সাকিব-মাহমুদউল্লাহদের আচরণে মাঠ ছাড়ছেন এই আম্পায়ার
এবারের ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ টি-টোয়েন্টি ছিল ঘটনাবহুল। মাঠ ও মাঠের বাইরে অনেক অনাকাঙিক্ষত ঘটনাই ঘটেছে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে গেছে ম্যাচ চলাকালীন আম্পায়ারদের সঙ্গে তারকা ক্রিকেটারদের অশোভন আচরণ করার বিষয়টি। আম্পায়ারের সিদ্ধান্তে নাখোশ হয়ে সাকিব আল হাসান, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদরা যে আচরণ করেছেন, তা ক্রিকেট ম্যাচে রীতিমতো বিরল দৃশ্য।
শীর্ষ ক্রিকেটারদের এমন আচরণে মর্মাহত হয়েছেন আম্পায়াররা। প্রিমিয়ার লিগে ১৩টি ম্যাচে দায়িত্ব পালন করা মনিরুজ্জামান এতটাই মর্মাহত যে, সাকিব-মাহমুদউল্লাহদের আচরণের কারণে আম্পায়ারিং-ই ছেড়ে দিচ্ছেন। সম্মান বাঁচাতে আম্পায়ারিং ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন প্রথম শ্রেণির সাবেক এই ক্রিকেটার। মৌখিকভাবে ইতোমধ্যে আম্পায়ার্স কমিটি ও বিসিবিকে জানিয়ে দিয়েছেন তিনি।
আম্পায়ারিং ছাড়ার বিষয়ে মঙ্গলবার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে মনিরুজ্জামান বলেন, 'মূলত আত্মমর্যাদাবোধ রক্ষা করার জন্য আম্পায়ারিং ছেড়ে দিচ্ছি। বাংলাদেশের ক্রিকেটে আম্পায়ারদের সম্মানটা একটু কমে গেছে। আমরা তো শুধু টাকার জন্য আম্পায়রিং করি না। ভালো লাগার জায়গা থেকে করতাম, ছিলাম এতোদিন। ওই জায়গাটায় আঘাত পেয়েছি।'
'এবারের প্রিমিয়ার লিগে বাংলাদেশের সেরা ক্রিকেটারদের প্রায় সবাই রিঅ্যাক্ট করেছে। আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত তারা ঠিকমতো নেয়নি। তারা সিদ্ধান্ত মানুক না মানুক, অসম্মান প্রদর্শন করলে সেটা আমাদের গায়ে লাগে। তাদের তো সুযোগ আছে রিপোর্ট করার। কিন্তু নিয়ম মতো না গিয়ে মাঠেই অশোভন আচরণ করেছে।' যোগ করেন মনিরুজ্জামান।
সাকিব ও মাহমুদউল্লাহসহ আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'সাকিব, মাহমুদউল্লাহ খুব বাজে রিঅ্যাক্ট করেছে। শেষ ম্যাচে প্রাইম ব্যাংকের কোনো ক্রিকেটার আম্পায়ারদের সাথে হাত মেলায়নি। আমরাও তো পরিশ্রম করি। খেলোয়াড় মাঠে ঢোকার আগে আমরা ঢুকি, সবার শেষে বের হই। আমরা ভুল করি, সব আম্পায়ারেরই ভুল হয়। আইসিসির এলিট প্যানেলে যারা আছে, তাদেরও ভুল হয়। মানুষ ভুল করবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু এটাকে যদি আমরা না মানি, তাহলে সমস্যা।'
সুপার লিগের ম্যাচে গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্সের অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ আম্পায়ারের সিদ্ধান্তে অসন্তোষ প্রকাশ করাসহ অশোভন আচরণ করেন। এই ম্যাচে টিভি আম্পায়ার ছিলেন মনিরুজ্জামান। এই ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'মাহমুদউল্লাহ যেদিন অশোভন আচরণ করলো, সেদিন আমি টিভি আম্পায়ার ছিলাম। আমরা রিপোর্ট করেছিলাম। আমরা লিখেছি, আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সে যে শারীরিক ভাষা দেখিয়েছে, সেটা সে করতে পারে না। সে কোড অব কন্ডাক্ট ভেঙেছে। আমরা রিপোর্ট, ম্যাচ রেফারি তার এখতিয়ার অনুযায়ী জরিমানা করেন।'
সাকিব-মাহমুদউল্লাহদের মতো ক্রিকেটারদের কাছ থেকে তরুণ ক্রিকেটাররা কী শিক্ষা পাচ্ছে, এমন প্রশ্ন তুলে মনিরুজ্জামান বলেন, 'তারা আমাদের দেশের শীর্ষ ক্রিকেটার। তাদেরকে অনুসরণ করে আরও ৫০টা ছেলে, যারা পরের বছর বা কয়েক বছর পর প্রিমিয়ার লিগ খেলবে। এসব তরুণদের তারা কী বার্তা দিচ্ছে! নতুন ছেলেদের তারা কী শেখাচ্ছে। অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ের ক্রিকেটার আমাদের সাথে যে আচরণ করে, জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা তা করে না। সিনিয়ররা অনেক বড় খেলোয়াড়, তারা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অভিজ্ঞ। বাংলাদেশের সম্পদ তারা। তার মানে এই নয় যে তুমি খারাপ একটা শিক্ষা পরের প্রজন্মকে দিয়ে যাবে।'
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটার হওয়ায় কিছু সুবিধা পান মনিরুজ্জামান। তবে অন্য আম্পায়ারদের সঙ্গে আরও বাজে আচরণ হয় বলে জানান তিনি। তার ভাষায়, ' আমরা আলাদা সম্মান চাচ্ছি না, যেটা স্বাভাবিক, সেটা দিলেই হলো। যেটা প্রাপ্য, সেটা তো পাওয়ার অধিকার রাখি আমরা। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটার হওয়ায় আমরা কিছু সুবিধা পাই, যেগুলো অন্য আম্পায়াররা পায় না। তাদের সঙ্গে আরও খারাপ আচরণ হয়। আমরা জানি এমন হয়, অনেকেই জানে। তবে এই পর্যায়ে আসার জন্য আমাদেরও কিছু দায়-ব্যর্থতা আছে। সৎ আম্পায়ারের সংখ্যা একেবারেই কম।'
আম্পায়ারদের জন্য সামনে আরও বাজে অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছে, এই শঙ্কা থেকেই তার সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত। মনিরুজ্জামান বলেন, 'সম্মান বাঁচাতেই সরে পড়া। আগামীর দিনগুলো আম্পায়ারদের জন্য এলার্মিং। হয়তো এরচেয়ে বাজে অভিজ্ঞতার শিকার হতে পারে। এ কারণেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আম্পায়ারিং ছাড়ার।'
আম্পায়ারের সিদ্ধান্তে মেজাজ হারানো সাকিব স্টাম্পে লাথি দেন, স্টাম্প তুলে আছাড় মারেন এবং আম্পয়ারের সঙ্গে বাজে আচরণ করেন। এ নিয়ে মনিরুজ্জমানারে ভাষ্য, 'সাকিব যে ঘটনাটা ঘটিয়েছে, সেখানে আমি ছিলাম না, ছিলেন রিপন ভাই। উনিও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটার। আমরা এক সাথে রাজশাহীর হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেছি। আমি যদি সেখানে থাকতাম, আমি নিজেকে উনার জায়গাতে দাঁড় করিয়ে চিন্তা করেছি। আমার পুরো কমিউনিটিকে অসম্মান করা হয়েছে সবার সামনে। একজন দুজন দেখেছে, তা নয়। কোটি মানুষের সামনে এমন ঘটনা মানা কঠিন।'
বিসিবির বেতনভুক্ত আম্পায়ার না হলেও আম্পায়ারিংয়ে তার সুনাম রয়েছে। কখনও কোনো বিতর্কে তার নাম জড়ায়নি। ২০০৭ সালে ঘরোয়া ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়ে আম্পায়ারিং শুরু করেন তিনি। ইয়াং ক্রিকেটার্স, গুলশান ইয়ুথ ক্লাব, সিটি ক্লাব, উত্তরা স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে ৯ বছর প্রিমিয়ার লিগ খেলেছেন উইকেটরক্ষক এই ব্যাটসম্যান। রাজশাহী ও বরিশালের হয়ে চার বছর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেছেন বর্তমানে বেক্সিমকোর মানবসম্পদ বিভাগে কর্মরত মনিরুজ্জামান।