রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বৈঠক: প্রস্তুত ঘুমধুম মৈত্রী সেতু ও টেকনাফের কেরুণতলী
মিয়ানমারের সদিচ্ছায় ২২ আগস্ট থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হতে যাচ্ছে। এদিন ৩ হাজার ৫৪০ রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে স্থল ও নৌপথে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করছে মিয়ানমার সরকার। গত জুলাইতে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব ইউ মিন্ট থু'র নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের একটি ডেলিগেশনের উখিয়ায় কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনের পর, প্রত্যাবাসনের দৃশ্যত প্রস্তুতি গ্রহণ করে দেশটি।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রত্যাবাসন-প্রক্রিয়া সহজ করতে চট্টগ্রাম বিভাগীয় অতিরিক্ত কমিশনার নুরুল আলম নেজামীর নেতৃত্বে রোববার দুপুরে প্রত্যাবাসন টাক্সফোর্সের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম, কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামাল হোসেন, জেলা পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন, অতিরিক্তি আরআরসি শামসুদৌজা নয়ন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এসএম সরওয়ার কামালসহ সেনাবাহিনী ও জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরএর প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে করণীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠকটির বিষয়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় অতিরিক্ত কমিশনার নুরুল আলম নেজামী জানান, “রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে বাংলাদেশ প্রস্তুত রয়েছে। আগামী বৃহস্পতিবারের প্রত্যাবাসন নিয়ে আমরা ইতোমধ্যে প্রস্তুতি শেষ করেছি। এখন শেষ পর্যায়ের কাজ চলছে। সব ঠিক থাকলে এ কার্যক্রম আরও বাড়ানো হতে পারে।”
সূত্র জানায়, উখিয়া-টেকনাফে ৩০টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এগারো লাখের বেশি রোহিঙ্গার বসবাস। ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গারা প্রাণরক্ষার্থে মিয়ামারের রাখাইন রাজ্য ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। শরণার্থী রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে প্রক্রিয়া শুরুর চেষ্টা চালানো হচ্ছিল শুরু থেকেই। কিন্তু তাতে সাফল্য আসেনি।
গত জুলাইয়ে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব ইউ মিন্ট থু'র নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের ডেলিগেশন টিম উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্প পরিদর্শন করে শরণার্থী রোহিঙ্গাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন। টিমের সদস্যরা দু’দিনে কয়েক দফায় ক্যাম্পগুলোতে মুসলিম, হিন্দু ও খ্রিস্টান রোহিঙ্গাদের সঙ্গে পৃথক পৃথক আলোচনায় অংশ নিয়ে তাদের ফেরত যেতে অনুরোধ করেন।
সে সময় সফরকারী টিমের সঙ্গে যুক্ত হন আসিয়ানের ৫ সদস্যর প্রতিনিধিদল। রাখাইনে রোহিঙ্গারা ফিরে কী কী সুবিধা ভোগ করবেন, জীবন -জীবিকা কীভাবে নির্বাহ করবেন, সেখানে অন্যান্য অবস্থার কী পরিবর্তন হয়েছে, যোগাযোগ, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ নানা বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কী কী পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে সেসব বিস্তারিত তুলে ধরেন ডেলিগেশন টিম। এ-সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের লিফলেটও বিতরণ করা হয় শরণার্থীদের মাঝে।
ডেলিগেশন টিম ফিরে যাবার পরই বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে তোড়জোড় শুরু করেছে মিয়ানমার।
এদিকে, নিজ দেশে ফিরে যেতে অধীর আগ্রহী অধিকাংশ রোহিঙ্গা শরণার্থী। ইতোমধ্যে বেশ কজন রোহিঙ্গা নিজেদের উদ্যেগে রাখাইনে ফিরেও গেছেন। কিন্তু ক্যাম্পগুলোতে প্রত্যাবাসনবিরোধী উগ্রপন্থী ও উস্কানিদাতাদের নিবৃত্ত করা সম্ভব না হলে প্রত্যাবাসন-প্রক্রিয়া ফের হোঁচট খাওয়ার শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
রোহিঙ্গা নেতা সৈয়দুল আমিন অবশ্য আশাবাদ ব্যক্ত করলেন। তাঁর মতে, মিয়ানমার টিমের সঙ্গে আলোচনায় রোহিঙ্গা শরণার্থীরা জন্মভূমিতে ফেরার ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। এর সফলতা অতি শিগগির পাওয়া যাবে।
কুতুপালং ২নং ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা এবং এআরএস পিএইচ (আরকান রোহিঙ্গা ফর সোসাইটি হিউম্যা রাইট্স)এর সভাপতি মহিবুল্লাহ বললেন, “রোহিঙ্গাদের মৌলিক অধিকার পূরণ হলে একজন রোহিঙ্গাও বাংলাদেশে থাকবে না। স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফিরে যাবে।”
তবে সেখানকার নাগরিকত্ব দিয়ে, রোহিঙ্গা মুসলমান হিসেবে তাদের গ্রহণ করতে হবে বলে দাবি তাঁর।
বালুখালী ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা জবর মুল্লুক অবশ্য একটি আশঙ্কার কথা জানালেন। তিনি বললেন, “বর্ডার খোলা ফেলে যেভাবে এসেছি সেভাবে রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে আগ্রহী। কিন্তু জানমালের নিরাপত্তার অভাবে কেউ মুখ খুলে বলতে পারছে না। কারণ ইতোপূর্বে রাখাইনে ফিরে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করায় বেশ কজন রোহিঙ্গা নেতা হত্যার শিকার হয়েছেন।”
বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প ৯ এর মাঝি মুছা আলী ও নুরুল আমিন আশাবাদী সুরে বললেন, “মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আগ্রহী হওয়ায় আমরা খুশি। নিজ দেশে গিয়ে বসতি গড়ার মজাই আলাদা।”
থাইংখালী ক্যাম্পের হাফেজ আমির হোসেন শরণার্থী অবস্থার নানা সমস্যার কথা ব্যক্ত করলেন এভাবে—“রাখাইনে যারা দেশান্তরিত হতে কাজ করেছিল, তারাই ক্যাম্পগুলোতে নানা নির্যাতন-জুলুম করছে। ক্যাম্পে ছেলেমেয়েরা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, নারীদের কোনো ইজ্জত নেই। জিম্মিদশায় প্রতিনিয়ত নারীদের সম্ভ্রমহানি হচ্ছে। তাই অধিকাংশ রোহিঙ্গা যে কোনো ভাবেই হোক, রাখাইনে ফিরে যেতে আগ্রহী।”
কুতুপালং ক্যাম্পের রোহিঙ্গা মোহাম্মদ ইলিয়াছ ও নূর মোহাম্মদ প্রত্যাবাসনোন্মুখ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি হুমকি প্রসঙ্গে বললেন, “ফিরে যেতে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেকে হুমকি পেয়েছেন। খুন-গুমের শিকার হয়েছেন অনেকে। তারপরও সব হুমকি উপেক্ষা করে নিজ উদ্যেগে অনেক রোহিঙ্গা গোপনে রাখাইনে ফিরে যাচ্ছেন।”
ক্যাম্পগুলোতে সন্ত্রাসীদের অত্যাচারে অতীষ্ঠ হয়ে ৯ আগস্ট ২১ জন রোহিঙ্গা নারী, শিশু, পুরুষ মিয়ানমার ফিরে গেছেন বলে দাবি তাদের।
তবে অধিকাংশ রোহিঙ্গা শরণার্থী মনে করেন, মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে তাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি এবং তাদের উপর সংঘটিত নির্যাতনের বিচারের নিশ্চয়তা না পেলে রাখাইনে ফিরে গিয়ে লাভ নেই। তাই ২২ আগস্টের প্রচেষ্টাও ফলপ্রসূ হবে কি না এ নিয়ে সন্দেহ রয়েছে অনেকের মনে।
এর কারণও রয়েছে। ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে ব্যাপক প্রস্ততি থাকা সত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো যায়নি। সে সময় বেশ কিছু দেশি-বিদেশি এনজিওর গোপন ষড়যন্ত্র ও উস্কানি প্রদান এবং সন্ত্রাসী দলভুক্ত রোহিঙ্গাদের বাধার কথা সামনে এসেছিল। ফলে প্রত্যাবাসন-প্রক্রিয়াটি তখন পণ্ড হয়ে যায়।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালামের সুরে অবশ্য আশাবাদ। তিনি বললেন, “মিয়ানমার নিয়মিত তাদের নাগরিক রোহিঙ্গাদের যাচাইকৃত তালিকা দিচ্ছে। সম্প্রতি ছাড়পত্র দেওয়া ৩ হাজার ৪৫০ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে যাচ্ছে মিয়ানমার। সব ঠিক থাকলে সীমান্তের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম মৈত্রী সেতু ও টেকনাফের নাফ নদীর কেরুণতলীর প্রত্যাবাসন ঘাট দিয়ে ওই রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যাবেন।”
রোহিঙ্গাদের জন্য একটি কাঠের সেতু এবং সেমি পাকা ৩৩টি ঘরও নির্মাণ করা হয়েছে বলে জানান তিনি। সে সঙ্গে ৪টি শৌচাগার নির্মিত হয়েছে। এসবের দেখভালের জন্য ১৬ আনসার ব্যাটালিয়নের সদস্যরা দায়িত্ব পালন করবেন।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামাল হোসেন সরকারি পদক্ষেপের বিষয়ে আবারও দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করে জানালেন, “রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন রোববারে অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর, ২২ আগস্ট রোহিঙ্গাদের একাংশকে রাখাইনে ফিরিয়ে দেবার বিষয়ে আমরা ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনা পালন করতে আমরা সবসময় প্রস্তুত।”