রং, স্বাদ, খুশবু না চিনেও বেস্টসেলার রান্নার বইয়ের লেখক!
অন্যান্য প্রাণী থেকে মানুষকে আলাদা করে তার খাদ্য গ্রহণের ধরন। পৃথিবীর আদিকাল থেকে ধীরে ধীরে মানুষ খাদ্য গ্রহণের স্বতন্ত্র উপায় আবিষ্কার করেছে। অন্য প্রাণীরা যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা খাবার চিবানোর পেছনে কাটিয়ে দেয়, মানুষ তখন আগুনে ঝলসিয়ে, পুড়িয়ে, ভেজে, সেদ্ধ করে নুন-মসলা ছিটিয়ে ঝটপট খেয়ে নেয়। মানুষের আদিম অবস্থা থেকে সভ্যতায় উত্তরণের পথ বলা হয় এই রান্নাকে। সময়ের দাবিতে এই রান্নাবান্না আলাদা বিদ্যা, বিজ্ঞান ও শিল্পের মর্যাদা পেয়েছে। মানুষের স্বতন্ত্র এই বৈশিষ্ট্য কি অন্য কারও দখলে চলে যাবে? কেউ কোনো দিন এই আশঙ্কা প্রকাশ করেছে কি?
প্রশ্নটা এল এই কারণে যে আর সব প্রাণী থেকে যে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য মানুষকে বিশিষ্ট করেছে, তা অন্য কোনো প্রাণী নয়; এমন কেউ রপ্ত করে নিচ্ছে যে প্রাণহীন ও নির্জীব। মানুষের মতো অকৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা তার নেই। এমনকি স্বাদ-গন্ধ গ্রহণের ক্ষমতাও তার নেই। তারপরও কীভাবে কোন উপাদান দিয়ে কী রান্না করা যায়, সেই সবকও দিয়েছে সে। লিখে চলেছে অসংখ্য বই। মানুষও জেনে না জেনে তা কিনছেও দেদার। কেনার পরিমাণ এত যে সেই বইগুলোই হয়ে যাচ্ছে বেস্টসেলার, বিশ্বের নামীদামি শেফরা পাত্তা পাচ্ছেন না তাদের কাছে।
কয়েক মাস আগের ঘটনা। ভয়েস অব আমেরিকার অনুসন্ধানী সাংবাদিক ম্যাথিউ কুপারের একটি টুইট অনেকের নজর কাড়ে। টুইটে ম্যাথিউ লিখেছেন, এ সপ্তায় তারা বিবাহবার্ষিকী উদযাপন করছিলেন। এ উপলক্ষে তার মা-বাবা একটি উপহার পাঠিয়েছেন। অত্যন্ত ব্যবহারিক উপহার। একটি ক্রকপট (ইলেকট্রিক রান্নার পাত্র) এবং সঙ্গে ক্রকপটে রান্নার একটি বই। টুইটে ম্যাথিউ জানিয়েছেন, তারা এ নিয়ে বেশ রোমাঞ্চিত। তবে ছোট্ট একটি সমস্যা ধরা পড়েছে। তিনি নিশ্চিত হয়েছেন রান্নার বইটি এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স) দিয়ে লেখা! ম্যাথিউ কুপারের এই টুইটটি প্রায় সাড়ে তিন মিলিয়ন ভিউ হয়েছে, যাকে বলে রীতিমতো ভাইরাল।
'দ্য কমপ্লিট ক্রকপট কুকবুক ফর বিগিনার্স' শিরোনামের এই বইয়ের লেখক লুইসা ফ্লোরেন্স। বইয়ের ফ্ল্যাপে থাকা লেখিকার সংক্ষিপ্ত জীবনী থেকে জানা যায়, তিনি ফিলাডেলফিয়ার ষাট বছর বয়সী একজন লেখক ও রন্ধনশিল্পী। রয়েছে রাঁধুনী হিসেবে নামকরা রেস্টুরেন্টে কাজের অভিজ্ঞতা। রান্নাবান্নার এটিই তার প্রথম বা একমাত্র বই নয়; আরও গোটা কয়েক বই তিনি লিখেছেন এবং সেগুলোর চমৎকার রিভিউ রয়েছে তার ঝুলিতে। আর এই বইটি তো আমাজনের অন্যতম বেস্টসেলার!
ফ্ল্যাপে এ-ও লেখা রয়েছে, লেখিকার স্বপ্ন নিজেকে সম্পূর্ণরূপে রান্নাঘরের জন্য উৎসর্গ করা। এর পাশেই রয়েছে লেখিকার একটি হাস্যোজ্জ্বল ছবিও। অনুসন্ধানী সাংবাদিক ম্যাথিউ কুপারের সন্দেহের শুরু এখান থেকেই। ছবিটি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলে ধরা পড়ে একটি কাঁধের খণ্ডিত উপস্থিতি। আবার দুটি কানের দুলের অমিল। পরে সরাসরি খোঁজ নিয়ে কোনোভাবে লেখিকার কাছেও পৌঁছা সম্ভব হয়নি। পরিচয় জানতে চেয়ে আমাজনের কাছে আগ্রহ প্রকাশ করা হয়। তবে বড় ভুলটি এবং কৃত্তিম লেখা ম্যাথিউ কুপারের কাছে ধরা পড়ে গত মার্চে। কিছু বানান ত্রুটি তো রয়েছেই, এমনকি ছোলা এবং কিনোয়া রান্নার একটি রেসিপিতে যেসব উপাদানের উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে এই দুটিকেই বাদ দেওয়া হয়েছে।
লেখিকাকে যে শহরের বলে পরিচয় দেওয়া হয়েছে, সম্প্রতি সেই শহরেরই একটি সাময়িকী তার খোঁজে নেমেছিল। কোথাও তাকে তারা খুঁজে পায়নি। ফিলাডেলফিয়া ম্যাগাজিন বইয়ের ভেতরেও গরমিল পায়। বইটির প্রচ্ছদে এক হাজার একটি রেসিপির বিজ্ঞাপন থাকলেও ভেতরে তারা মাত্র ৪২৪টি রেসিপি পেয়েছে। বর্তমানে এই বইসহ লেখিকার অন্যান্য বই, যার কয়েকটি আমাজনের সর্বোচ্চ বিক্রির শীর্ষ তালিকায় ছিল, এখন আর শপিং সাইটে পাওয়া যাচ্ছে না। এসব বইয়ের প্রকাশকের নাম-ঠিকানাও ভুয়া। ফিলাডেলফিয়া ম্যাগাজিন শেষ পর্যন্ত আমাজন কর্তৃপক্ষের কাছেও পৌঁছায়। কিন্তু তারা সন্তোষজনক কোনো উত্তর দিতে পারে না।
রান্নার বইয়ের এমন জাল লেখকের সংখ্যা অনেক। প্রতিদিনই নতুন নতুন বই আসছে। সাধারণ পাঠকের কাছে অনেক বই নিখুঁত মনে হচ্ছে। এসব বইয়ের পেছনে কোনো খাবারের রং, স্বাদ, খুশবু উপলব্ধি করতে পারার মতো মস্তিষ্ক নেই। প্রতিটি রেসিপি নিজে যাচাই করে দেখেনি এর কোনো 'রচয়িতা'। সাধারণত কোনো খাবার পরিবেশনের আগে রাঁধুনী নিজে একবার তা 'চেখে' দেখার নিয়ম রয়েছে। এসব বইয়ের রচয়িতা 'রন্ধনশিল্পী'র ক্ষেত্রে তার কোনো সুযোগই নেই। তারপরও এত বই, এত ক্রেতা কীভাবে!
আসলে আমাজনের 'কিন্ডল ডাইরেক্ট পাবলিশিং' নামে একটি ই-বুক এবং পেপারব্যাক সেলফ্ পাবলিশিং প্রোগ্রাম রয়েছে। এই ব্যবস্থাটিকে তারা এতটাই সহজ করে তুলেছে যে আপলোড করে দিলেই হয়ে গেল বই। ভেতরে জিনিস যা-ই থাকুক না কেন। এটি যেহেতু চাহিদা অনুযায়ী ছাপা (প্রিন্ট অন ডিমান্ড) প্রোগ্রাম, তাই আগে থেকে অর্থ লগ্নির প্রয়োজন নেই। ক্ষতির আশঙ্কাও নেই। ফলাফল এআই রচিত অসংখ্য রান্নার বইয়ের উৎপাদন। সেগুলো আবার তালিকার শীর্ষে আনার জন্য বটকে দিয়ে বারবার ক্লিক করানো থেকে ইতিবাচক মন্তব্য করানো হয়। তারপর সাংবাদিক ম্যাথিউ কুপারের মা-বাবার মতো অনেকে না পড়েই তা অর্ডার করে ফেলেন।
তবে প্রশ্ন অন্য জায়গায়, জগতের প্রায় সব বিভাগেই এআই প্রবেশ করছে। বাংলায় এটিকে বলা যেতে পারে, জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ পর্যন্ত এআইয়ের বিস্তৃতি ঘটছে। এমন অবস্থায় রন্ধনশিল্পে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার প্রবেশ ঘটা অস্বাভাবিক নয়। ক্রমবর্ধমানসংখ্যক এআই টুল নতুন রেসিপি এমনকি পূর্ণাঙ্গ মেনু সামনে উপস্থাপন করছে। কিছু তাদের রোবোটিক হাত রান্নাঘর অবধি পৌঁছে যাচ্ছে। সর্বোত্তম পুষ্টি, খাবারের স্বাদের পরিলেখ বুঝতে এবং শনাক্ত করতে পারে অ্যালগরিদম। এআই রচিত রান্নার বইয়ের রেসিপি অপরীক্ষিত হওয়ার পরও যেকোনো উপায়েই হোক বেচাবিক্রি বেশ ভালো। এ কারণে বিষয়টি গুরুত্ব দিতেই হয়।
বিবিসি এ কারণে একটি পরীক্ষায় নামে। তারা একজন পেশাদার রাঁধুনী এবং এআইয়ের দেওয়া রেসিপি অনুযায়ী বানানো ফিউশন ফুড খেতে দেয় কয়েকজনকে। কয়েকটি নির্ধারিত উপাদান থেকে কে সেরা স্বাদের খাবার তৈরি করতে পারে, তা দেখার জন্যই এই পরীক্ষা চালায় বিবিসি। যে ফলাফল আসে, তা আশ্চর্যজনক। পেশাদার রাঁধুনীর বেশির ভাগ খাবারই পরীক্ষকেরা পছন্দ করেছেন। তবে দু-একটি খাবার মুখে দিয়ে পরীক্ষকেরা বুঝতেই পারেননি যে সেটি কোনো পেশাদার রাঁধুনীর নয়; কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার তৈরি।
যেকোনো খাবার কেমন লাগছে, তা নির্ভর করে অনেক কিছুর ওপর। কোথায়, কীভাবে, কোন পরিবেশে খাবারটি গ্রহণ করা হচ্ছে, এর কারণেও স্বাদে তারতম্য হতে পারে। চলচ্চিত্র দেখতে দেখতে মানুষ পপকর্ন খেতে পছন্দ করে। খালি পেটে সকালবেলা সেটি ভালো না-ও লাগতে পারে। খাবারের স্বাদ, ঘ্রাণের অনুভূতি না থাকা এআইয়ের ডেভেলপারদের আরও ভাবতে হবে মানুষের এই সংবেদনশীল গুণ কীভাবে তারা মেশিনকে দেবেন। শুধু বাইনারি পদ্ধতিতে এগুলো তাদের চলবে না। খাদ্য গ্রহণের সময় মানুষের মানসিক অবস্থা ও ইন্দ্রিয় কীভাবে কাজ করে, তা ধরে ফেলতে পারলে এআই রন্ধনশিল্পে যে বিপ্লব ঘটাতে পারবে, তাতে সন্দেহ রাখা ঠিক হবে না।