ারা থানার পররৈইকোড়া ইউনিয়নে, শহরে থাকতেন সদরঘাট কালীবাড়ির সামনে গলির ভেতরে। পরিবারের কর্তা ছিলেন সুধাংশ বিমল বোস। তিনি ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুট এবং ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের বীর সূর্য সেনের সহযোগী ছিলেন। তখন তিনি টকটকে তাজা রক্তের তরুণ। তাকে আমরা আড্ডাবাজরাও 'বড়দা' ডাকতাম। আমাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিরামহীন আড্ডায় তিনি মাঝেমধ্যে যে বিরক্ত হতেন না, তা নয়। আমাদের দীর্ঘ সময়ের সরব উপস্থিতি দোকানের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি করত। তা ছাড়া স্বীকার করছি আজ নির্লজ্জের মতো, আমরা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চা-মিষ্টি যা খেতাম, যাওয়ার সময় তার ৫০ শতাংশের কম দাম চুকাতাম। পরে জেনেছি, বড়দা-নেপালদা-ঘনাদা গং সেটা যে বুঝতেন না, তা নয়; কিন্তু তারা বুঝেও না বোঝার ভান করতেন।
একদিন সব বন্ধুবান্ধব কোনো এক বিয়েতে শহরের বাইরে যাই, ফিরে আসতে রাত হয়ে যায় বলে বোস ব্রাদার্সে হাজির হওয়ার সময় পাইনি। অন্যদের এবং বয়-বেয়ারাদের মুখে পরদিন শুনেছি, সেদিন বড়দা, বিকেল থেকেই শুধু উসখুস করছিলেন আর কিছুক্ষণ পরপর দরজার দিকে তাকাচ্ছিলেন। শেষে বলেই ফেললেন, 'লক্ষ্মীছাড়ারা আজ গেল কোথায়? একজনকেও দেখছি না।'
সেদিন আমরা বুঝলাম, বাইরে বিরক্তির ভাব দেখালেও ভেতরে-ভেতরে তিনি আমাদের খুবই পছন্দ করতেন। তাই বোস পরিবারের যেকোনো পারিবারিক অনুষ্ঠানে (অন্নপ্রাশনসহ) আমরা অবশ্যই নিমন্ত্রিত হতাম এবং ভূরিভোজে শামিল হতাম। সত্যিকারের দেশপ্রেমের জন্য যে ব্যক্তি জীবন-যৌবন উৎসর্গ করতে দ্বিধা বোধ করেন না, তাদের তো জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে মানবপ্রেম থাকবেই। কোনো ব্যক্তিগত সমস্যায়ও বড়দা, নেপালদা, ঘনাদা আমাকে ভেতরের কথা বলতে সংকোচ করতেন না। 'কফি হাউজের সেই দিনগুলি'—এই গানটির মতো 'বোস ব্রাদার্সের সেই দিনগুলি'র মতো একটি গান সৃষ্টি করল না সুচরিতদা, মান্নান ভাই, ইউসুফ ভাই, নাসির ভাই প্রমুখ—একটা প্রচণ্ড দুঃখবোধ রয়ে গেল আমার। আমাকে দিয়ে তো সেটা সম্ভব নয়।
এবার বড়দা সুধাংশ ঘোষ সম্পর্কে একটা সত্যিকারের গল্প বলি। আগেই বলেছি, তিনি সূর্য সেন-অনন্ত সিংহদের বিপ্লবী গ্রুপের সদস্য ছিলেন। অনেক দিন পর (এক যুগের বেশি সময় হবে) তিনি ফিরে এলেন নিজের বাড়িতে আপনজনদের কাছে। তত দিনে পরিবারের সদস্যরা তার আশা বোধ হয় ছেড়েই দিয়েছেন। ফিরে এসে তাদের কাউকে কাউকে বললেন, আমি সুধাংশ, আমি ফিরে এসেছি। ওরা বিশ্বাসই করল না, 'যা ভাগ, চিটিং করার জায়গা পেলে না।' ওদেরই বা দোষ কী? তত দিনে সুধাংশ বাবু চুল-দাড়িতে কিম্ভূতকিমাকার। আগের দিনের সেলুনটিতে গেলেন। দোকানের নাপিতটাও পুরোনো; সে চুল-দাড়ি কাটতে কাটতে হঠাৎ ক্ষুর ফেলে দিয়ে চিৎকার করে উঠে বলল, 'ওই যে আমাদের সুধাংশ বাবু।' অতঃপর অনেক হাসি-কান্নার মধ্যে আমাদের প্রিয় 'বড়দা' সুধাংশ বিমল বোসের স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন।
বোস ব্রাদার্সের মতো আরও শহরের অনেক চায়ের আড্ডার গল্প জমা আছে চট্টগ্রামের প্রবীণ সমাজের কাছে। সেই গল্পগুলো কেউ না কেউ লিখবেন নিশ্চয়ই। লেখাটি শেষ করছি আমার ব্যক্তিগত একটা অভিজ্ঞতা দিয়ে।
আশির দশকের মাঝামাঝি। সিটি কলেজে ইন্টারে পড়ছিলাম। একবার কয়েক বন্ধু মিলে নিউমার্কেটের উল্টো দিকে জলসা সিনেমার পাশে চিম্বুক নামের অভিজাত রেস্তোরাঁয় আড্ডা দিতে গেলাম। মহসিন কলেজের এক বড়লোক বন্ধু বেড়াতে এসেছে তার বান্ধবীকে নিয়ে। বান্ধবীর সম্মানে সে আমাদের তিনজনকে চিম্বুক রেস্তোরাঁয় নিয়ে গেল।
আমাদের পকেটে তখন গড়ে দশ টাকার বেশি থাকত না। চিম্বুকের মতো অভিজাত রেস্তোরাঁয় খাওয়া দূরে থাক, উঁকি দেওয়ার সাহসও ছিল না। যেহেতু বিল দেওয়ার দায় নেই; আমরা তিন বন্ধু নির্ভয়ে ঢুকে পড়লাম। মোট পাঁচজনের খাবার অর্ডার দেওয়া হলো।
খাওয়া সেরে যখন বিল এল, তখন খেয়াল করলাম শাহেদের মুখটা চুন হয়ে গেছে। সে বিলটা নিয়ে চট করে পকেটে পুরে ফেলল। তারপর বান্ধবীর চোখ এড়িয়ে আমার পাশে বসা সাব্বিরকে কিছু একটা ইশারা করল। দুজনে উঠে কাউন্টারের দিকে চলে গেল।
ঘটনা কিছু বুঝলাম না বলে গোবেচারা হয়ে বসে থাকলাম। কিছুক্ষণ পর দুজনে ফিরে এল। মুখে বিজয়ীর হাসি। কিন্তু কিছু বলছে না। আরও কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে আমরা উঠলাম। বান্ধবীকে রিকশায় তুলে বিদায় দেওয়ার পর আসল ঘটনা প্রকাশ করা হলো। আমাদের খাবার বাবদ যে বিল এসেছিল, সেটা সবার পকেটের সম্মিলিত অর্থের চেয়েও অনেক বেশি। তাই বুদ্ধিমান শাহেদ তার হাতের দামি ঘড়িটা কাউন্টারে বন্ধক রেখে বান্ধবীর কাছে ইজ্জত রক্ষা করেছে। পরে বিল জমা দিয়ে ছাড়িয়ে নেবে।
সেই ঘটনার পর আমরা ভুলেও কোনো দিন চিম্বুক রেস্তোরাঁর দিকে পা বাড়াইনি। সেই রেস্তোরাঁ উঠে গেছে আরও দুই যুগ আগে। ঘটনাটা মনে করে এখনো মাঝে মাঝে আমরা হাসাহাসি করি।