ফ্রাঙ্কেনস্টাইন: জীবনের হাতে মোচড় খেয়েছে ঘাটে ঘাটে
মেরি ওলস্টোনক্রাফট গডউইন শেলি মাত্র ১৮ বছরে পা দিয়েছেন। সে সময় লেখা শুরু করলেন 'ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বা আধুনিককালের প্রমিথিউস'। দুই বছর পরে প্রথমবারের মতো মা হলেন মেরি। কিন্তু মা হওয়ার বেদনা পেলেও মাতৃত্বকে উপভোগ করতে পারেননি। জন্মের ১১ দিনের মাথায় প্রথম সন্তান দুঃখজনকভাবে মারা যায়। মেরি প্রথমে ভেবেছিলেন, ঘুমিয়ে আছে শান্ত হয়ে। তাকে দুধ দেওয়ার জন্য জাগাননি। কিন্তু সকালে বুঝতে পারলেন, শিশুটি আর নেই। শিশুকে দুধ খাওয়াতে না পারলে মায়েরা যেসব শারীরিক সংকটে পড়েন, মেরিকেও তার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সেই সাথে দুঃস্বপ্ন হানা দিতে থাকে। এমনই এক দুঃস্বপ্নে দেখেন তার মৃত শিশু জীবন ফিরে পেয়েছে। তার শীতল দেহ আগুনের সামনে নিয়ে মালিশ করার পর শিশুটি প্রাণ ফিরে পায়। ঘুম ভেঙে যায়, মেরি দেখেন, না, শিশুটি নেই।
এর কয়েক সপ্তাহ পরে আবার গর্ভবতী হলেন তিনি। লেখাটা যখন শুরু করেন, তখন হয়তো শিশুকে তিনি দুধ খাওয়াচ্ছিলেন। লেখা শেষ হতে হতে তৃতীয়বারের মতো মা হোন মেরি। ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে ছাপা হলো 'ফ্রাঙ্কেনস্টাইন'। এ বইয়ে লেখকের নাম দেওয়া হয়নি। তার আশঙ্কা ছিল নাম দিলে হয়তো সন্তানদের তার কাছে রাখার অধিকার কেড়ে নেওয়া হবে। বেনামেই ছাপা হলো বইটি। বইতে দানবের নামও তিনি রাখেননি। নামের বদলে ব্যবহার হয়েছে উদ্বৃত কমার মধ্যে একটি শূন্যস্থান। দ্য স্ট্রেঞ্জ অ্যান্ড টুইসডেট লাইফ অব ফ্রাঙ্কেনস্টাইন নিবন্ধে এ বিষয়ে আলোকপাত করেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক এবং নিউ ইয়র্কার সাময়িকীর স্টাফ রাইটার জিল লিপোর।
১৮২৩ খ্রিষ্টাব্দে লন্ডনে এটি মঞ্চস্থ হলো। মেরির সৃষ্ট কাল্পনিক দানবের নাম ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দেন এক সমালোচক। তিনি বলেন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হলো এক 'বেনামি পুরুষ দানব' বা অ্যানোনিমাস অ্যান্ড্রোডেমন। নাটকের পোস্টারে দানবের কোনো নাম লেখা হয়নি। বরং দুই উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে শূন্যস্থান রাখা হয়। নাটকের বিষয়ে মেরি বলেন, নামহীন দশার বেনামীকে নামকরণ করা বরং ভালো। তিনি আরও বলেন, তার নিজেরই সত্যিকার কোনো নাম নেই। কাল্পনিক দানবকে ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দেহাংশ থেকে তৈরি করা হয়েছে। একইভাবে তার নিজের নামও মা-বাবা এবং স্বামীর নামাংশ নিয়ে তৈরি। নিজ নারীবাদী মায়ের নাম থেকে মেরি ওলস্টোনক্রাফট নেওয়া হয়। নিজ দার্শনিক বাবার নাম থেকে নেন গডউইন। তার স্বামী পার্সি বাইশে শেলির নাম থেকে এবারে শেলি অংশটুকু জুড়ে দেন সবার শেষে।
এর মধ্যে মেরি চার সন্তানের জন্ম দেন। তিনজনই মারা যান। এদিকে গর্ভপাতে আরেক সন্তান হারান তিনি। গর্ভপাতের ধকলে তিনি প্রায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসেন। মেরির জন্মের মাত্র ১১ দিনের মাথায় তার মা মারা যান। তিনি খুবই অসুস্থ ছিলেন। শিশু মেরিকে যত্ন নিতে পারেননি। সবার নামের অংশ মিলিয়ে এভাবে নামকরণ করে যেন তাদের সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করেই মেরি নিজের আত্মপরিচয় নির্ধারণ করেন।
মেরির সৃষ্ট চরিত্র, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন যে রাতে কাজ শেষ করেন, তার বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, এটি ছিল নভেম্বরের একটি বিষণ্ন রাত। জানালায় বৃষ্টির ফোঁটারা টোকা দেওয়ার মতো করে ঝরে পড়ছে। দুর্বল একটি মোমবাতি আলো ছড়াচ্ছে। ভিক্টর তার তৈরি প্রাণহীন বস্তুটির দিকে তাকালেন। হঠাৎ করে এটি জীবিত হয়ে উঠল। প্রাণীটিকে হলুদ নিষ্প্রভ চোখ মেলে তাকাতে দেখলেন। প্রবলভাবে শ্বাস নিচ্ছিল। সাথে সাথে কেঁপে কেঁপে উঠছে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। এমন এক প্রাণী বানানোর জন্য কঠোর শ্রম দিয়েছেন তিনি। এবারে ঘৃণা এবং আতঙ্ক তাকে পেয়ে বসল। এবারে প্রাণীটির নাম না রেখেই সেখান থেকে পালালেন ভিক্টর। পরে প্রাণীটি বলল, আমি শ্রেফ গর্ভপাত! বইয়ের শেষ অধ্যায়ে বরফের ভেলায় চেপে অদৃশ্য হয়ে গেল ভিক্টরের সৃষ্ট প্রাণী।
ফ্রাঙ্কেনস্টাইনকে একের ভেতরে চার বলাই যায়। একাধারে রূপকথা, উপকথা, পত্রোপন্যাস এবং আত্মজীবনী। চার লিখনশৈলীর মিশ্রণে জটিল ধ্রুপদি এ বিজ্ঞানকল্প রচনা করেন তরুণ মেরি শেলি। নিজের ভাষায় 'ভয়াবহ সৃষ্টি' অভিধায় ভূষিত করেন এবং নিজের সাহিত্য সৃষ্টিকে ব্যাখ্যা করার জন্য সংগ্রাম করেন। ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দের সংস্করণে তিনি বর্ণনা করেন কীভাবে তরুণী এমন ভয়াবহ কৃষ্ণ ভাবনাকে ফুটিয়ে তুলতে পারেন। ভূমিকায় স্বল্প পরিসরে তিনি বলেন, গল্পটি তার কাছে স্বপ্নের মধ্যে এসেছে। স্বপ্নে ফ্যাকাশে এক ছাত্রকে তার সৃষ্ট প্রাণীর পাশে হাঁটু গেড়ে বসে থাকতে দেখেন তিনি। মেরির দাবি, স্বপ্নে (নাকি দুঃস্বপ্নে?) যা চাক্ষুষ করেছেন, তা-ই লিখেছেন।
এক শতাব্দী বাদে, ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে ইউনিভার্সাল পিকচারস জেমস হোয়ালের পরিচালনায় ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের চলচ্চিত্রায়ণ করে। ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের নামভূমিকায় ছিলেন বরিস কারলোফ। মেরি ওলস্টোনক্রাফট গডউইন শেলির সৃষ্ট বৈপ্লবিক দানব কেবল নামহীন নয়। বরং তার চিন্তাধারাকে চলচ্চিত্রে প্রকাশ করতে চরম অবস্থায় পড়তে হয়।
প্রতিটি বই একটি শিশুর মতো। লেখক তাকে জন্ম দেন। ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের বেলায় সে কথা বোধ হয় খাটে না। এ বইকে অতিপ্রাকৃত সৃষ্টির সাথে তুলনা করা হয়। বইটি যেন মেরি লেখেননি। কাহিনি এখানে তিনি সংযোজন করেছেন। ২০ শতকের মাঝামাঝি এক সমালোচক বলেন, উত্তরাধিকারসূত্রে শেলির স্ত্রী তার বাবার দর্শনকে পেয়েছেন। জাদুবিদ্যা অর্থাৎ পিশাচবিদ্যার অন্ধকার তন্ত্রমন্ত্র চর্চা সম্পর্কে জানতেন। অবহিত ছিলেন আধুনিক বিজ্ঞানের বিস্ময় সম্পর্কেও।
মেরিকে ভাবতে গিয়ে অনেকেরই তাকে খাটো করে দেখার প্রবণতা রয়েছে। তাদের ভাবনায়, মেরি অন্যদের চিন্তাধারাকে প্রকাশ করেছেন। মেরি নিজ সৃজনশীলতাকে কেন্দ্র করে তর্কাতর্কি এড়াতে এমন ভাবনাকে সত্য বলে ধরে নেওয়ার অভিনয়ও করে গেছেন। সম্ভবত এ কারণেই প্রকাশিত হওয়ার ২০৪ বছর পরও ফ্রাঙ্কেনস্টাইন নিয়ে নিত্যনতুন ব্যাখ্যার তরঙ্গে ভাটা পড়েনি।
১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত মূল বইটি পুনরায় বিভিন্ন সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছে। পেঙ্গুইন ক্লাসিকের আওতায় পেপারব্যাক সংস্করণও রয়েছে এর মধ্যে। বইটির ভূমিকা লেখেন শালর্ট গর্ডন। দ্য নিউ অ্যানোটেড ফ্রাঙ্কেনস্টাইন নামে একটি শক্ত মলাটের সংস্করণও প্রকাশিত হয়। অনবদ্য চিত্রিত বইটি সম্পাদনা করেন লেসলি এস ক্লিলিংগার। হরর চলচ্চিত্র সিরিজ নির্মাণের অংশ হিসেবে ইউনিভার্সাল স্টুডিও পরিকল্পনা করে 'ব্রাইড অব ফ্রাঙ্কেনস্টাইন' নির্মাণের। কাহিনি কীভাবে ক্রমবিকশিত হতে থাকে, তা-ই ফুটিয়ে তোলার লক্ষ্য ছিল এখানে।
আগেই বলেছি, নামহীন দানবকে কেন্দ্র করে ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত মূল বইটির কাহিনিকে ঘিরে ব্যাখ্যার ঢেউ কমেনি কখনো। সাম্প্রতিক প্রযুক্তিশিল্প বা টেক ইন্ডাস্ট্রিজের জন্য এ বইকে হুঁশিয়ারি বার্তা হিসেবে ধরা হয়েছে। বিশেষ করে সিলিকন ভ্যালির জন্য বার্তাটি বিশেষভাবে প্রযোজ্য। মূল বইয়ের বদলে ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে চলচ্চিত্র এবং পরবর্তী সংস্করণের বইগুলোয় এ বার্তা জোরালো হয়েছে। হিরোশিমায় মার্কিন অ্যাটম বোমা হামলার পরও ওই চলচ্চিত্রের কথা উঠে আসে। এ আলোকে এমআইটি প্রেস মূল বইটির একটি সংস্করণ, 'ফ্রাঙ্কেনস্টাইন: অ্যানোটেড ফর সায়েন্টিস্ট, ইঞ্জিনিয়ারস অ্যান্ড ক্রিয়েটরস অব অল কাইন্ডস' নামে প্রকাশ করে। অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির তহবিলের জোগান দেয় আর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দ্বিশতবাষির্কী প্রকল্পের নেতারা কাজটি করেন। রোবট এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সৃষ্টির সাথে জড়িতদের দিকনির্দেশনা হিসেবেও এ সংস্করণকে উপস্থাপন করা হয়। বইটির দ্বিতীয় ভলিউমের প্রথম অধ্যায় নিজ সৃষ্ট দানব হত্যালীলায় মেতে ওঠে, তখন এ দানবের স্রষ্টা ভিক্টর মর্মবেদনায় আর্তনাদ করেন, আমি অপরিবর্তনীয় মন্দকাজের ললাট লিপি হয়ে রইলাম। এমআইটির সংস্করণে বলা হয়, অ্যাটম বোমার প্রলয় লীলা প্রত্যক্ষ করে জে রবার্ট ওপেনহাইমারের মধ্যে একই মর্ম বেদনা অনুরণিত হয়েছে। এখানে শিক্ষণীয় বিষয় হলো, নিজ সৃষ্টিকে বিশ্বে অবমুক্তির আগেভাগে স্বীয় দায়িত্ববোধের শর্তকে আবশ্যিকভাবে ভাবনায় নিতে হবে বিজ্ঞানীদের।
ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দিকে তাকালে দেখতে পাই, যৌনতা, জন্ম এবং নারী এসব আখ্যানকে প্রায় পুরোপুরি সরিয়ে দিয়েছে এ কাহিনি। মেরির লেখার এদিকের ওপর প্রথম আলোকপাতকারীদের অন্যতম মুরিয়েল স্পার্ক। ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে মেরির জীবনীতে এ বিষয় তুলে ধরেন মুরিয়েল স্পার্ক। শেলির ডায়েরি গভীরভাবে পড়েছেন স্পার্ক। তিনি বলেন, আট বছরের বেশির ভাগ সময়ই শেলি গর্ভবতী অবস্থায় ছিলেন বা সন্তান হারিয়েছেন। এদিক থেকে বিচার করলে শেলির উপন্যাসকে সাদামাটা ধাঁচের ভৌতিক কাহিনি নয়; বরং সাহিত্যের মৌলিক এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশ গণ্য করতে হবে।
১৯৭০-এর দশকের নারীবাদী সমালোচকেরা এ ধারণাকে ভিত্তি করে এগোন। তারা বলেন, ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানকল্পের নতুন ধরনের যাত্রা শুরু হয়। তারা এক তাকে এক 'ফিমেল গথিক' হিসেবে চিহ্নিত করেন। এই সমালোচকদের অন্যতম এলেন মোয়ার্স বলেন, শেলির রচনাশৈলীর মৌলিকতা তার মা হিসেবে অভিজ্ঞতা থেকে এসেছে। সে যুগের প্রধান প্রধান নারী লেখিকার জন্য যা মোটেও স্বাভাবিক ছিল না। জেন অস্টিন এবং এমিলি ডিকিনসনের উদাহরণ টেনে আনা যায়। তারা কেউই মা ছিলেন না। শেলি তার মা মেরি ওলস্টোনক্রাফটের মতোই ব্যতিক্রমী ছিলেন।
ওলস্টোনক্রাফট ছিলেন একজন সুপরিচিত নারী লেখক। শিশু পরিচর্যা নিয়েও বই লিখেন তিনি। ১৭৮৭-এ 'থটস অন দ্য এডুকেশন অব ডটারস'-এ তিনি বলেন, প্রতিটি মা-বাবার দায়িত্ব হলো তাদের সন্তানদের যত্ন নেওয়া। ১৭৯১ খ্রিষ্টাব্দে এক ভোজসভায় রাজনৈতিক চিন্তাবিদ উইলিয়াম গডউইনের সাথে তার মোলাকাত হয়। প্রথম দিকে তারা একে অন্যকে পছন্দ করেননি। দুজনেই প্রচ- চৌকস এবং রাত কেটে যায় তর্কবিতর্কে। ওলস্টোনক্রাফট প্রকাশ করেন 'ভেনডিকেশন অব দ্য রাইটস অব উইমেন'। ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে গডউইন প্রকাশ করেন 'পলিটিক্যাল জাস্টিস'।
গিলবার্ট ইমলে নামের এক মার্কিনির সাথে সম্পর্কের জেরে ১৭৯৩-এ ওলস্টোনক্রাফট গর্ভবতী হয়ে পড়েন। ফ্যানি নামের ওলস্টোনক্রাফটের এক কন্যা ছিল। যা হোক, ইমল ওলস্টোনক্রাফটকে ছেড়ে যান। ১৭৯৬ খ্রিষ্টাব্দে ওলস্টোনক্রাফট এবং গডউইনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এবারেও তিনি গর্ভবতী হলেন। তারপরই গডউইন তাকে বিয়ে করেন। ১৭৯৭ খ্রিষ্টাব্দে মেয়ে মেরি শেলির জন্মকালে সংক্রমণের জেরে প্রাণ হারান ওলস্টোনক্রাফট। সংক্রমণের উৎস ছিলেন মেরির চিকিৎসক মহোদয়। প্রসবের সময় তার অপরিষ্কার হাত থেকে সংক্রমণের সূচনা ঘটে। গডউইন পরলোকগত স্ত্রীর নামে মেয়ে শিশুটির নাম রাখেন। মৃত স্ত্রীর স্মৃতিকে জাগিয়ে রাখার জন্যই হয়তো নামটি বেছে নেন তিনি।
মেরি ওলস্টোনক্রাফট গডউইনের মাত্র ১৫ বছর বয়সে পার্সি বাইশে শেলির সাথে প্রথম দেখা হয়। ১৮১২ খ্রিষ্টাব্দের কথা। কবি শেলির বয়স তখন ২০, বিবাহিত এবং তার স্ত্রী তখন মা হতে চলেছেন। নাস্তিক হওয়ায় কবিকে অক্সফোর্ড থেকে বের করে দেওয়া হয়। এমনকি কবির বাবাও তাকে ত্যাজ্য করেন। সে সময় মেরির বাবার সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। তিনি গডউইনের পালক পুত্র বনে যান। এ সময়ে মেরি ও শেলি গোপন প্রণয়ে জড়িয়ে পড়েন। প্রণয়কালীন তারা মেরির মায়ের কবরের পাশে বসে গডউইনের লেখা পড়ে সময় কাটাতেন। তবে কেবল কেতাব পড়েই সময় কাটত তাদের, তারা ততদিনে যথেষ্ট অন্তরঙ্গতায়ও ডুবেছেন। মেরি গর্ভবতী হওয়ার পর এক মধ্যরাতে শেলির সাথে পালালেন। সঙ্গে গেলেন মেরির সৎবোন ক্লেয়ারমন্ট।
ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন চরিত্র সৃষ্টিতে যদি কারও অনুপ্রেরণা পেয়ে থাকেন, তবে তিনি আর কেউ নন, খোদ কবি লর্ড বায়রন। বায়রনকে 'উন্মাদ, বদ এবং আশেপাশে থাকা বিপজ্জনক' হিসেবে চিহ্নিত করেন তারই এক প্রেমিকা। নিজ সৎবোন আগস্ট লেইসহ অনেকের সাথেই লীলায় মেতেছেন তিনি। বায়রন বিয়েও করেছিলেন। মাত্র এক বছরের মাথায় তার স্ত্রী চলে যান কন্যা আডাকে নিয়ে। লেইকে নিয়ে কেলেঙ্কারি প্রকাশ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এ ঘটনা ঘটে। বাবার মতো কবি হননি আডা। তাকে গড়ে তোলা হয় অঙ্কবিদ হিসেবে। মেরি শেলির বয়সী আডা তুখোড় কল্পনাশক্তির অধিকারী ছিলেন। মেরির সৃষ্ট চরিত্র ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মতোই ছিল তার কল্পনাশক্তি। কম্পিউটার তৈরির বহু আগেই তিনি সাধারণ কাজের কম্পিউটার কেমন হতে পারে, তার বিশদ তৈরি করেন।
১৮১৬ খ্রিষ্টাব্দে কেলেঙ্কারি থেকে মুখরক্ষা করতে বায়রন ইংল্যান্ড ছেড়ে ভাগলেন জেনেভায়। সেখানেই তার সাথে পার্সি শেলি, মেরি গডউইন এবং ক্লেয়ারমন্টের দেখা মেলে। নীতিবাদীরা চারজনের এ দলকে 'অজাচার সংঘ' বা 'লিগ অব ইনসেস্ট' হিসেবে চিহ্নিত করেন। গরমকাল আসতে আসতেই বায়রনের কৃপায় ক্লেয়ারমন্ট গর্ভবতী হয়ে পড়েন। তত দিনে বায়রনেরও বিরক্ত ধরে গেছে। এক সন্ধ্যাকালীন আড্ডায় ঘোষণা দেন, আমরা একটা করে ভৌতিক গল্প লেখব। গডউইন গল্প লেখায় মেতে উঠেন। পরবর্তী সময়ে সে গল্পই হয়ে ওঠে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের কাহিনি। পরে বায়রন লেখেন, ১৯ বছর, না তখনো ১৯ বছর বয়সী নয়, এমন তরুণীর লেখা বইটিকে আমি মনে করি খুবই চমৎকার হয়েছে।
পরবর্তী কয়েক মাস ধরে ভৌতিক গল্পকে উপন্যাসে রূপান্তরের কাজ করছিলেন গডউইন; একই সময় তার উদরে আরেক মানবশিশু বাড়ছিল। এদিকে পার্সি শেলির গর্ভবতী স্ত্রী আত্মহননের পথ বেছে নেন। মেরির সৎবোন মেয়ের জন্ম দেন। মেয়ের বাবা হলেন বায়রন। কিন্তু অনেকেই মনে করেন, প্রকৃতপক্ষে বাবা হলেন শেলি। শেলি এবং মেরি বিয়েও করেন। এ ছাড়া সৎবোনের শিশু কন্যাকে দত্তক নেওয়ার কোশেশ করেন। বায়রন বাদ সাধেন। তিনি কন্যাটির দায় গ্রহণ করেন। একই সাথে উল্লেখ করেন, শেলির কতগুলো সন্তান মারা গেছে। নিষ্ঠুরভাবে ব্যঙ্গ করে আরও বলেন, মেয়ে শিশুকে তাদের সাথে থাকতে দেওয়ার মানে দাঁড়াচ্ছে, তাকে জীবনের শেষ চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া! অবশ্য বায়রন ওই কন্যাশিশুকে পরে একটি কনভেন্টে দিয়ে দেন এবং সেখানে পাঁচ বছর বয়সে সে মারা যায়।
লেখা শুরু করার ১৮ মাস পরে ১৮১৬-এর গরমকালে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন প্রকাশিত হয়। নাম প্রকাশ না করে বইটির ভূমিকা লেখেন কবি পার্সি শেলি। বইটি মেরির বাবাকে উৎসর্গ করা হয়। দ্রুত জনপ্রিয়তার হাওয়ায় ভাসতে থাকে বইটি। পার্সির এক বন্ধু বলেন, সবাই এ বইয়ের কথা জানেন এবং পড়েছেন। স্যার ওয়াল্টার স্কট ধরে নেন, কবি শেলি বইটির লেখক। তিনি বইটির কাব্যিক কল্পনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠেন। কিন্তু এতেও সমালোচকদের শাণিত বাক্যাবলি থেকে রেহাই পাওয়া যায়নি। বইটিকে তারা, উগ্র, বিকারগ্রস্ত এবং অনৈতিক বলেন। কাহিনিকে রাশিয়ান পুতুলের মতোই জটিল বলে আখ্যায়িত করেন। কাহিনির বহিঃস্তরে রয়েছে ভয়ংকর কিছু চাক্ষুষ করার বিষয়Ñআর্কটিক অভিযাত্রীর চিঠি। মাঝে ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের গল্প, কী করে অকল্পনীয় গবেষণা চালান তারই বর্ণনা। এবং সবশেষে রয়েছে নামহীন প্রাণী নিজের কথা নিজেই বলার গল্প। পরতের পর পরত খুলে রাশিয়ার পুতুলের মতোই ভেতরের শিশুর দেখা মেলে!
ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের কাহিনিকাঠামো কোন দিক থেকে দেখা হচ্ছে, তার ভিত্তিতে রাজনৈতিক উগ্রবাদের বিপক্ষবাদীদের মতোই বিপ্লবী এবং প্রতিবিপ্লবীদের দ্বন্দ্বে ফেলে দেয়। সহিংস বিপ্লবকে ধ্বংসাত্মক বলে মনে করতেন ব্রিটিশ রাজনীদিবিদ এডমন্ড বার্ক। ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও অনুরূপ। অন্যদিকে নামহীন প্রাণীর রাজনীতির সাথে মেরি ওলস্টোনক্রাফট এবং উইলিয়াম গডউইনের চিন্তাধারার মিল রয়েছে। সামন্তবাদ এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তারা।
একসময়ের নামহীন নির্দোষ প্রাণীটি নিষ্ঠুর আচরণ করে খলনায়কের পর্যায়ে নেমে যায়। এখানে ওলস্টোনেরক্রাফটের দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিধ্বনি ঘটেছে। তিনি বলেন, দুর্দশা হিংস্রতা সৃষ্টি করে। ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের প্রতি পাঠকের সমবেদনা দক্ষতার সাথেই শেলি সরিয়ে আনেন। তিনি সমবেদনাকে নিয়ে যান নামহীন প্রাণীর দিকে। এমনকি প্রাণীটি যখন হত্যাকাণ্ড চালায়, তখনো এ ধারা অব্যাহত থাকে। ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের প্রতি প্রাণীটির আকুল আকুতি আমার গল্পটা তো শোনো! এর মধ্য দিয়ে তার বেদনাপূর্ণ উৎস বা সৃষ্টির বিষয়টি উঠে আসে। পরিত্যক্ত এবং অসহায় প্রাণী হাঁটতে, কথা বলতে শেখে মানুষজনের আচরণ দেখে দেখে। অসাম্য নিয়ে একটি বই পড়ে অন্যায় সম্পর্কে অবহিত হয়। সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস এবং ক্ষমতার অপব্যবহার কীভাবে যন্ত্রণা সৃষ্টি করে, এ কাহিনি তা-ই ব্যক্ত করেছে। প্রাণীটি জানতে পারে, দুর্বল সব সময়ই শক্তিশালীর নির্যাতনের শিকার হন আর গরিবকে সবাই ঘৃণা করেন।
নিজে যে বই পড়েছেন, তার তালিকা সাবধানের সাথে রাখতেন মেরি শেলি। মিলটন, রুশো, গ্যাটে, ওভিড, স্পেন্সার, কোলরিজ, গিবনসহ আরও শত শত বই পড়েছেন তিনি। ইতিহাস থেকে রসায়নশাস্ত্র কিছুই বাদ যায়নি তার পড়ার তালিকা থেকে। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন লেখার সময়ও তার দৈনন্দিন জীবন যাত্রার ছক, হাঁটাচলা করা, লেখা এবং পড়ার কথা উল্লেখ করেছেন। পঠিত বইগুলো তার মনে নিজস্ব চিন্তাধারা বা বিশ্বদর্শনের রূপরেখা এঁকে গেছে।
প্রাণীটি অন্যের কথা শুনে শুনেই পড়তে শিখেছে শেলির এ বর্ণনাকে অবাস্তব আখ্যা দেন সমালোচকেরা। কিন্তু ফ্রেডরিক ডগলাসের ক্রীতদাসের আত্মজীবনীর সাথে এ ঘটনার মিল পাওয়া যায়। ডগলাসও শ্বেতাঙ্গ ছেলেদের সাথে লেনদেনের মধ্য দিয়ে লেখাপড়া শেখেন। একই সাথে বই পড়ার মধ্য দিয়ে তার প্রতি অবিচার করার বিষয়টি বুঝতে পারেন। একইভাবে প্রাণীটি তাকে কীভাবে সৃষ্টি করা হয় এবং তার প্রতি বদ আচরণের বিষয়টি বুঝতে পারেন ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের নোটগুলো পড়ে। এই জ্ঞানলাভ তাদের মোক্ষ দেয়নি বরং দুর্দশা বাড়িয়েছে। ডগলাস লেখেন, আমার নিজ অস্তিত্বই আমার কাছে অনুশোচনার কারণ হয়ে ওঠে। অন্যদিকে প্রাণীটি বলে, অভিশাপ! অভিশাপ দেই আমার স্রষ্টাকে! আমি কেন বেঁচে আছি? এ কারণেই প্রাণীটি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে এবং ডগলাস পালানোয় উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে।
মেরি শেলির ফ্রাঙ্কেনস্টাইন একটি প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। প্রশ্নটি হলো, দানব তৈরির দায়ে ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দোষী, স্রষ্টা এবং নারীর ভূমিকাকে খাটো করেছেন। নাকি নামহীন প্রাণীকে আদর-ভালোবাসা দিতে এবং শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন? অনেকেই ফ্রাঙ্কেনস্টাইনকে ওপেনহাইমারের সাথে তুলনাও করেন।
দাসপ্রথা বিলোপ নিয়েও তর্ক উসকে দেয় এ বই।
মেরি শেলি এবং তার স্বামী পার্সি দুজনেই ছিলেন দাসপ্রথা বিলোপের পক্ষে। দাসপ্রথার বিরোধী ছিলেন, তবে মনে করতেন দাসদের ঠিক শিক্ষাদীক্ষা ছাড়াই দ্রুত মুক্ত করে দেওয়া হলে তারা সহিংস হয়ে উঠবে। নিজ উপন্যাসে শেলি সূক্ষ্মভাবে নামহীন প্রাণীকে জাতিগত দিক থেকে ভিন্ন হিসেবে তুলে ধরেন। এই ভিন্নতাকে মঞ্চ এবং চলচ্চিত্রায়ণের বেলায় অতিরঞ্জিত করা হয়। অ-ইউরোপীয় হিসেবে প্রকাশ করার জন্য প্রাণীর ভূমিকার অভিনেতারা মুখকে নীল বা সবুজ রং করে নেন। দাসমুক্তি নিয়ে ব্রিটিশ সংসদীয় বিতর্কে আফ্রিকানদের কার্যকারণ অবুঝ শিশুর মতো বলে উল্লেখ করা হয়।
ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বইয়ে নামহীন প্রাণীকে অনেক সময়ই দাসত্বের প্রতিনিধি হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। এ যুক্তি তুলে ধরেন ব্ল্যাক ফ্রাঙ্কেনস্টাইন: দ্য মেকিং অব অ্যান আমেরিকান মেটাফোরে এলিজাবেথ ইয়ং। দাসপ্রথাবিরোধী ডেভিড ওয়াকার মনে করেন, দাসত্বের ফলে ভেতর থেকে মরে যাওয়ার অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হতে হয়। ফেডারিক ডগলাস দাসপ্রথাকে বলেন, মার্কিন পোষা দানব। ১৮৫০-এর দশকে মার্কিন মুলুকের রাজনৈতিক কার্টুনগুলোতে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের নামহীন দানবকে কালো মানুষ হিসেবে দেখানো হতে থাকে। এটি সে দেশটির ওপর দাসত্বের প্রতিশোধের প্রতীক হয়ে ওঠে।
এর মধ্যে মেরি শেলি ব্যক্তিগত জীবনে মৃত্যুর মিছিলে পড়েন। তার সৎবোন ফ্যানি ইমলে ১৮১৬ সালে আত্মহত্যা করেন। ১৮২২ খ্রিষ্টাব্দে পার্সি শেলি পানিতে ডুবে মারা যান। ১৮২৮-এ অসুখে ভুগে গ্রিসে মারা যান কবি লর্ড বায়রন। সব মিলিয়ে নিজের পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে শেলি বলেন, আমি ভালোবাসার একটি সম্প্রদায়ের শেষ মানুষ, আমার সঙ্গী-সাথিরা আমার আগেই চলে গেছেন। একের পর এক দুঃখ-যন্ত্রণার এই ঢেউ তার পরবর্তী উপন্যাস 'লাস্ট ম্যান'কে (১৮২৬) প্রভাবিত করে। এই বইয়ের কাহিনি গড়ে ওঠে ২১ শতকের পটভূমিতে। ভয়াবহ প্লেগ বিশ্বমারিতে গোটা মানবজাতি নির্মূল হয়ে যায়, টিকে থাকে শুধু একজন মানুষ। বেঁচে যাওয়া নিঃসঙ্গ মানুষটি তার সব জ্ঞান এবং কল্পনাশক্তি থাকা সত্ত্বেও একজনকেও রক্ষা করতে পারেননি।