চুলটানা বিবিয়ানা
আজ যা নিয়ে কথা বলব, তা কার্বন-হাইড্রোজেন-নাইট্রোজেন-অক্সিজেন-সালফারের সমন্বয়। একমাথা চুল, সতেরো শতকের কবির চোখে তা প্রিয়তমার সোনালি মাথায় জড়ানো দুর্দান্ত ধাঁধা। আবার সারামুখে অস্বাভাবিকভাবে গজিয়ে গেলে মানুষের স্থান হতো উনিশ শতকীয় সার্কাসের সাইডশোতে (রাশান ডগম্যান), বিজ্ঞানীরা মাথা ঘামাতেন—এ বিবর্তনের পুনর্মূষিকায়ন (অ্যাটাভিজম) কি না।
বোদলেয়ারের আস্ত একটি কবিতা আছে প্রেয়সীর চুল নিয়ে, ওখানে স্মৃতিরা ঘুমোয়—বিবশ এশিয়া আর লেলিহান আফ্রিকা, সুগন্ধী অরণ্য—নারকেল আর কস্তুরির গন্ধে ভরপুর, ওখানে কালো সমুদ্রের ঢেউ-জাহাজ-মাস্তুল-মাল্লা স-অ-ব, ও যেন বিলুপ্তপ্রায় কোনো দূরদেশের সংকেত। ভাবছেন এর থেকে জীবনানন্দের 'চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা' তো বেশি দূরে নয়। বোদলেয়ার নাকি ঐ চুলে নিজ হাতে গেঁথে দেবেন—নীলা, মুক্তো, চুনি। নজরুলের গান মনে পড়ছে না? দেব খোঁপায় তারার ফুল...বিজলী জরীণ ফিতায় বাঁধিব মেঘ রঙ এলো চুল। সিন্ধু দাদরায় রচিত একটি গানে তিনি লিখছেন—'দুলিয়ে দিয়ো দোলন-খোঁপায়, আমের মুকুল বকুল-চাঁপা'। রবিনসন জেফার্স লিখে গেছেন, 'দীর্ঘ, সরস, কমনীয়, উজ্জ্বল তরল তোমার চুল, ঐশ্বর্যময়ী...যেন সাবধানে আঁচড়িও চুল, রাত্তিরে আর সন্ধ্যায়—ওখানে জটাজালে জড়িয়ে আমার মাতাল হৃদয়।' রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, 'ওগো বঁধু দিনের শেষে এলে তুমি কেমন বেশে—আঁচল দিয়ে শুকাব জল, মুছাব পা আকুল কেশে।' 'কমলিকা তার সুগন্ধী এলোচুলে রাজার দুই পা ঢেকে দিলে'। কেশ-সংকেত আরও আছে আমাদের কাব্যে, 'একবেণী হিয়া ছাড়ে না মলিন কাঁথা'—সুধীন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছিলেন (কোথায় পড়েছিলাম, কালীদাসের কালে এক বেণীতে বদ্ধ চুলের মানে ছিল বিরহকাল)।
সৈয়দ মুজতবা আলী 'শবনম' উপন্যাসে শুনিয়েছিলেন বিবাহরজনীতে ইরানতুরানে বাসরঘরে স্বামী নববধূর মুখের দুই কিনারে ঢেউ খেলানো অলকগুচ্ছ/জুলফ কেটে দিত, পরে চুল গজালে স্ত্রী সেই চুল কানের পেছনে ঠেলে রাখত, জুলফের অধিকার কেবল কুমারীর। শবনমের বিবাহরাত্রির কবরীবিন্যাস মনে আছে তো? 'তার চুলের বিচ্ছুরিত আলোর মাঝখানে থাকে থাকে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বচ্ছ রুপালি শামা-প্রজাপতি। মাথায় অভ্র-আবীর ছড়ানো হয়েছে অশেষ সযত্নে, এক একটি কণা করে—তিন সখী বাসর গোধূলিতে আরম্ভ করে এইমাত্র বোধ হয় কুন্তল প্রসাধন সমাপন করেছেন...তার সেই বিরাট খোঁপা জড়িয়ে একটি মোতির জাল। ঘনকৃষ্ণ কুন্তলদামের উপর স্তরে স্তরে, পাকে পাকে যেন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হিমানীকণা ঝিলিমিলি মেলা লাগিয়েছে।' মনে পড়ে বঙ্কিমবাবুর গথিক উপন্যাস 'কপালকুণ্ডলা'র নায়িকার কথা, জনশূন্য অরণ্যময় দ্বীপে নায়ক নবকুমার পিছু ফিরে দেখলেন সৈকতে এক অপূর্ব নারীমূর্তি, তার চুলের রাশি গোড়ালি অবধি দীর্ঘ, যেন চিত্রপটের মতো তার শরীর ঘিরে রেখেছে। সে জিজ্ঞেস করল—'পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ?' চুলের রকমফের রবীন্দ্রনাথ বহুবার ব্যবহার করেছেন। 'চোখের বালি'তে আশালতার চুলে বিনোদিনীর বেঁধে দেয়া খোঁপা জটিল ইঙ্গিতমুখর, 'ঘরে বাইরে'র বিমলার কেশসজ্জা রূপকে ঠাসা। যেদিন প্রথম সন্দীপের বক্তৃতা শুনে এল, বিমলার ইচ্ছা হলো 'গ্রীসের বীরাঙ্গনার মতো আমার চুল কেটে দিই ঐ বীরের হাতের ধনুকের ছিলা করবার জন্য, আমার এই আজানুলম্বিত চুল।' যেদিন সে সন্দীপকে প্রথম দুপুরবেলা খেতে নিমন্ত্রণ করল, সেদিন সকালে মাথা ঘষে সে তার ভেজা এলোচুলে জড়িয়েছিল একটি লাল রেশমের ফিতা। বিমলা ভেবেছিল—ওটা সাদাসিধে সাজ, অথচ সাজের ভেতরকার চঞ্চলিত দীপ্তি তার বিধবা জায়ের চোখ এড়ায়নি। এড়ায়নি সন্দীপের লুব্ধ চোখও, সে-ও চিনেছে—'ঐ-যে লাল ফিতেটুকু, ছোট্ট এতটুকু, রাশি রাশি ঘষা চুলের ভিতর থেকে একটুখানি দেখা যাচ্ছে, ও যে কাল-বৈশাখীর লোলুপ জিহ্বা, কামনার গোপন উদ্দীপনায় রাঙা!' একদা স্বামী নিখিলেশের আগ্রহে বিমলা মেম রেখে খোঁপা বাঁধতে শিখেছিল, ঘাড় থেকে মাথার ওপরের দিকে চুল তুলে বাঁধা খোঁপা—যাতে চুলগুলো কালো ঊর্ধ্বমুখ শিখার মতো জ্বলে ওঠে, আর ঘাড়টা মশালের ডাঁটার মতো প্রকাশ্য হয়ে পড়ে। সন্দীপের পরামর্শে বিমলা নিখিলেশকে ডেকে যেদিন বিশেষ আবদার করল—তাদের হাটেও আর বিলিতি কাপড় আসতে পারবে না, সেদিন নিখিলেশ স্পষ্ট দেখল তার স্ত্রীর গায়ে বিশেষ সাজ, আজ সে ঐ বিলিতি খোঁপার চূড়া বেঁধেছে- তার কাছে যে খোঁপা সোহাগে-আদরে অমূল্য ছিল, যা আজ সস্তা দামে বিকোবার জন্যে প্রস্তুত চুলের কুণ্ডলী। একান্ত সঙ্গিনী আজ ঋষির তপস্যাভঙ্গে প্রেরিত অপ্সরা। রবীন্দ্রনাথ চালচিত্রে বসিয়েছেন শ্রীরাধিকার গান—
'বঁধুর লাগি কেশে আমি পরব এমন ফুল/ স্বর্গে মর্তে তিন ভুবনে নাইকো যাহার মূল।'
মার্কেসের 'প্রেম ও অন্যান্য অপদেবতা' উপন্যাসের কেন্দ্রের সেই সমাহিত মেয়েটিকে ভাবুন, তার বাইশ মিটার দীর্ঘ লালচে চুল শবাধার ফেটে বের হয়ে এসেছিল।
চলুন, শিল্পের কেশবান-কেশবতীদের দেখি। মাইকেল এঞ্জেলোর মোজেজের দাড়ির সেই হিল্লোল কে ভুলতে পারে, কে ভুলতে পারে লিওনার্দোর ড্রয়িং এ চুলের বিন্যাস? প্রাচীন গ্রিসে ইরেকথিয়নের পর্চে কিছু নারীদেহ আকৃতির কলাম ব্যবহৃত হয়েছিল, এদের ডাকা হতো ক্যারিয়াটিড—মাথায় থাকত পুরো এন্টাব্লেচারের ভার; মাথার পরেই তন্বী দেহের গ্রীবা- মানবদেহের সরু অংশ, এ অংশে এসে ভার নেয়ার ক্ষমতা যেন কমে না যায়, সে জন্য এই রমণীস্তম্ভগুলোর মাথার পেছনে খোদাই করা থাকত ঘনিয়ে থাকা বিশাল কেশভার। বতিচেল্লির ভেনাস আরেক কপালকুণ্ডলা। প্রির্যাফায়ালাইট শিল্পী রসেটির পেন্টিংয়ে, আর্ট নুভোর জনক আলফন্স মুকার পোস্টারে কেশসজ্জার ছড়াছড়ি। আর্ট নুভোর একহারা মেয়েদের সেই আলুলায়িত চুলে ফুল নয় শুধু, আইভিলতা, অলংকার, এমনকি ফলমূল গাঁথা। ফ্রিদা কালোর আত্মপ্রতিকৃতিতে কখনো তাঁর চুল ছাঁটা, কখনো খোলা, কখনো বেণীবদ্ধ সেই চুলে ফুল গোঁজা, কখনো রঙিন ফিতেয় জড়ানো। হেমেন মজুমদারের স্নানসিক্তা মেয়েদের পিঠে জড়িয়ে আছে ভেজা চুল। জয়নুল আবেদিনের স্নানশেষে চুল ঝাড়া তিন নারীর একটা পেন্টিং ছিল আমাদের হলিক্রস স্কুল লাইব্রেরিতে। জানি না আজ সেই পেন্টিং কোথায় আছে।
মনে পড়ে, রূপকথার এক রানি বরফ ছাওয়া এক পড়ন্ত বেলায় জানালায় বসে ফুল তুলছিলেন সুচ-সুতোয়, সুচ ফুটে আঙুল থেকে রক্ত বেরিয়ে এল, রানি প্রার্থনা করলেন, যেন তাঁর এমন মেয়ে জন্মায়, যার ত্বক বরফের মতো ফর্সা, রক্তের মতো লাল ঠোঁট আর জানালার ঐ আবলুস কাঠের মতো কালো চুল। কন্যার নাম স্নো হোয়াইট। আরেক কন্যার নাম র্যাপুনজেল, দুর্গের জানালা দিয়ে দীর্ঘ চুল বিছিয়ে দেয় সে, চুল বেয়ে দুর্গম দুর্গে উঠে আসে প্রিয় কুমার। সত্তর-আশির দশকের ছেলেমেয়ে আমরা, খুব প্রিয় ছিল সোভিয়েত সাহিত্য—পাভেল বাঝোভের 'মালাকাইটের ঝাঁপি', সোনালি চুলো মেয়ের গল্প, জলের ধারে বসে রইলে যার চুলের আভায় জলে সোনালি রং ধরে।
চুল নিয়ে দেশে দেশে সংস্কারের অন্ত নেই। আদি রোমক রমণীরা বিয়ের রাতে জুপিটারকে চুলের গুচ্ছ উৎসর্গ করত। নবজাতকের প্রথম মাথা মুড়ানোর পর গর্ভকেশ রেখে দিলে নাকি সৌভাগ্য দেখা দিত। টাকের সঙ্গে টাকার সম্পর্ক আছে শুনতাম। তেল পড়া, চুল পড়া ইত্যাদি বহু প্রথা আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের ভেতর প্রচলিত রয়েছে। ছোটবেলায় শুনতাম—চুলের গোছা জানালা দিয়ে বাইরে ফেলতে নেই, আসরের পরে চুল খোলা রেখে বাইরে যেতে নেই। কিচ্ছা শুনতাম—নদীর ভেতর থেকে দীর্ঘ কেশগুচ্ছ বের হয়ে এসে রাতের বেলায় রজ্জু হয়ে পা চেপে ধরে, টেনে নিয়ে যায় নদীর গহ্বরে। শুনতাম, হযরতবাল দরগাহ শরিফে রক্ষিত মহানবী (সা.)-এর চুল-দাড়ি চুরির ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গে এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হবার ইতিহাস। ডাকের বচনে আছে—চিরলদাঁতী পিঙ্গল কেশ, ঘুরবে কন্যা দেশবিদেশ। ...অল্প কেশ ফুলাইয়া বান্ধে...বলে ডাক এ নারী ঘর উজাড়। হায়, শর্মিলা ঠাকুরের মৌচাকের মতো বিশাল বুফঁ দেখলে না জানি ডাক কী বলতেন, এখন সারা দুনিয়াতেই মেয়েরা অল্প কেশ ফুলাইয়া সজ্জা করেন। অবনীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন, তুষতুষলি ব্রত করতে মেয়েরা 'আসনপিঁড়ি, এলোচুল' হয়ে বসত, যেমন বসত মেক্সিকোর মেয়েরা—শস্য যেন এই এলোকেশের মতো গোছা গোছা হয় এই কামনায়। প্রিয়জনের চিহ্ন হিসেবে ইউরোপে একগুচ্ছ কেশ কেটে নেবার চল ছিল, চুলের গুচ্ছের মাধ্যমে জাদু করবার রীতি চালু ছিল মধ্যযুগে, সেই রীতির নিরিখে এর মানে হচ্ছে—যাকে মেয়েটি চুলের গুচ্ছ উপহার দিচ্ছে, সে তার ওপর জাদু খাটানোর অধিকার রাখে। আঠের শতকের কবি কাউপার চেয়েছিলেন প্রিয়া ডেলাইলার চুলগুচ্ছ। ভিক্টোরীয় আমলে মৃত প্রিয়জনের বা সন্তানের এক গোছা চুল কেটে রেখে দেবার চল ছিল, সেই চুল লকেটে-ব্রেসলেটে-ব্রুচে পুরের মতো ভরে রাখা হতো, প্রিয় মানুষের নিশানা।
দীর্ঘ সময় ধরে সাজানো কেশবিন্যাস ছাড়া প্রাচীন রোমের নারীদের ভাবা যেত না। টুটুলাস, নডি, ফ্ল্যাভিয়ান ও আঁতোয়ান সেকালের ফুলাইয়া বান্ধার নানান নমুনা। আঠের শতকের ইউরোপের বারোক এবং রকোকো পিরিয়ডের নারীরা কেশ ফুলাইয়া বান্ধার চরমে পৌঁছাল। চুলে মাড় দিয়ে পাউডার বুলিয়ে শাদা করা হতো, কেউ কেউ গোলাপি, বেগুনি বা নীল রং করতেন। ঘোড়ার চুল-উল-তার পেঁচিয়ে এমন বিশাল কেশসজ্জা করা হতো যে নারীরা সপ্তাহের পর সপ্তাহ চুল ভেজাতেন না, স্নান করতেন না। 'যেমন বেণী তেমনি রবে চুল ভেজাবো না' গোঁসাই রসরাজের পল্লীগীতিই শুধু নয়, ওটা রকোকো জমানার মূল সুর। ফরাসি বিপ্লবের পর অবশ্য সেই পাহাড় লুকানো কেশের আড় ভাঙল। ভিক্টোরিয়ান আমলে এল কপালকুণ্ডলার যুগ, অর্থাৎ অত্যন্ত দীর্ঘ চুল রাখবার প্রচলন, ১৫ বছর বয়স থেকে মেয়েদের চুল কবরীবদ্ধ। চুলের ঢেউ এবং রোল করার জন্য ব্যবহৃত হতো গাছের আঠা, হেয়ারস্প্রের যুগ আসতে তখনো ঢের দেরি। প্রথম মহাযুদ্ধের ডামাডোলে কেশবিন্যাস নিয়ে মাথা ঘামানোর ফুরসত অকল্পনীয় হয়ে উঠল। মহাযুদ্ধের পর এল ইটন ক্রপ, শার্প বব, পিক্সি কাট। ১৯২০-এর শেষাশেষি স্যালন এসে গেল মেয়েদের আওতায়, চুলের স্টাইলিং সহজলভ্য হলো।
চুল আদিবাসীদের ভেতর সামাজিক পদমর্যাদা, বীরত্ব, বয়স, বিয়ে, সন্তানধারণকাল, ধর্ম ও গোত্রের সংকেত, সে অস্ট্রেলিয়ার হোক কি আফ্রিকার কি আমেরিকার। মধ্য আফ্রিকার মাসাই এবং সাম্বুরুরা শৈশবে চুল রাখে মোরগঝুঁটির মতো, যৌবনে যোদ্ধার বেশ নেয় সে—পিঠঢাকা দীর্ঘ কেশে অসংখ্য বিনুনি করে, চুলে মাখে মেটে লাল অকার আর গবাদিপশুর চর্বি, যে যোদ্ধা সিংহ মেরেছে, সে পরে কেশরের তৈরি চুলের গয়না। মুইলা গোত্রের মানুষরা চুলে জটা পাকাতে ব্যবহার করে গোবর, কাদা আর শঙ্খচূর্ণ। সনাতনধর্মীদের মতোই মাসাই পরিবারপ্রধান পিতার মৃত্যুতে মাথা কামায়। বব মার্লি বা হুপি গোল্ডবার্গের মাথায় ড্রেডলকস বা জটা দেখি, সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতার সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে, যেমন সম্পর্ক আছে অ্যাফ্রো চিরুনির সঙ্গে কালো মানুষের স্বকীয়তার।
এ বঙ্গে ধূপের সুগন্ধী ধোঁয়ায় চুল শুকাতো মেয়েরা। খোঁপার রকমফের ছিল, হাতখোঁপা, বাগানখোঁপা, বিড়েখোঁপা, চুঁড়োখোঁপা, ঝুলন বা দোলনখোঁপা, এলোখোঁপা, ফিরিঙ্গিখোঁপা। রতন কাহারের ঝুমুর গান—বড়লোকের বিটি লো, লম্বা লম্বা চুল, এমন খোঁপা বেন্ধে দেব লাল গ্যান্দা ফুল; 'আমার সঙ্গে দেখা হবে বাবুর বাগানে' লাইনে বাবুবিলাস-বাগানবাড়ি-পতিতাপল্লিতে চালান হয়ে আসা হতভাগ্য মেয়েদের জীবনের কত সংকেত। অথচ গায়ে হলুদে এ গান গাইতাম নবীন বয়সে, আমার জেদি বন্ধু গাইত এ গানেরই কলি—যা কেনে কোথা যাবি ওরে ও যাবি, দুদিন পরে আমার ছাড়া আর কার বা হবি।
কুন্তলীন, নিদ্রাকুসুম, জবাকুসুম আর লক্ষ্মীবিলাস—ওসব কেশতৈল আমরা নামেই চিনি। কেয়ো কার্পিনের ফিকে জলপাই সবুজ তেল নিউমার্কেটে পাওয়া যেত। বাড়িতে আসত রিগার্ডের হাঁসমার্কা নারকেল তেলের সবুজ কাচের শিশি, আসত তেজগাঁওয়ের 'জাগরণী'র নারকেল-পেষা খাঁটি তেল, শীতকালে রোদে দিয়ে গলাতে হতো। কাচের ছোট্ট জারে বাসন্তী রঙের তিব্বত পমেড—চুলের যত্নেও নাকি চমৎকার। 'এপি পনেরো' কেশতেলের বিজ্ঞাপনে একটা ছোট্ট অ্যানিমেশন ছিল, চুল পড়ছে বলে রাজকন্যা কাঁদছে, এপি পনেরো মাখছে, অতঃপর সখীরা তিনজন মিলে কন্যার দীর্ঘ কেশ পিছু পিছু বয়ে নিয়ে চলেছে। জিঙ্গেলটা আমার এখনো মনে আছে—রূপবতী সখী তোরে কেশবতী করে দেবে এপি পনেরো কেশতেল। চুলের যত্নে চলত জবার কলি-একাঙ্গী-সোন্দামূল তেলে জারিয়ে রাখা, চলত মহাভৃঙ্গরাজ বা কেশুতপাতা। শ্যাম্পু করলে যদি চুল পড়ে যায় সেই ভয়ে চলত সরিষার খৈল আর ভিজিয়ে রাখা রিঠা দিয়ে চুল ধোয়া। লোকে মাথা ঘামাত—রিকশাওয়ালাদের টাক পড়ে না—কাজের বুয়াদের মাথা ভরা চুল, তবে কি গভীর চিন্তাভাবনার সঙ্গে চুল পড়ার সম্পর্ক আছে? নাকি কায়িক শ্রমের সঙ্গে চুলের সম্পর্ক আছে?
চুল নিজেই কেবল শোভা নয়, শিরশোভা হিসেবে দেশে দেশে চল রয়েছে চুলের গয়নার। খোঁপায় গোঁজার চিরুনি পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো, অ্যাফ্রো চিরুনির বয়স ছয় হাজার বছর। চুলের পিন বা কাঁটার ইতিহাস আরও পুরোনো, যিশুর জন্মের ত্রিশ হাজার বছর আগেও এর চল ছিল। উইলেনডর্ফের আদি ভেনাস বা নিওলিথিক ভেনাসের চুলেও ছিল পুঁতি-গাঁথা বিন্যাস। অজন্তার গুহায় ফ্রেস্কোর নারীদের চুলে কত না অলংকার। ডায়াডেম আর মুকুট পরত প্রাচীন গ্রিস ও রোমের রাজপরিবার। রেনেসাঁ আমলের অভিজাত নারীরা পরতেন সোনা-হাতির দাঁত-কচ্ছপখোলার কাঁটা। টিয়ারা এল আঠারো শতকে। ভিক্টোরীয় এবং জর্জীয় আমলে ফ্যাশন হলো দুর্মূল্য হিরে-জহরতখচিত বারেট বা হেয়ারক্লিপের। মুঘল নারীরা পরতেন ঝাপটা-পাশা-ঝুমর, টিকা, টায়রা, সিঁথিপাটি, মাথাপাটি। দক্ষিণ ভারতীয় দেবদাসীরা চুলের বেণীতে পরতেন জাদুনাগম-নাগিনীর মতো অলংকার, নববধূ ও নৃত্যশিল্পীরা এখনো পরেন। রাজস্থানী মহিলারা পরেন রাজপুতি বোরলা, মহারাষ্ট্রের নববধূ পরেন মান্ডোরিয়া, বাংলাদেশের নববধূ পরেন টিকলি ও টায়রা। উদ্দেশ্য কপালের/অদৃষ্টের ওপর কুদৃষ্টি এড়ানো। একসময় পুরান ঢাকার মোষের হাড়ের চিরুনি বা কাঁকই ছিল প্রসিদ্ধ। এখনো আমরা চুলে কত কী পরি, রুপার ঝুনঝুনি দেয়া খোঁপার কাঁটা, ডোকরার কাঁটা, খোঁপায় গুঁজবার চিরুনি।
বেশি দিন আগের কথা নয়, কনে দেখতে গিয়ে বাড়ির মহিলারা মেয়েটিকে চুল খুলতে বলতেন, ঘরে বানানো কালো দড়ি আর ফিতে দিয়ে বেশ ফুলিয়ে কবরী রচনা করার প্রচলন ছিল বলে ওঁরা চুল খুলিয়ে দেখতেন আসল চুল কতখানি। আমার এক দূরসম্পর্কের নানিকে মামার জন্য কনে খুঁজতে গিয়ে বলতে শুনেছিলাম—দেখি তো মা, ঘোমটা খোলো দেখি, নানির চুল পিন্দা আইছ নাকি নিজের চুল। ভাবা হতো চুলের সঙ্গে উর্বরতার সম্পর্ক জবরদস্ত। চুল বড় প্রগলভ, প্রেমিকের চোখে—কবির চোখেই শুধু নয়, ডাক্তারের চোখে, ফরেনসিক চোখে। চুল বলে দেয় কার অ্যান্টি মুলেরিয়ান হরমোন কতটুকু—কার কর্টিসলের মাত্রা কত, কে হাইপোথাইরয়েডিজমে ভুগছে, কার পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোম আছে। ফরেনসিক অ্যানালিসিসেও চুল বাঙ্ময়—বলে দেয় লাশ কার, সে কোন জাতের, কোন গোত্রের, কোন লিঙ্গের, কোন বিষক্রিয়া ঘটেছে তার শরীরে, কেশমূল থেকে ডিএনএর তথ্য পাওয়া যায়।
চুল বড় চপলা। মুরাসাকি শিকিবুর উপন্যাসে দেখা যায়—তখনকার অবরোধবাসী জাপানে পর্দাপ্রথার কড়াকড়ি ছিল, জাপানি নারীর চুলের আভাস পুরুষকে ভীষণ যৌন ইন্ধন জোগাত। ঘোমটার চল ছিল প্রাচীন রোমেও, মার্জিত নারীকে পাতলা কাপড়ে বা কারুকার্যময় ব্রোকেডে চুল ঢাকতেই হবে, পরে মধ্যযুগ এবং রেনেসাঁ আমলেও এই চল দেখা যায়। ইতালীয় রেনেসাঁ পেইন্টিংয়ে নারীর চুল খোলা বা বেণীবদ্ধ—তাতে কপাল-ঢাকা ঘোমটা। ইংল্যান্ডে টিউডর আমলে নারীরা সর্বদা মাথা ঢেকে রাখত। রাজা অষ্টম হেনরির প্রথম স্ত্রী ক্যাথরিনের যুগে সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়েরা পুরো মাথা গেবল হুডের কড়া ভাঁজের কাপড়ে আর মখমলে ঢেকে নিত, অ্যান বোলিন (রাজার পরবর্তী স্ত্রী) হেনরির চোখে পড়েছিলেন মাথার ফরাসি হুডের কারণে—যে ঘোমটায় কপাল আর সিঁথি দেখা যেত। অ্যানের মৃত্যুদণ্ডের পর রাজার তৃতীয় স্ত্রী হলেন লাজুকলতা জেন সিমোর, ফিরিয়ে আনলেন কড়া ঘোমটার গেবল, জেনের মৃত্যুর পর ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি আবার ফিরে এল ফ্রেঞ্চ হুড, তদ্দিনে কপাল-চুলের বেশ খানিকটা দেখানোর ফ্যাশন জনপ্রিয় হয়েছে। অর্থোডক্স ইহুদি মেয়েরা বিশ্বাস করে, সজীব চুল দেখবার অধিকার কেবল স্বামীর, নির্জীব চুল জগত দেখতে পারে, তাই তারা পরচুলা এবং স্কার্ফ পরে। মুসলিম বিশ্বে হিজাব-নেকাব প্রচলিত। খ্রিষ্টান মেয়েরা এখনো বহু দেশে এবং সংস্কৃতিতে মাথা ও চুল আবৃত রাখেন, ইস্টার্ন ক্রিশ্চিয়ানিটির চার্চে এবং অর্থোডক্স ক্রিশ্চিয়ানদের ভেতর মেয়েদের মাথা আবৃত রাখার চল রয়েছে। শুধু যে যুদাইজম, ক্রিশ্চিয়ানিটি এবং ইসলামে হাজার বছর ধরে মার্জিত এবং ধার্মিক নারীর মাথা আচ্ছাদনের কথা বলা হয়েছে, তা-ই নয়, সেকুলার রীতিরেওয়াজেও এর উল্লেখ রয়েছে—এই যেমন প্রাচীন মেসোপটেমীয়, গ্রিক এবং পার্সিয়ান রাজত্বে সম্ভ্রান্ত নারীর আবৃতমস্তকে থাকবার রীতি ছিল। এসব ঘোমটা সাধারণত সুতি বা লিনেনের হতো, ধনী পরিবারের নারীরা সিল্ক ও মখমলের ঘোমটা দিত।
চুল নিয়ে পুরুষের বেলায়ও বিধিনিষেধ কম নেই। পুরুষের বাবরি চুল রাখতে নাকি ইসলামে নিষেধ নেই, যেমন নেই যুদাইজমে, যদিও ধর্মভীরু ইহুদিরা পুরুষের চুল লম্বা রাখা পছন্দ করে না। এমনকি বহু ধার্মিক খ্রিষ্টান একালেও বিশ্বাস করে, পুরুষ দীর্ঘ কেশ রাখলে পাপ হয়।
এবার আসি কেশরঞ্জনীর প্রসঙ্গে। খ্রিষ্টপূর্ব ২১৭৭-তে এসিরীয়দের কিছু পাকপ্রণালিতে কেশরঞ্জক তৈরির ইতিহাস পাওয়া যায়। এবার্স প্যাপিরাস নামের প্রাচীন মিসরীয় পুস্তকে পাওয়া যায় ভ্রু আর কেশ রঞ্জনের উপায়। ষাট-সত্তরের দশকে চুলে রং করার ফ্যাশন বেদম বেগে শুরু হয়, চেহারা রৌদ্রচুম্বিত দেখাবার জন্য হাইলাইট আর ফ্রস্টিং চালু হয়, ব্লিচ ব্লন্ড এবং নিয়ন হেয়ার জনপ্রিয় হয় পাংকদের ভেতর। কেশরঞ্জনে সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের কেউ টেক্কা দিতে পারবে না। ব্লন্ড হিসেবে চিরপরিচিতা মেরিলিন মনরোর সোনালি চুল ডাই করা, লালচুলো হিসেবে চিরপরিচিতা নায়িকা রিটা হেওয়ার্থের কালো চুল লাল ডাই করা। চুলের আসল রং বদলে ব্লন্ড হয়েছিলেন এমন নায়িকাদের ভেতর আছেন ম্যারিয়ন ডেভিস, জোন ক্রফোর্ড, ক্যারল লোমবার্ড, বেটি গার্বল এমনকি গ্রেটা গার্বোও। ডরোথি মেলন আর এলেনর পার্কার উভয়েই চুল ব্লন্ড করার পর থেকে সিনেমার দুষ্টা স্ত্রীলোকের রোল করতে শুরু করেছিলেন, ক্যারিয়ারের পালে হাওয়া লেগেছিল। উল্টোটা ঘটেছিল জোন বেনেটের বেলায়, চুল সোনালি থেকে ব্রাউন করেছিলেন—ক্যারিয়ার বদলেছিল।
ব্লন্ড বা সোনালিচুলোদের বুদ্ধিহীনতা নিয়ে অনেক বাজে জোক আছে, এখানে বলা হলো না। চুলের ডাই নিয়ে পুরোনো আনন্দমেলায় একটা দুর্দান্ত ছোট গল্প পড়েছিলাম। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের একটি যুবক কেমিস্ট হতে চেয়েছিল, ভাগ্যক্রমে তাকে পারিবারিক ব্যবসায় তথা সেলুনে চুল ছাঁটবার কাজ নিতে হয়। একদিন সন্ধ্যায় দোকান বন্ধ করার সময় এক খদ্দের এসে উপস্থিত। সে চুল ছাঁটবে এবং রং করাবে। খদ্দেরের চেহারা দেখে যুবকের সন্দেহ হয়। কয়দিন ধরেই রেডিওতে ফেরারি আসামির বর্ণনা শুনছিল যুবক, খুনির বাঁ হাতের মধ্যমা তর্জনীর চেয়ে ছোট। চুল কাটবার জন্য সে লোকটার গায়ে চাদর মুড়ে দিয়েছে, হাতের আঙুল খেয়াল করবে কী করে! যুবক খদ্দেরের চুল ভিজিয়ে কাটতে শুরু করে, ইচ্ছে করে কিছু কাটা চুল খদ্দেরের বাঁ কানে লেপ্টে রেখে পিছু ঘোরে। নাপিতের ঘরজোড়া আয়নায় যুবক দেখতে পায় খদ্দের কানে লেপ্টানো ভেজা চুল ফেলে দিল, লোকটার মধ্যমা খাটো। ভয়ে গা শিরশির করে ওঠে তার। কিন্তু সাহস হারালে চলবে কেন। মনোযোগ দিয়ে সে চুল ছাঁটে, ডাই করে। খদ্দের পয়সা চুকিয়ে দিয়ে চলে গেলে যুবক পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ আসামিকে সহজেই খুঁজে পায়; কারণ, কেমিস্ট হতে চাওয়া যুবক এমন কায়দায় লোকটার চুল ডাই করে দিয়েছিল যে আধঘণ্টার ভেতর লোকটার চুলের রং সবুজ হয়ে যায়।
কপালে চুলের ঘের নিয়েও কত জ্বালা। হলিউডে কলম্বিয়া পিকচার্সের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হবার পর রিটা হেওয়ার্থকে একটি দীর্ঘ যন্ত্রণাদায়ক ইলেকট্রোলাইসিসের অধ্যায় সইতে হয়েছিল, রিটার শ্বেতাঙ্গিনী চেহারা তৈরির জন্য তাঁর চুলে ঘেরা 'হিস্পানিক কপাল'কে শুধরে কেশমূল চিরতরে উৎপাটন করে কপাল আয়ত করা হয়। 'ডক্টর জিভাগো'তে অভিনয় করবার সময় চরিত্রের প্রয়োজনে ওমর শরীফের ছোট্ট 'আরবী কপাল' থেকে ওয়াক্সিং করে চুল তুলে রুশী কপাল করে নিয়েছিলেন ডেভিড লিন। তবে রিটার বদলটা স্থায়ী। উৎপাটনের বিপরীতে বপন, হেয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্ট/গ্রাফটিংয়ের পন্থা এসেছে এখন, অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে করা হয়, হেয়ার সার্জনরা নাকি একটি চুল বুনতে আট ডলার করে নেন।
পর্দায় যাদের বুদ্ধিমত্তা আমাদের চমকে দেয়, তার কেরদানি স্ক্রিনপ্লে রাইটার-পরিচালকের। পর্দায় যাদের সুন্দর স্বাস্থ্যের দীপ্তি আর একমাথা চুল আমাদের বিস্মিত করে, তাদের রূপরক্ষা-স্বাস্থ্যরক্ষার কঠিন নিয়মানুবর্তিতার পাশাপাশি একটি জাদুকরী বস্তু আছে, তার নাম পরচুলা। পরচুলার রকমফের অনেক-লেসফ্রন্ট, হিউম্যান হেয়ার, সিন্থেটিক। অভিনেতারা ছাড়াও আদালতে পরচুলা পরেন ব্যারিস্টাররা, এ ক্ষেত্রে পরচুলা পরাটা শুধু সপ্তদশ শতক থেকে চলে আসা রীতিই নয়, পরচুলা ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের প্রকাশ, এজলাসে চাক্ষুষ পার্থক্য সৃষ্টির উপকরণ। আগে ঘোড়ার চুলে বোনা কাঁধঢাকা পরচুলা পরার রেওয়াজ ছিল, এখন পরা হয় বব-গোছের পরচুলা, হেম্প দিয়ে বোনা ভিগান পরচুলাও পাওয়া যায়।
পুরোনো সোনালি হলিউডের স্টারদের মধ্যে জন ওয়েইন, জিমি স্টুয়ার্ট, ফ্রেড অস্টেয়ার, ডেভিড নিভেন, হামফ্রে বোগার্ট, বার্ট ল্যাংক্যাস্টার, পিটার কুশিং পরচুলা এবং আংশিক-পরচুলা বা 'টুপেয়' পরতেন। ক্রিস্টোফার লি পর্দায় এবং পর্দার বাইরে সর্বত্র পরতেন পরচুলা। ইউল ব্রাইনার চির টেকো, চরিত্রের প্রয়োজনে কখনো পরচুলা পরেছেন নতুবা সব সময় টাকমাথা নিয়েই অভিনয় করেছেন। জন ট্রাভোল্টা, শন কনোরি, জুড ল, ড্যানিয়েল ক্রেগ পরচুলা পরেন। ডলি পার্টন, র্যাকেল ওয়েলচ থেকে টায়রা ব্যাংক্স, নায়োমি ক্যাম্পবেল, কিরা নাইটলি কে পরেন না পরচুলা! কেটি প্রাইস, কিম কারদাশিয়ান হেয়ার এক্সটেনশন ছাড়া কাউকে দর্শন দেন না। জেনিফার লোপেজের বাড়িতে নাকি একটি কামরা বোঝাই পরচুলা এবং হেয়ারপিস। গায়ক-গায়িকারাও পিছিয়ে নেই—এল্টন জন, লেডি গাগা, কেটি পেরি, ভিক্টোরিয়া বেকহাম কিংবা রিহানা।
বলিউডে 'পাকিজা'র নায়ক রাজকুমার চিরদিন পরচুলা পরেছেন। একবার তিনি মালা সিনহাকে বলেছিলেন তাঁর হোটেলের সুইমিংপুলে এসে সাঁতার কাটতে, মালা সিনহা কড়া জবাব দিয়েছিলেন—পুলে রাজকুমারের পরচুলা যখন ভেসে যাবে, তখন কী হবে! শর্মিলা ঠাকুরের সঙ্গে একই গাড়িতে কোথাও যাচ্ছিলেন রাজকুমার, সারা পথ তিনি জানালা খুলতে দেননি যদি বাতাসে পরচুলা উড়ে যায়, যদিও সেই পরচুলা রাজকুমারের মাথায় স্কার্ফ দিয়ে বাঁধা। অমিতাভ বচ্চন আশির দশকে 'কুলী' সিনেমার সময় থেকে আধটেকো, তখন থেকেই পরচুলা পরতেন। ফিরোজ খান, রাকেশ রোশন, সানি দেওল, অক্ষয় খান্না, জন আব্রাহাম, সঞ্জয় দত্ত, আদিত্য পাঞ্চোলি, বিবেক ওবেরয়, হালের রনবীর কাপুর... বলিউড অন্তহীন পরচুলার রাজত্ব। শোনা যায়, নায়ক ঋত্বিক রোশন প্লেটলেট রিচ প্লাজমা ট্রিটমেন্ট নেন, মাথায় মিনোক্সিডিল মাখেন, ওঁরটা পরচুলা নাকি গ্রাফটিং এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
রাজ্জাক, ববিতা, নূতন, অঞ্জু, সোহেল রানা, রুবেল, আনোয়ার হোসেন—ছায়াছন্দে যাঁকেই দেখতাম, তাঁরই মাথায় পরচুলা! 'উন্মাদ পত্রিকায়' একবার কার্টুন এল—জাম্বুর মনে দুঃখ এই যে তাঁর স্ত্রী তাঁর চকচকে টাকটাকে প্রায়ই হাত-আয়না হিসেবে ব্যবহার করেন। পরচুলা তৈরি এখন বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে কুটিরশিল্পের আকার নিয়েছে।
চুলের গল্প আসলে র্যাপুনজেলের কেশের চেয়ে দীর্ঘ। মিনিয়েচারশিল্পীর এক-বাল তুলি কিংবা সেবল ব্রাশের সূক্ষ্ম তুলিমুখ তৈরিতে যে রোমশ প্রাণীরা জীবন দিল, আজও যত প্রাণী ফারট্রেডিংয়ে খুন হয়, সেসব অবধি গল্প গড়িয়ে যেতে পারে। মুক্তিযুদ্ধে যত শহীদ-বীরাঙ্গনার দীর্ঘ চুল পাকিস্তানি আর্মি সিলিং-ফ্যানের সঙ্গে বেঁধে ঝুলিয়েছিল, তাঁদের স্মৃতির উদ্দেশে এইখানে চুপ করলাম, বাকিটা লেখা আছে অশ্রুজলে।