অবসরের পর শারাপোভার খোলাচিঠি
বুধবার টেনিস থেকে বিদায়ের ঘোষণা দিয়েছেন রুশ সুন্দরী মারিয়া শারাপোভা। ৩২ বছর বয়সী, পাঁচবারের গ্র্যান্ডস্লাম বিজয়ী, টেনিসের সাবেক এই নাম্বার ওয়ান এক দীর্ঘ চিঠিতে প্রকাশ করেছেন বিদায়ের অনুভূতি।
ভ্যানিটি ফেয়ারের সৌজন্য চলুন সেটির পাঠ নেওয়া যাক:
মারিয়া শারাপোভার বিদায়ী চিঠি
যে পরিচয়ে সবাই আপনাকে চেনে, কি করে সেটিকে পেছনে ফেলে যাবেন? সেই ছোটবেলা থেকে যেখানে আপনি প্রশিক্ষণ নিয়ে আসছেন, যেটি আপনাকে অনুক্ত অশ্রু ও অব্যক্ত আনন্দ দিয়েছে, সেই কোর্ট ফেলে কি করে দেবেন হাঁটা? যে খেলা আপনাকে ২৮ বছরেরও বেশিকাল ধরে দিয়েছে পরিবার, দিয়েছে অসংখ্য ভক্ত, কী করে সেটি ছেড়ে দেবেন, বলুন?
এই অনুভূতি আমার কাছে একেবারেই নতুন, তাই ক্ষমা করুন আমাকে। টেনিস, তোমাকে আমি জানাচ্ছি বিদায়!
শেষ টানার আগে, চলুন শুরুর গল্পে ফেরা যাক একবার। জীবনে প্রথম কোনো টেনিস কোর্ট আমি দেখেছি চার বছর বয়সে, রাশিয়ার সোচিতে। বাবা খেলছিলেন। বেঞ্চে বসে নিজের ছোট দুটি পা দোলাচ্ছিলাম আমি। এতই ছোট ছিলাম, পাশে থাকা র্যাকেটটি ধরতে গিয়ে দেখি সেটি আমার চেয়ে দ্বিগুণ।
আমার যখন ছয় বছর বয়স, বাবার সঙ্গে আমেরিকার ফ্লোরিডায় এলাম। তখন পুরো দুনিয়াকেই আমার কাছে লাগছিল মস্ত বড়। বিমান, বিমানবন্দর, আমেরিকার ব্যাপ্তি: সবকিছুই ছিল প্রকাণ্ড; আমার বাবা-মার আত্মত্যাগও।
যখন খেলতে শুরু করি, নেটের ওপাশে থাকা মেয়েগুলো ছিল আমার চেয়ে বয়সে, উচ্চতায়, শক্তিতে বড়। যে টেনিস তারকাদের খেলা টিভিতে দেখতাম, মনে হতো, কোনোদিনও তাদের ধারে-কাছে পৌঁছতে পারব না। তবে ধীরে ধীরে, কোর্টে প্রতিদিন প্র্যাকটিস করতে করতে, এই একেবারেই উপকথাতুল্য দুনিয়াটি আমার কাছে বাস্তব থেকে আরও বেশি বাস্তব হয়ে উঠল।
প্রথমদিকে যে কোর্টগুলোতে খেলতাম, ওগুলো অত মসৃণ ছিল না। এক সময় সেগুলো কর্দমাক্ত হয়ে যেত; প্রতিটি পদক্ষেপেই পায়ের নিচের ঘাসগুলো আরও বেশি সুন্দর, আরও বেশি মসৃণ হয়ে ওঠত। তবু নিজের একেবারেই আকাশ-কুসুম কল্পনায়ও কোনোদিন ভাবিনি টেনিসের সবচেয়ে বড় পর্যায়গুলোতে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই এত বড় সাফল্য পাব।
উইম্বলডনকে আমার কাছে যাত্রা শুরুর একটা ভালো মাধ্যম বলে মনে হয়েছিল। তখন আমি ১৭ বছর বয়সী এক আনাড়ি কিশোরী, তখনো শখ করে ডাক-টিকেট সংগ্রহ করি; সেই বয়সে জয়ের মাহাত্ম্য আমি বুঝতেই পারিনি। ভাগ্যিস, বুঝতে পারিনি!
অন্য খেলোয়াড়দের ওপর ছড়ি ঘোরানোর মানসিকতা আমার কখনোই ছিল না। মনে হয়েছিল যেন খাঁড়া কোনো পাহাড়ের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছি। কী করে পাহাড় টপকাতে হয়, সেটি শেখার জন্যই নিরন্তর কোর্টে ফিরে এসেছি আমি।
বিক্ষিপ্ততা ও প্রত্যাশার চাপ কিভাবে পেরিয়ে আসতে হয়, আমাকে সেটি ইউএস ওপেন দেখিয়েছে। নিউইয়র্কের তোলপাড় যদি আপনি সামলাতে না পারেন, তাহলে হাতের কাছেই বিমানবন্দর আছে, উঠে পড়ুন বিমানে! 'দসভিদানিয়া' (শুভ বিদায়)!
অস্ট্রেলিয়ান ওপেন আমাকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে, যেটির অভিজ্ঞতা আগে ছিল না। এটি আমাকে এক চূড়ান্ত রকমের আত্মবিশ্বাস এনে দিয়েছে, যেটিকে অনেক লোক 'নিজের জায়গা' হিসেবে অনুভব করে। আমার পক্ষে এটি ব্যাখ্যা করে সম্ভব নয়; তবে নিশ্চিতভাবেই এ এক দারুণ জায়গা।
একজন নবীন খেলোয়াড় হিসেবে আমার সব দুর্বলতা দৃশ্যতই ফাঁস করে দিয়ে, আমাকে সেগুলো পেরিয়ে আসার শক্তি জোগাতে সাহায্য করেছে ফ্রেঞ্চ ওপেনের ক্লে-কোর্ট। দুবার আমি সেটা পেরেছি। ব্যাপারটা খারাপ নয়!
এই কোর্টগুলো আমার সত্যকারের নির্যাসটিকে বাইরে বের করে এনেছে। ফটো শুট ও আকর্ষণীয় টেনিস ড্রেসের বাইরে, এগুলো আমার খুঁত, আমার তড়পানো, আমার ঘামের প্রতিটি ফোঁটা প্রকাশ করে দিয়েছে। আমার বৈশিষ্ট্য, আমার আকাঙ্ক্ষা, নিজের কাচা আবেগগুলোকে ঠিকঠাক জায়গা করে দেওয়ার ক্ষেত্রে আমার সক্ষমতা- এইসব নিয়ে এই কোর্টগুলো আমাকে আমার বিরুদ্ধেই দাঁড় করিয়ে দিয়ে পরীক্ষা নিয়েছে।
এগুলোর সারিতে দাঁড়িয়ে নিজের দুর্বলতাগুলো নিয়ে নিরাপদ অনুভব করেছি আমি। নিজেকে এতটা মেলে ধরার এবং নিজেকে নিয়ে এতটা স্বস্তিবোধ করার এমনতর জায়গা আমি পেয়েছি, ভাবুন তো, কী সৌভাগ্য আমার?
আমি কখনোই পেছনে তাকাই না এবং কখনোই তাকাই না সামনেও- এটাই আমার সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠি। বিশ্বাস করি, যদি নাকাল হতেই থাকি, তাহলে নিজেকে এক অবিশ্বাস্য অবস্থানে ঠেলে নিয়ে যেতে পারব। কিন্তু টেনিসে ওস্তাদগিরি করার কোনো সুযোগ নেই।
'পরবর্তী প্রতিপক্ষকে মোকাবেলায় যথেষ্ট প্রস্তুত তুমি?' 'শরীর চাঙ্গা করতে কিছুদিন ছুটি কাটিয়েছ তো?' 'পিজ্জা কি একটু বেশিই খাওনি? সকালে বেশ খেটেখুটে সেটার মেদ ঝরাতে হবে কিন্তু!'- মাথায় নিরন্তর চলছে থাকা প্রশ্নগুলোকে চেপে রাখার চেষ্টা করে, আপনাকে স্রেফ কোর্টের খেলায় মনোযোগ দিতে হবে।
নিজের ভেতরে কথা বলতে থাকা এই কণ্ঠস্বর গভীরভাবে শুনে, প্রতিটি জোয়ার-ভাটার হিসেব অনুমান করে, নিজের কাছে হাজির হওয়া চূড়ান্ত সিগনালগুলো আমি গ্রহণ করি।
এ রকম একটি সিগনাল এসেছিল গত আগস্টে, ইউএস ওপেনের সময়। কোর্টে নামার আগে, দরজা বন্ধ করে, কাঁধের ইনজুরি নিয়ে কাজ করছিলাম। কাঁধের ইনজুরি আমার জন্য নতুন কিছু নয়। দিনের পর দিন ধরে চলা এই ইনজুরিতে আমার শিরাগুলো দড়ির মতো হয়ে গেছে। একাধিকবার সার্জারিও করাতে হয়েছে। প্রথমবার ২০০৮ সালে; আরেকবার গত বছর। মাসের পর মাস ফিজিওথেরাপি নিতে হয়েছে আমাকে।
সেদিন কোর্টে পা রেখেই মনে হয়েছিল শেষ বিজয়ের দেখা পেয়ে গেছি; যদিও পা রাখা মানে বিজয়ের দিকে স্রেফ এগিয়ে যাওয়া। এ কথা আমি করুণা কুড়ানোর জন্য বলছি না; বরং বলছি নিজের নতুন বস্তবতাকে জানান দিতে: আমার শরীর পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিল।
'এর কি কোনো দাম আছে?'- পুরো ক্যারিয়ারে কোনোদিন এ ধরনের প্রশ্ন তুলিনি; যদিও সেটি সবসময়ই সঙ্গী ছিল। মনোবল বরাবরই আমার সবচেয়ে বড় অস্ত্র হিসেবে কাজ করেছে। যদি প্রতিপক্ষ আমার চেয়ে শারীরিকভাবে বেশি শক্তিশালী, বেশি আত্মবিশ্বাসী, এককথায় বললে আমার চেয়ে ভালো খেলোয়াড় হয়েও থাকেন, তবু পারব জেনেই লড়ে গেছি।
নিজের কাজ কিংবা প্রচেষ্টা কিংবা মনোবল নিয়ে কথা বলতে আমার কোনোদিনও ভালো লেগেনি; সফল হতে হলে কত অব্যক্ত আত্মত্যাগ করতে হয়, তা প্রতিটি খেলোয়াড়ই জানেন। তবে আমি নিজের অধ্যায়ের উন্মোচন করছি, কারণ দ্বিধা জয় করে, সিদ্ধান্তকে অনিবার্য ধরে নেওয়ার স্বপ্ন যারা দেখেন, তাদের কিছু কথা বলতে চাই: হাজারবার ব্যর্থ হবেন আপনি, সারা দুনিয়া আপনার সেই পরাজয় দেখবে। এটা মেনে নিন। নিজের ওপর আস্থা রাখুন। কথা দিচ্ছি, জয়ী আপনি হবেনই।
টেনিসকে আমি নিজের জীবনটা দিয়েছি, বিনিময়ে টেনিস আমাকে একটা জীবন দিয়েছে। প্রতিদিনই আমি এটিকে মিস করব। মিস করব ট্রেনিং, মিস করব দৈনন্দিন রুটিন: ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠা, বাম পায়ের পর ডান পায়ের জুতার ফিতা বাঁধা, দিনের প্রথম বলটি মারার আগে কোর্টের গেট বন্ধ করা...। নিজের টিম, নিজের কোচদের আমি মিস করব।
যখন প্র্যাকটিস করতাম, কোর্টের বেঞ্চে বসে থাকতেন বাবা- সেই মুহূর্ত মিস করব। জয় কিংবা হারের পর হাত মেলানো মিস করব। তা সেই খেলোয়াড়রা জানুন বা না-ই জানুন, এই হাত মেলানোটা আমাকে ভীষণ চাঙ্গা করত।
পেছন ফিরে তাকিয়ে এখন বুঝতে পারি, টেনিসই ছিল আমার পাহাড়। উপত্যকা আর বাঁকে ভরা ছিল আমার পথ; তবু চূড়া থেকে দেখা দৃশ্যের কোনো তুলনা চলে না। ২৮ বছর খেলার এবং পাঁচটি গ্র্যান্ডস্লাম জয়ের পর আমি ইতিমধ্যে আরেকটি পাহাড়ে চড়ার জন্য, আরেকটি ভূখণ্ড পাড়ি দেওয়ার জন্য প্রস্তুত।
জয়ের জন্য এ এক নিরন্তর ছুটে চলা, তাই না? এই আকাঙ্ক্ষার শেষ কোনোদিন হবে না। সামনে কী আছে- তাতে কিছু যায়-আসে না; আমি সেই একই মনোযোগ দেব, সেই একই রকম খেটে যাব, জীবনের চলতি পথে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি- তা কাজে লাগাব।
এর মাঝখানে অল্প কিছু মামুলি কাজের দিকে চোখ রেখেছি আমি: পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো। কফির কাপ হাতে তাদের সঙ্গে সকালটা একটু দীর্ঘ হবে। সপ্তাহান্তে ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াব। নিজের পছন্দের কাজে সময় দেব (নাচের ক্লাসে ফিরছি আবার!)।
টেনিস আমাকে দুনিয়া দেখিয়েছে; দেখিয়েছে আমার জন্মের কারণ। এটির আমার রুচি গড়ে দিয়েছে, আমাকে বড় করে তুলেছে। জীবনের পরবর্তী অধ্যায়ের জন্য, নিজের পরবর্তী পাহাড়ের জন্য যা কিছুই বেছে নিই না কেন, আমি আগাতেই থাকব। এখনো পাহাড় চড়ছি আমি। এখনো বেড়ে উঠছি।