হামিদা বানু: ভারতের 'প্রথম' নারী কুস্তিগীরের এক অবিশ্বাস্য জীবন
সময়টা আজ থেকে প্রায় ৬০-৭০ বছর আগের। ১৯৪০-৫০ এর দশকে ভারতে কুস্তিগীর বলতে শুধু পুরুষ খেলোয়াড়ই ছিল। ঠিক এ সময়টাতে একজন নারী কুস্তিগীর হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন হামিদা বানু। কিন্তু, বেশকিছু চাঞ্চল্যকর কুস্তি লড়েই দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে যান তিনি। ভারতের 'প্রথম' নারী কুস্তিগীরের [অনেকের মতে] ভাগ্যে শেষমেশ কী ঘটেছিল তা জানতে অনুসন্ধান চালিয়েছেন বিবিসি উর্দুর নিয়াজ ফারুকী।
তৎকালীন কিছু সংবাদের প্রতিবেদন অনুসারে, 'কুস্তিতে হারাতে পারলে প্রতিপক্ষকে বিয়ে করবেন'- হামিদা বানুর এমন ঘোষণা আসে ১৯৫৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে। তার বয়স তখন ৩০ এর গোঁড়ায়।
এসব প্রতিবেদন প্রকাশের কিছুদিন পরই হামিদা দুজন পুরুষ কুস্তিগীরকে পরাজিত করেন। একজন ছিলেন উত্তর পাঞ্জাব রাজ্যের পাতিয়ালার এবং অন্যজন পূর্ব পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতার।
একই বছরের মে মাসে হামিদা বানু তৃতীয় লড়াইয়ের জন্য যান পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য গুজরাটের ভাদোদরা (তৎকালীন বরোদা)তে।
ভাদোদরার বাসিন্দা সুধীর পরব সেসময়কার স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন, হামিদা বানু আসার খবরে পুরো শহর জুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। সুধীর তখন নেহাতই এক শিশু।
তিনি বলেন, এলাকায় চলা ছোট ছোট যানবাহনে পোস্টার সাঁটিয়ে, ব্যানার টাঙিয়ে হামিদার আগমনের খবর প্রচার করা হয়। পরবর্তীতে একজন খো-খো খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন সুধীর।
তিনি জানান, হামিদা বানুর লড়াই করার কথা ছিল ছোটে গামা পালোয়ান (হিন্দিতে পেহেলওয়ান) এর সাথে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তিনি লড়াই থেকে সরে আসেন এই বলে যে, তিনি কোনো নারীর সঙ্গে কুস্তি করবেন না।
এরপর হামিদা তার পরবর্তী প্রতিদ্বন্দ্বী বাবা পালোয়ানের সাথে লড়াই করেন।
অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি)তে ১৯৫৪ সালের ৩ মে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ কুস্তির বর্ণনায় বলা হয়, "লড়াইটি মাত্র ১ মিনিট ৩৪ সেকেন্ড স্থায়ী হয়। জিতে যান নারী কুস্তিগীর।"
এই লড়াইয়ের আরও ১০ বছর আগে থেকেই কুস্তির মাঠে পরিচিত মুখ ছিলেন হামিদা বানু। ১৯৪৪ সালে বোম্বে ক্রনিকল পত্রিকার প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, শহরের একটি স্টেডিয়ামে হামিদা বানু ও গুঙ্গা পালোয়ানের মধ্যকার লড়াই দেখতে উপস্থিত হন প্রায় ২০,০০০ মানুষ।
কিন্তু, গুঙ্গা পালোয়ান কয়েকটি 'অসম্ভব' দাবি করে বসায় শেষ মুহূর্তে লড়াই বাতিল করা হয়। জানা যায়, আরো বেশি অর্থ ও প্রস্তুতির জন্য আরো সময় চেয়েছিলেন তিনি। সেবার লড়াই না হওয়ায় বিক্ষুব্ধ দর্শক স্টেডিয়াম ভাংচুরও করে।
হামিদা বানু যেবার বরোদায় যান, সেসময় তিনি ৩০০ এরও বেশি লড়াই জিতেছেন বলে দাবি করেন।
উত্তর প্রদেশ রাজ্যের আলিগড় শহরের বাসিন্দা ছিলেন তিনি। স্থানীয় সংবাদপত্রে তাকে 'আলিগড়ের আমাজন' নামে ডাকা হতো। একজন কলামিস্ট লিখেছেন, হামিদা বানুর দিকে একবার তাকানোই মেরুদণ্ডে কাঁপুনি ওঠানোর জন্য যথেষ্ট!
এমনকি সেসময় তার ওজন, উচ্চতা, ডায়েট সবই খবরের পাতায় উঠে আসে। তৎকালীন সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী, তার ওজন ছিল ১৭টি পাথরের (১০৮ কেজি) সমতুল্য। লম্বায় ছিলেন ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি। আরো জানা যায়, হামিদা বানুর প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় থাকতো ৫.৬ লিটার দুধ, ২.৮ লিটার স্যুপ, ১.৮ লিটার ফলের রস, আমিষ, প্রায় ১ কেজি খাসির মাংস ও বাদাম, আধা কেজি মাখন, ৬টি ডিম, দুটি বড় রুটি এবং দুই প্লেট বিরিয়ানি।
রয়টার্সের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, "তিনি দিনে নয় ঘণ্টা ঘুমান এবং ছয় ঘণ্টা প্রশিক্ষণ নেন।"
হামিদা বানুর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যারা জীবিত আছেন তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, তৎকালীন রক্ষণশীল পরিস্থিতির কারণে তার নিজ বাসস্থান- উত্তর প্রদেশের মির্জাপুর থেকে আলিগড়ে চলে যেতে বাধ্য হন এই কুস্তিগীর। সেখানে তিনি সালাম পালোয়ান নামে এক স্থানীয় কুস্তিগীরের অধীনে প্রশিক্ষণ নেন।
১৯৮৭ সালের একটি বইতে লেখক মহেশ্বর দয়াল লিখেছেন, হামিদা বানু উত্তর প্রদেশ ও পাঞ্জাবের বেশকিছু কুস্তিতে অংশগ্রহণ করেন বিধায় তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দূর-দূরান্তে।
মহেশ্বর লিখেছেন, "তিনি [হামিদা বানু] একজন পুরুষ কুস্তিগীরের মতোই লড়াই করতেন। তবে, কয়েকজন এও বলেছেন যে, হামিদা পালোয়ান ও পুরুষ কুস্তিগীরদের মধ্যে একটি গোপন চুক্তি হতো। সে চুক্তি অনুযায়ী প্রতিপক্ষ পুরুষ কুস্তিগীর ইচ্ছাকৃতভাবে হারতো।"
এমনকি জনসমক্ষে কুস্তি খেলার কারণেও তোপের মুখে পড়তে হয়েছে হামিদাকে।
টাইমস অফ ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জনসমক্ষে লড়াই নিয়ে মহারাষ্ট্রের পুনে শহরে কুস্তি ফেডারেশন আপত্তি জানায়। ফলে পুরুষ কুস্তিগীর রামচন্দ্র সালুঙ্কের সাথে একটি লড়াই বাতিল করতে হয় হামিদাকে।
আরেকবার এক পুরুষ প্রতিপক্ষকে পরাজিত করার পর উপস্থিত দর্শকরা হামিদা বানুকে গালিগালাজ করে। তার দিকে পাথর ছুঁড়ে মারে। সেসময় তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশকেও মাঠে নামতে হয়।
'নেশন অ্যাট প্লে: আ হিস্ট্রি অফ স্পোর্ট ইন ইন্ডিয়া' বইতে শিক্ষাবিদ রনজয় সেন বর্ণনা করেছেন, কিভাবে হামিদা বানুর উপস্থিতি কুস্তিকে আরো জটিল করে তোলে।
তিনি লিখেছেন, তার কুস্তির লড়াইয়ে একটি অনানুষ্ঠানিক 'নিষেধাজ্ঞা' সম্পর্কে মহারাষ্ট্র রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের কাছে অভিযোগ করেছিলেন হামিদা। দেশাই তখন জানান, হামিদার লিঙ্গ পরিচয়ের কারণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি। বরং 'প্রচারকারীরা হামিদা বানুকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য তার আদলে 'ডামি' তৈরি করছে'-এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতেই এ অনানুষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
যে সময়টায় পুরুষরা হামিদা বানুর কৃতিত্বকে উপহাস করতো, সে সময়ই উর্দু নারীবাদী লেখক কুররাতুলাইন হায়দার তার একটি ভিন্ন চিত্র আঁকেন নিজের ছোটগল্প 'দালান ওয়ালা'তে। হায়দার লিখেছেন, তার গৃহকর্মী ফকিরা মুম্বাইয়ে একটি কুস্তি খেলা দেখতে যান; ফিরে এসে তিনি বলেন, 'সিংহী'কে কেউ হারাতে পারেনি।
সেসময়কার অন্যান্য প্রতিবেদন অনুসারে, ১৯৫৪ সালে মুম্বাইতে এক মিনিটেরও কম সময়ে রাশিয়ান কুস্তিগীর ভেরা চিস্টিলিনকে পরাজিত করেন হামিদা বানু। একই বছর হামিদা এও জানান, তিনি কুস্তি লড়তে সামনেই ইউরোপ যাবেন।
কিন্তু ব্যাপকভাবে প্রচারিত এসব লড়াইয়ের ঠিক কিছুদিনের মধ্যেই কুস্তির জগৎ থেকে হারিয়ে যান হামিদা বানু।
হামিদার পরিচিতজনরা জানান, এ সময়টাতেই বদলে যায় তার জীবন।
ততদিনে হামিদা ও সালাম পালোয়ান আলিগড়, মুম্বাই ও মুম্বাইয়ের উপকণ্ঠে অবস্থিত শহর কল্যাণের মধ্যে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করেছেন। কল্যাণে তাদের একটি খামার ছিল।
হামিদা বানুর নাতি ফিরোজ শেখ জানান, কোচ সালাম পালোয়ান হামিদার ইউরোপ যেতে চাওয়ার বিষয়টি পছন্দ করেননি। ফিরোজ শেখের বাবাকে দত্তক নিয়েছিলেন হামিদা বানু।
সালাম পালোয়ানের মেয়ে সাহারা বলেন, হামিদা বানুকে বিয়ে করেছিলেন সালাম। হামিদাকে তিনি [সাহারা] নিজের সৎ মা হিসেবে চিনতেন।
কিন্তু ১৯৮৬ সালে হামিদার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার সাথে থাকা ফিরোজ শেখ এ বিষয়ে একমত নন। "তিনি সালাম পালোয়ানের সাথে থাকলেও তাকে কোনোদিন বিয়ে করেননি," বলেন ফিরোজ।
তিনি আরো বলেন, "হামিদা বানুর ইউরোপে যাওয়া থেকে আটকাতে সালাম পালোয়ান তাকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে হাত ভেঙে দেয়।"
হামিদার সে সময়কার প্রতিবেশী রাহিল খানও একই কথা জানান। সালামের মারধরে হামিদার পা ভেঙে যায় বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, "আমার এ ঘটনা বেশ ভালোভাবে মনে আছে। হামিদা উঠে দাঁড়াতে পারছিলেন না। এমনকি সুস্থ হওয়ার পর অনেক বছর পর্যন্ত লাঠি ছাড়া হাঁটতে পারতেন না তিনি।"
সাহারা অবশ্য জানিয়েছেন, হামিদা ও সালামের সম্পর্ক সৌহার্দ্যপূর্ণ ছিল।
একটা সময় সালাম পালোয়ান আলিগড়ে ফিরে আসেন; হামিদা বানু থেকে যান কল্যাণে। সাহারা জানান, সালাম যখন মৃত্যুশয্যায় ছিলেন তখন হামিদা বানু একবার তাকে আলিগড়ে দেখতে গিয়েছিলেন।
খামারের দুধ বিক্রি আর ভবন ভাড়া দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন তিনি। যখন টাকা ফুরিয়ে যেত, তখন রাস্তার ধারে বসে বাড়িতে তৈরি হালকা নাস্তা বিক্রি করতেন হামিদা।
মাঠে নামকরা পালোয়ানদের সাথে লড়াইয়ে জিতলেও, জীবনযুদ্ধে জিততে পারেননি হামিদা। সমাজের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে যেয়ে সংগ্রাম করা একসময়কার লড়াকু এই কুস্তিগীরের শেষ দিনগুলো কেটেছে দুর্দশার মধ্য দিয়ে।