আমি নারীর ঠিক সেই প্রতিচ্ছবি, যা তালেবান চায় না: নাদিয়া নাদিম
কিশোর বয়সে ডেনমার্কের মাঠে একদিন কয়েকজন মেয়েকে কুণ্ঠাহীনভাবে ফুটবল নিয়ে দৌঁড়াতে দেখে কৌতূহলী হয়ে উঠেন নাদিয়া নাদিম। সেদিনই তিনি প্রথম নারীদের ফুটবল খেলতে দেখেন এবং ঠিক ওই মুহূর্তে নিজেও খেলাটির প্রেমে পড়ে যান। এরপর থেকে ফুটবলকেই নিজের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ করে নিয়েছেন নাদিয়া।
১৬ বছরের পেশাদার জীবনে, নাদিয়ার অর্জনের তালিকাটা বিশাল। ২০০৯ সাল থেকে ডেনমার্কের জাতীয় নারী ফুটবল দলের প্রতিনিধিত্ব করছেন তিনি। প্যারিস-সেইন্ট জার্মেইয়ের মতো বিখ্যাত ক্লাবে খেলার পর চলতি বছরের জুনে এনডব্লিউএসএল ক্লাব রেসিং লুইসভিলে এফসি'তে যোগ দিয়েছেন ৩৩ বছর বয়সী এই নারী। মাত্র দুই মৌসুম খেলেই পিএসজিকে এনে দিয়েছিলেন তাদের প্রথম লীগ শিরোপা।
কিন্তু নাদিয়া নাদিমের এসব অর্জনের পেছনে আছে এক সংকট ও যুদ্ধের গল্প।
নাদিয়া নাদিম জন্মসূত্রে একজন আফগান নারী। মাত্র ১১ বছর বয়সে তালেবানের হাতে নিজের বাবাকে হারিয়ে, মা ও চার বোনের হাত ধরে আফগানিস্তান ছাড়েন নাদিয়া।
প্রথমে নাদিয়া ও তার পরিবার পাকিস্তানে আশ্রয় নেন এবং পরবর্তীতে ডেনমার্কের এক শরণার্থী ক্যাম্পে ঠাঁই হয় তাদের।
"আমার মা সব সহায়-সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়েছিলেন। আমরা এক মানব পাচারকারীর সাহায্যে পাকিস্তানে এসে পৌঁছাই। তারপর পাকিস্তান থেকে নকল পাসপোর্ট ব্যবহার করে প্রথমে ইতালি, এবং ইতালি থেকে ট্রাকে করে ডেনমার্কে আসি", নিজের জীবনের গল্প শুরু করলেন নাদিয়া।
ডেনমার্কে যে শরণার্থী ক্যাম্পে নাদিয়ার পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল, তার আশেপাশেই ছিল কিছু চমৎকার ফুটবল খেলার মাঠ, আর একটি ফুটবল ক্লাব। এই বিষয়টিকে নিজের সৌভাগ্য বলেই ধরে নেন নাদিয়া।
ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে
কিশোর বয়সেই তালেবান শাসনের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারায় নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন নাদিয়া।
কিন্তু গেল আগস্টে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গেই তালেবানদের আবারও ক্ষমতা দখল নাদিয়ার মনে পুরোনো স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে।
তালেবান শাসনের আগে মা-বাবার সঙ্গে কাটানো সেসব সুন্দর দিনের কথা আজও মনে পড়ে তার। নাদিয়া বলেন, "তালেবানরা আসার পর আমরা প্রতিটি দিন কাটাতাম ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে, শুধুই টিকে থাকতে চাইতাম তখন।"
কিন্তু ইতিহাসের এই প্রত্যাবর্তন তাকে দুঃখিত ও বিভ্রান্ত করে তুলেছে বলে জানান তিনি।
"শুরুতে আমি ব্যাপারটা বুঝতেই পারিনি। আমি ভাবতেই পারিনি আমার জন্মভূমি আবারও এই পরিস্থিতিতে ফিরে আসবে। এটা আমাকে ভীষণ কষ্ট দিচ্ছে, মনের মধ্যে একটা ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে। তারা আসলে কোনো দেশ শাসনের যোগ্য নয়", বলেন নাদিয়া।
নাদিয়া সম্প্রতি তার নিজের গল্পেরই প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছেন অন্যদের মধ্যে। কারণ এরই মধ্যে অনেক আফগান নারী অ্যাথলেট প্রাণভয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।
আফগানিস্তানের নারী ফুটবল দলের সাবেক সহকারী কোচ হ্যালি কার্টার দলের সাবেক অধিনায়ক খালেদা পপালের সাথে মিলে একটি ইমার্জেন্সি কোয়ালিশন গঠন করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি ৮৬ জন আফগান অ্যাথলেট, কর্মকর্তা ও পরিবারের সদস্যকে দেশটি থেকে সরিয়ে এনেছেন।
একইভাবে গত সোমবার ৪১ জনের আরেকটি দলকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে ২৫ জন ছিলেন আফগান নারী সাইক্লিং দলের সদস্য।
নাদিয়া নাদিম জানালেন, অধিকাংশ নারী অ্যাথলেট আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ায় তিনি খুশি। কারণ তালেবানরা চায় না নারীরা খেলাধুলা করুক। তাই খুঁজে পেলে হয়তো তাদের ওপর হামলা করা হতো।
চলতি মাসেই তালেবানের সাংস্কৃতিক কমিশনের ডেপুটি হেড আহমাদুল্লাহ ওয়াসিক বলেছেন, "আফগান নারীরা ক্রিকেটসহ এমন কোনো খেলা খেলতে পারবে না, যেখানে তাদের শরীর উন্মোচিত হয়।"
এ প্রসঙ্গে নাদিয়ার অভিমত, "কেউ খেলাধুলা করে তো কারো ক্ষতি করছে না। সে নিজে এটা উপভোগ করছে, খেলার মাধ্যমে নিজের স্বাস্থ্য ও ফিটনেস ঠিক রাখছে। এটা কি খারাপ কিছু? যারা এটাকে নিষিদ্ধ করে, তাদের মত লোক দেশ চালাবে কি করে? আর দেশের ভবিষ্যতই বা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? এটা সত্যিই খুব দুঃখজনক।"
নারী অধিকারের জন্য হুমকিস্বরূপ
যেসব আফগান নারী এখনো আফগানিস্তান ছাড়তে পারেননি, নাদিয়া তাদের ব্যাপারে চিন্তিত।
তালেবানরা তাদের নতুন যাত্রায় নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে এবং আধুনিক সমাজ গড়বে- এমন প্রতিজ্ঞা তারা আসলেই পূরণ করতে পারবে কিনা, তা নিয়ে নাদিয়ার সন্দেহ আছে।
তালেবানদের ঘোষিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো পদে কোনো নারীকে রাখা হয়নি।
নাদিয়া বলেন, "আমার ভয় হচ্ছে যে তারা আবারও আগের মত শাসন শুরু করবে। শিক্ষা একটি মৌলিক অধিকার, তারা নারীদের হয়তো সেটাও দিবে না। স্কুলে যেতে পারা, বাকস্বাধীনতা- এগুলো খুব সাধারণ বিষয়। কিন্তু আফগান নারীরা সেটিও পাচ্ছে না।"
তিনি আরও বলেন, "সকল সংস্থা ও সব দেশের সরকারের কাছে আমার বার্তা থাকবে, আপনারা আফগানিস্তানের নারীদের কথা ভুলে যাবেন না। তারা কোনো অন্যায় করেনি, তাদের সাহায্য দরকার।"
নাদিয়া প্রশ্ন তোলেন, "যেখানে গান শোনা বা বাজানো বারণ, সেখানে খেলাধুলার অনুমতি দেওয়া হবে কীভাবে?'"
আলোর পথযাত্রী
আফগানিস্তানে নারীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকলেও, নাদিয়া নাদিম আফগানিস্তানের সকল তরুণীর পথ প্রদর্শক হতে চান।
নাদিয়া বলেন, "যত খারাপ সময়ই আসুক না কেন, আমাদের হাল ছাড়া যাবে না। আপনাকে অবশ্যই বিশ্বাস রাখতে হবে, সময় বদলাবেই। আর আপনিই নিজের ইতিবাচক মনমানসিকতা ও চিন্তাধারার মাধ্যমে সেই পরিবর্তন আনতে পারবেন।"
"যদিও এই মুহূর্তে আফগানিস্তানের জন্য একটি অন্ধকার ভবিষ্যতই দেখতে পাচ্ছি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপে পড়ে যদি তালেবানরা নমনীয় হয় বা তাদের উৎখাত করা যায়, তাহলে হয়তো একটা আশা থাকবে," বলেন তিনি।
নাদিয়ার ভাষ্যে, "আমি সেই নারীর প্রতিচ্ছবি, যা তালেবান নিজ দেশের নারীর মধ্যে দেখতে চায় না।"
"আমি নিজে গলা উঁচু করে কথা বলতে পারি, পুরুষের সমান অধিকার দাবি করতে পারি। আমি সমতা চাই। আমি মাঠে ও মাঠের বাইরে নিজেকে প্রকাশ করি, যা তালেবান দেশের নারীদের করতে দিবে না," বলেন তিনি।
বয়স মধ্য ত্রিশের দিকে এগোলেও, নাদিয়া নাদিম এখনই নিজের সুযোগ নষ্ট করতে রাজি নন। তার দৃষ্টি ভবিষ্যতের দিকে।
তিনি বলেন, "আমার বয়স মাত্র ৩৩ বছর। কিন্তু আমার এখনই মনে হয়, আমি সাত-আট জীবন পার করে ফেলেছি! আর সে কারণেই আমি আজকের আমি হয়ে উঠতে পেরেছি।"
"আমি যেসব পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গিয়েছি, আমি চাই না আমার শত্রুও তেমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাক। কিন্তু অন্যদিকে, এগুলোই ছিল আমার জীবনে তুরুপের তাস! আমার মনে হয়, আমি এর সেরাটাই বের করে এনেছি। আমার উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে। আমি আরও অনেক দূর যেতে চাই", এই বলে ইতি টানেন নাদিয়া।
- সূত্র: সিএনএন