তারা এখন সাবেক
বিদায়বেলা বলেই যেন সব গুলিয়ে যাচ্ছিল আব্দুর রাজ্জাকের। কথা বলতে বলতে ভুলে যাচ্ছিলেন কথার সূত্রপাত। সাংবাদিকদের জিজ্ঞাস করছিলেন, 'কী যেন বলছিলাম?' শাহরিয়ার নাফিস টুকে আনা ফর্দের শেষটায় পৌঁছে যেন আটকে গেলেন, ভারী হয়ে ওঠা গলায় আর কথা বাড়ালেন না। মাইক ছাড়ার আগে কাঁপা কণ্ঠে বললেন, 'আমার জন্য দোয়া করবেন। বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য যেন কাজ করতে পারি।'
শনিবার সকাল পর্যন্তও রাজ্জাক-নাফিস ছিলেন বাংলাদেশের বর্তমান ক্রিকেটার। ঘড়ির ঘণ্টার কাটা কয়েক চক্কর দিতেই তারা হয়ে উঠলেন সাবেক। শনিবার সব ধরনের ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন বাংলাদেশের এই দুই ক্রিকেটার। মাঠ ছাড়লেও ক্রিকেট ছাড়ছেন না তারা। রাজ্জাক বিসিবির নির্বাচক এবং নাফিস বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের ডেপুটি ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
দেশের ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হবেন বলেই ক্রিকেট ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন রাজ্জাক-নাফিস। দীর্ঘদিন বাংলাদেশের ক্রিকেটকে সার্ভিস দেওয়া এই দুই ক্রিকেটারের বিদায়বেলায় ছোট্ট পরিসরে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল ক্রিকেটার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (কোয়াব)। যেখানে তাদের হাতে তুলে দেওয়া ক্রেস্ট।
অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন দুজন। হাসিমুখে নতুন দায়িত্ব পালনের অপেক্ষার কথা জানালেও মনের কোথাও যেন বেজে যাচ্ছিল বিষাদের সুর। বাঁহাতি স্পিনার হিসেবে বাংলাদেশের ক্রিকেটে নতুন মাত্রা যোগ করা রাজ্জাকের ভাষায়, 'গতকাল পর্যন্ত বলতে পেরেছি আমি ক্রিকেট খেলোয়াড়, এখন থেকে বলতে হবে অন্যকিছু, যা আমার পেশা। হয়তো জিনিসটা সহজে বলতে পারছি, তবে আমার জন্য এতো সহজ না। ঘোরের মধ্যে আছি এখনও।'
'১৯৯৪ সাল থেকে ক্রিকেটের মধ্যে, তখন বিকেএসপিতে ভর্তি হই। সেই জিনিসটাকে বিদায় বলা কঠিন, খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। একটা সময় এলে প্রত্যেক মানুষকেই এক কাজ থেকে অন্য ভূমিকায় যেতে হয়। তারপরও আবেগ বলে যেহেতু একটা ব্যাপার আছে, আমার মাঝে সেটা খুব কঠিনভাবে কাজ করছে। খুব ভালোভাবে কিছু বলা, গুছিয়ে বলা আমার জন্য একটু কঠিন।' যোগ করেন রাজ্জাক।
শাহরিয়ার নাফিস বুঝতে পারছেন না ঠিক কেমন অনুভূতি কাজ করছে। অনুভূতি প্রকাশ করতে এভাবেই চেষ্টা করলেন সাবেক বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান, 'একটু কঠিন। গতকাল থেকেই চিন্তা ভাবনা করছিলাম। আমি খেলব না, এটায় খুব কষ্ট লাগছে না, তবে অনুভূতিটা অদ্ভুত। আমি একটা স্কুলে পড়লাম, স্কুল ছেড়ে দিচ্ছি- ওই রকম অনুভূতি। খুবই অদ্ভুত।'
সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সব সময় মেপে পা ফেলা নাফিস আরও বললেন, 'আমি সব সময় ভেবেচিন্তে, পরিষ্কার করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি চিন্তা করেছি যখন একজন খেলোয়াড় হিসেবে আর অবদান রাখতে পারব না, তখন বিদায় বলব। তবে সব সময় বলেছি আমি ক্রিকেটের সাথেই থাকব। আমার কাছে মনে হয়েছে এটাই সঠিক সময়। কারণ খেলে যতোটুকু অবদান রাখতে পারব, তারচেয়ে এখন বেশি পারব। এ জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়নি।'
রাজ্জাক-নাফিস; দুজনেরই দীর্ঘ ক্যারিয়ার। বাংলাদেশের হয়ে ১৩টি টেস্ট, ১৫৩ ওয়ানডে ও ৩৪টি টি-টোয়েন্টি খেলেছেন রাজ্জাক। ওয়ানডেতে বাঁহাতি এই স্পিনারের শিকার ২০৭ উইকেট। যা বাংলাদেশি বোলারদের মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ। দেশের প্রথম স্পিনার হিসেবে ২০০'র বেশি ওয়ানডে উইকেটের মালিক হন রাজ্জাক। টি-টোয়েন্টিতেও তৃতীয় ও স্পিনারদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেটের মালিক তিনি। এই ফরম্যাটে তার শিকার ৪৪ উইকেট।
ঘরোয়া ক্রিকেটে রাজ্জাকের বোলিং রীতিমতো বিস্ময় জাগানিয়া। বাংলাদেশের একমাত্র বোলার হিসেবে প্রথম শ্রেণিতে ৬০০'র বেশি উইকেট নিয়েছেন তিনি। ১২৭টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে বাঁহাতি অভিজ্ঞ এই স্পিনারের শিকার ৬৩৪ উইকেট। লিস্ট 'এ' ক্রিকেটেও রাজ্জাকের বোলিং রেকর্ড ঝলমলে। ২৮০টি ম্যাচে নিয়েছেন ৪১২ উইকেট। লিস্ট 'এ' ক্রিকেটে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি তিনি। সর্বোচ্চ ৪২১ উইকেটের মালিক ওয়ানডের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা।
২০০৫ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখা শাহরিয়ার নাফিস বাংলাদেশের হয়ে ২৪ টেস্ট, ৭৫ ওয়ানডে ও একটি টি-টোয়েন্টি খেলেছেন। তার খেলা একমাত্র টি-টোয়েন্টি ম্যাচটি ছিল এই ফরম্যাটে বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচ। নাফিসের নেতৃত্বে সেই ম্যাচে জিম্বাবুয়েকে ৪৩ রানে হারায় বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের হয়ে ২০১১ সালে সর্বশেষ ওয়ানডে খেললেও সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় নাফিস এখনও সাত নম্বরে। ওয়ানডেতে বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান ৪টি সেঞ্চুরি ও ১৩টি হাফ সেঞ্চুরিসহ ৩১.৪৪ গড়ে ২ হাজার ২০১ রান করেছেন। সেঞ্চুরির তালিকায় তার অবস্থান চার নম্বরে। ২৪ টেস্টে একটি সেঞ্চুরি ও ৭টি হাফ সেঞ্চুরিসহ ২৬.৩৯ গড়ে ১ হাজার ২৬৭ রান করেছেন নাফিস। একমাত্র টি-টোয়েন্টিতে ২৫ রান করেছিলেন তিনি।
ঘরোয়া ক্রিকেটে নাফিস সব সময়ই পারফর্ম করেছেন। ১২৪টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ১৫টি সেঞ্চুরি ও ৪৮টি হাফ সেঞ্চুরিসহ ৩৮.৪০ গড়ে ৮ হাজার ১৪১ রান করেছেন তিনি। ১৮০টি লিস্ট 'এ' ম্যাচে ৯টি সেঞ্চুরি ও ৩০টি হাফ সেঞ্চুরিসহ ৩২.৩২ গড়ে ৫ হাজার ২৬৯ রান করেছেন বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান।