বইয়ের রাজ্যে কাণ্ডজ্ঞান আর জ্ঞানকাণ্ড
পুস্তকের রাজ্য অতীব শক্তিশালী। এত শক্তিশালী যে পুস্তকের স্নেহছায়ায় বিরাজ করেন যাঁরা, তাঁদের ধমকপ্রদান সামর্থ্য মারাত্মক। তাঁরা পুস্তকরাজ্যের বাইরের প্রজাদের ওপর কিংবা পুস্তকরাজ্যের অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রজাদের নিরন্তর ছড়ি ঘোরাতে পারেন। এখন কেউ বলতে পারেন যে 'কোন ধরনের বইয়ের কথা বলছ হে?' এখানেই তো সকল জারিজুরি। বইয়ের মাহাত্ম্য যেভাবে সকল শিক্ষিত পরিবারে বিজ্ঞাপন করা হতে থাকে, সেখানে শৈশবে কোনো মানুষ বইয়ের বর্গবিচার নিয়ে খুব একটা ভাবার অবকাশ পান না। সেখানে বই একটা বর্গহীন পরিচয়হীন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ভেদবিচারহীন অটুট একেকটা জ্ঞানপিণ্ড। এমন এক পরশপাথর, যার ছোঁয়াতে সকল শিশু মহামানব হিসেবে ধীরে ধীরে বিকশিত হতে থাকবে। মহামানব হয়তো একটু অতিরঞ্জন শোনাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে 'মহত্ত্ব' অর্জনের সোপান হিসেবে যে বইকে দেখা হয়ে থাকে তা নিয়ে খুব একটা তর্ক আপনি করতে পারবেন না। মহামানব পদটির 'মহা' উপসর্গটি এখানে নিশ্চয়ই শরীরের আকারের সাথে সম্পর্কিত নয়। বই পড়ার অভ্যাসকেও 'সদ্গুণ' হিসেবেই দেখা হয়ে আসছে। এই দেখাদেখিটা যে বিশেষ মূল্যবোধাশ্রয়ী সেটাই আমার বক্তব্য।
আমাদের শিশুকালে এবং মফস্বল শহরে বইয়ের মতো তাকতদার কোনো কিছু অবস্তুজগতে ছিল না। শিশুদের যেকোনো তর্কে বই ছিল তুরুপের তাস। 'আমি বইয়ে পাইছি' বলে যেকোনো শিশু অন্য শিশুকে ঘায়েল করে ফেলতে পারতেন। কিংবা প্রতিপক্ষ শিশু বইয়ের বার্তা পাবার আগেও জিজ্ঞাসা করতে পারতেন 'কোন বইয়ে পাইছস এই সব?' বই ছাড়া আর যে কর্তৃপক্ষের এই রকম সমরূপ মর্যাদা ছিল, তা হলেন বাবাবৃন্দ। 'বাবায় বলছে' এই ঘোষণারও মারাত্মক প্রভাব ছিল। বাবাবৃন্দ বলার কারণও বাবাতেই নিহিত। একজন যদি বলেন 'বাবায় বলছে', তাহলে আরেক শিশু, বিশেষত তিনি যদি কিছুটা আত্মবিশ্বাসী গোছের হয়ে থাকেন, অনায়াসে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারতেন 'তোর বাবা কি আমার বাবার থেকে বেশি জানে?' এ রকম চ্যালেঞ্জের পর যেসব শিশু কুঁকড়ে যেতেন, তাঁদের নিজ বাবার সামর্থ্য বিষয়ে সন্দিহান তথা বিশ্বাসঘাতক শিশু হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। বরং তখন হয়তো তিনি সামাজিক মর্যাদার প্রাথমিক ব্যাকরণ সবে শিখতে শুরু করেছেন। হয়তো তাঁর সত্যিই মনে হতে থেকেছে যে থানার ওসি-বাবার তুলনায়, মিউনিসিপ্যালিটির কেরাণি-বাবার জানন-সামর্থ্য অর্থাৎ কিনা জ্ঞানশক্তি কম থাকতে পারে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, বই আর বাবা শিশুদের ক্ষমতাবিন্যাসে লাগসই সব প্রপঞ্চ। বই আর বাবার এই সমান্তরালে থাকা কাকতালই। অন্তত এই অনুচ্ছেদে বইকে প্যাট্রিয়ার্কাল বলে পর্যবসন করানোর ইচ্ছাতে অনুচ্ছেদটি লিখিনি।
অধুনা কালের শিশুদের আমার কমই দেখা হয়। বিশেষত শিশুরা পরস্পর কী কী ভাষায় আক্রমণ-প্রতি-আক্রমণ করে থাকেন, তা দেখার সুযোগ খুবই কম। এমনকি যেসব পরিণত বয়সের মানুষজনের বাড়িতে দু-চারজন শিশু থাকেন, তাঁরাও খুব একটা পান বলে আমার মনে হয় না। কারণ, নিবিড় শিশু চক্রের ভাষা একজন পরিণতবয়স্ক মানুষের উপস্থিতিতে একই থাকে বলে নিশ্চিত হওয়া মুশকিল। আমার জন্য কেবল উপায় রইলেন সেসব পিতামাতা যাঁদের শিশুরা স্কুল বা কোনো আড্ডা থেকে ফিরে আদ্যোপান্ত সকল গল্প মা-বাবাকে করে থাকেন। তবে এসব ক্ষেত্রেও মায়েরা গুরুতর এগিয়ে। আর এ রকম মায়েদের খুঁজে-খুঁজে আমার অনেক আলাপ করা হয়নি। অন্তত এখন অবধি।
তবে কথা হচ্ছিল বইয়ের তাকত নিয়ে। শিশুরাজ্যে, কিংবা হয়তো তাঁদের মায়েদের রাজ্যে, আমার যে থাকতেই হবে তা নয়। বরং পরিণত বয়স্ক মানুষদের সাথে আমার মেলামেশা করাই তো লাগে। পেশাগত কারণে লাগে, বাসের সহযাত্রার কারণে লাগে, সামাজিক-সৌজন্যের কারণে লাগে। সকল বিরহপ্রচেষ্টা সত্ত্বেও এমনকি 'সাহিত্য-শিল্প' ধরনের যোগাযোগেও লাগে। এর মধ্যে ঢাকা শহরের বাস্তবতায় বাসের সহযাত্রা গুরুতরভাবে অনটনের জায়গা। ঢাকা এমন এক মেট্রোপলিস, যেখানে পাবলিক বাসে মধ্যবিত্ত শ্রেণির খুবই হতভাগা কয়েকটা উপাংশ বিরাজ করেন। আর যাঁরা বাসে যাতায়াত করেন, তাঁদেরও একাংশ কখনো আর বাসে চড়া লাগবে না ভাবতে ভাবতে ব্যাংকের গাড়ি লোনের প্রকল্পগুলো নামতার মতো আওড়াতে আওড়াতে বাসে চড়ে থাকেন। এত রকমের প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও কিছু বয়স্ক মানুষ (মুখ্যত পুরুষ) আমার অভিজ্ঞতাতে আসেন। পুস্তকের শক্তিমত্তা ও প্রভাব বুঝতে এঁরাও দারুণ সব বিষয়বস্তু। আসলে শিশুদের বাহাদুরির পাটাতন যেমন নিবিড়ভাবে পুস্তক-পরিমণ্ডল গড়ে দিয়ে থেকেছে, অ্যাডাল্টরাও ততটাই নিবিড়ভাবে পুস্তকস্নেহ পেয়ে থাকেন। শিশুকিশোরদের পুস্তকসেবনের একটা গুরুতর প্রকাশ ঘটানোর রাস্তা বা চ্যানেল হলো স্কুল-কলেজের বিতর্কের অনুষ্ঠানগুলো। পরের দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশন এই রাস্তা সুগম করে দিয়েছিল। তুলনায় অ্যাডাল্টরা খানিকটা অসহায়, ভাগ্যবঞ্চিত। ফলে তাঁদের প্রায়ই নিজেদের বিতর্কের আসরটা নিজেদেরই গড়ে তুলতে হয় – সেটা অফিসের চাপানপর্বে হোক, আর কর্মচারীদের পরিবহনের মধ্যে হোক। নামে বিতর্ক হলেও এগুলো আসলে জ্ঞানকুস্তির মতোই। ওই যে ও রকমই – 'কোন বইয়ে পাইছস?'
গল্প/ফিকশন আর অগল্প/ননফিকশনের আছরের মধ্যকার একটা বোধগম্য তুলনামূলক আলোচনা সম্ভব নয় বোধ হয়। এমনকি আছরের বেলায় বিভিন্ন বয়সের (বা বিশ্ববীক্ষার) যে গুরুত্ব, সেগুলোরও কোনো গুরুতর মিলজুল করানো যায় না। আরও কঠিন হচ্ছে একটা মেধাতালিকা বানানো যে কোন বইয়ের কী রকম গুরুত্ব (ছিল)। তারপরও কখনো কখনো বলতে হলে আমাকে নাড়া দিয়েছিল এমন কয়েকটা গল্পচরিত্রের কথা অনায়াসেই মাথায় আসে আমার। 'পথের পাঁচালী'র অপু আছেন, শ্রীকান্ত আছেন, আর আছেন 'আমি কান পেতে রই'-এর মুখ্য চরিত্র। এর মধ্যে গজেন্দ্র কুমার মিত্র আত্মস্বরে রচিত শেষের কিতাবখানার মুখ্য চরিত্রের নামটা আমার মনেও পড়ল না এখন। তিনটা ভিন্ন সময়কালে লিখিত আপাত বিভিন্ন তিনটা মানুষকে আমার এমনকি যেন বা একটাই মানুষ মনে হয়। মনে হয় একজন হাঁটতে-হাঁটতে যেন বা আরেকজন হয়ে যেতে পারেন। সেটা বোধ হয় গল্প-উপন্যাসের একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য। যদি অভিযাত্রাটা পাঠকের মনশ্চক্ষে কিছুটা ধরা পড়ে তাহলে যেন বা একজন আরেকজনের যাত্রাপথে মিশে যেতে পারেন। এই যেমন এক্ষুনি কল্পনা করলাম শ্রীকান্ত যেন হয়ে গেছেন আউটসাইডারের আর্থার। কিংবা এমনকি গল্প-উপন্যাসের সীমানা ছাপিয়ে অপু অনায়াসে হয়ে পড়েছেন মহাপ্রস্থানের পথের খোদ প্রবোধ কুমার স্যান্যালই। তারপরও যে মানুষগুলোর কথা হচ্ছে তাঁদের সকলেরই একটা গাঢ় বৈশিষ্ট্য রয়েছে –ভীষণ অন্তর্গত, গাঢ় সংবেদপূর্ণ, সামনের মানুষগুলোর সঙ্গে নিবিষ্ট সংশ্লেষকারী তাঁরা। তাঁরা কল্পচরিত্র হোন বা না হোন।
অগল্পের বইগুলোর প্রভাব এমন নয়। সেগুলো সরবরাহ করে যুক্তি, বীক্ষা আর প্রতীতী। এমন এক রাজ্যে যেখানে সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী। শাসনকাঠামোর কারিগরির জগৎ এটা। এখানে বইয়ের শাসনে মানুষ থাকেন, মানুষের শাসনে অন্য মানুষ থাকেন এবং বইয়ের উছিলায়। ধর্মগ্রন্থগুলো এর ধ্রুপদি উদাহরণ। তবে অবশ্যই নিরাপদ উদাহরণ নয়। ভয়ের পরিবেশটা কম থাকলে কিতাবের শাসনপ্রণালি বিষয়ে ধর্মগ্রন্থের ভূমিকা নিয়ে এই বক্তব্যের অনেক সমর্থনকারী পাওয়া যাবে। তবে আমার ধারণাটা এ রকম যে ঠিক সেসব লোকই আবার অন্য অনেক বইকে এই ধরনের শাসনপ্রণালির কারক বা উছিলা হিসেবে দেখতে চাইবেন না। এটা মজাদার এবং পরিহাসময় পরিস্থিতি। অধর্মগ্রন্থগুলোও যে ধর্মগ্রন্থের মতোই শাসনপ্রণালির মায়াজাল বিছায়, সেটা দেখার জন্য বইয়ের বিষয়ে যতটা নির্মোহ হওয়া দরকার, তা হওয়া অসম্ভব প্রায়। অন্তত অধিকাংশের পক্ষেই যাঁরা শিক্ষা-ডিগ্রি-চাকুরি-জ্ঞান ইত্যাদির জীবনে আছেন। নিশ্চয়ই কেউ বলবেন, 'সে তো বইয়ের প্রয়োগকারীর সমস্যা'। বটেই! কিন্তু বোমাও তো নিজে থেকে ফাটে না, প্রয়োগকারীই লাগে; তাই না?
বইকে আমি অতিমূল্যায়িত এক মনুষ্যসামগ্রী মনে করি—ওভাররেটেড। এই কথা উচ্চারণের কারণে এক্ষুনি কেউ আমার ফাঁসি চাইবেন না, সেই ভরসা আমার আছে, তবে আহাম্মকির অভিযোগ মাথা পেতে নিতে হবে। তা নিচ্ছি। বইয়ে লোকে জ্ঞানকাণ্ডের বিকাশ ঘটান। কিন্তু কাণ্ডজ্ঞানের সাথে জ্ঞানকাণ্ডের সম্পর্কটা দুর্বোধ্য ধরনের। কোনো কারণ নাই যে জ্ঞানকাণ্ডের চর্চাতে কাণ্ডজ্ঞান লুপ্ত হবে। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাস মর্মান্তিক। প্রায়ই জ্ঞানকাণ্ডারীদের কাণ্ডজ্ঞানের বহর দুর্দশাগ্রস্ত থাকে। এ নিয়ে 'অশিক্ষিত'রা প্রচুর হাসিমস্করা করেন বটে; অবশ্যই বেশির ভাগ সময়ে আড়ালে-আবডালে করেন। বইকে যে অতিমূল্যায়িত বলছি তার কারণ বোঝা খুবই সহজ। দেখুন, বইকে কী সব দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। 'মুক্তি' 'আলো' 'জীবনদর্শন' 'পথের হদিস' 'মনুষ্য পরিক্রমা' 'অন্তর্চক্ষুর বিকাশ'। তালিকাটা মোটেও ছোট নয়, চেষ্টা করলে এখনো লম্বা করা যাবে। তারপর লোকে সেগুলোকে বইয়ের পাতায় পাতায় খুঁজতে থাকেন। প্রথমত, বইয়ের এত সামর্থ্য থাকার কথা নয়। তার কাছে আপনার মস্তিষ্কও নাই, চিত্তও নাই—আক্কল কিংবা কলব। ওগুলো আপনার কাছেই। এমনকি বইয়ের কাছে নাই আপনার অভিলক্ষ্যও, নিয়ত। এসব ধনসম্পত্তি আপনার নিজের যদিওবা, বইয়ের পাতায়-পাতায় সেগুলো খুঁজতে গিয়ে আরও মৌলিক সব বিষয় হয়তো বেপথে হারিয়ে যায়। তারপর অনেক খুঁজেটুজে আপনি হয়তো 'আপনার মুক্তি'র উপায় পেলেন। বইয়ের পাতায়। মুশকিল হলো, আপনি একদম পরম শত্রু মনে করেন যে পক্ষকে, তিনিও খুঁজে পেয়েছেন 'তাঁর মুক্তি'। সেটাও বইয়েরই পাতায়।
(আদাবর, ঢাকা। ৩ মার্চ ২০২২, রাত ১.৪৮)