হ্যান্ড অব গড থেকে জিদানের ঢুস, বিশ্বকাপের আইকনিক কয়েক মুহূর্ত
ফুটবল বিশ্বকাপ মানেই ঘটন-অঘটনের মেলা। ১৯৩০ থেকে শুরু হওয়া ফুটবলের এই সর্বোচ্চ আসরে অলৌকিক ঘটনা যেমন কম নেই, আবার ভুলে যেতে চাওয়ার মতো অঘটনও আছে বেশ কয়েকটিই। সেরকম কিছু ঘটন-অঘটনের পসরা নিয়েই এই আয়োজন।
ডিয়েগো ম্যারাডোনার হ্যান্ড অব গড কিংবা ব্রাজিলের মারাকানাজো, ব্যাটল অব সান্তিয়াগো কিংবা দ্যা মিরাকল অব বার্ন, উদাহরণ দিতে চাইলে এমন অনেক কিছুই খুঁজে পাওয়া যাবে এ পর্যন্ত হওয়া ২১ টি ফুটবল বিশ্বকাপেই। যার মধ্যে অনেক ঘটনাই হয়েছে আলোচিত- সমালোচিত।
ফুটবল বিশ্বকাপর সময় এলেই যে ঘটনা গুলো ঘুরে ফিরে সামনে চলে আসেই সেগুলোর সংখ্যা নিছকই কম নয়। সেই ঘটনাগুলোর মধ্যে থেকে বাছাইকৃত কিছু ঘটনা নিয়ে সাজানো এই লিখা।
মারাকানাজো (১৯৫০ বিশ্বকাপ, ব্রাজিল)
বিশ্বকাপের সবথেকে সফল দল ব্রাজিল, পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের ঘরের আঙিনায় প্রথম বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫০ সালে। ফেভারিট হিসেবেই টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠে সেলেকাওরা। প্রতিপক্ষ ছিলো প্রথম বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন, আরেক লাতিন জায়ান্ট উরুগুয়ে। তবে দল, খেলা, সমর্থন এসবকিছু নিয়ে ফাইনালের ফেভারিট ছিলো ব্রাজিলই। বিশ্বকাপ জেতার জন্য ম্যাচ জেতাও জরুরি ছিলো না ব্রাজিলের, ড্র হলেই চ্যাম্পিয়ন হতো তারা, কারণ সেই বিশ্বকাপের ফরম্যাট অনুযায়ী পয়েন্টের ভিত্তিতে এগিয়ে থাকা দলকেই চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হতো।
পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে থেকে ম্যাচ খেলতে নেমে ৪৭ মিনিটে এগিয়েও যায় ব্রাজিল। সবাই যখন চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আনন্দ উদযাপন করতে প্রস্তুত হচ্ছিলো ঠিক তখনই উরুগুয়ে ম্যাচে সমতা ফেরায়। ম্যাচ সেই অবস্থায় শেষ হলেও যেহেতু ব্রাজিলই চ্যাম্পিয়ন হবে সেহেতু খুব একটা বিচলিত হয়নি স্বাগতিক সমর্থকেরা। কিন্তু ফুটবল বিধাতা যে লিখেছিলেন একেবারেই উলটো গল্প। আলসিডেস ঘিঘিয়ার গোলে শেষ পর্যন্ত ২-১ গোলে জিতে চ্যাম্পিয়ন হয় উরুগুয়েই।
বলা হয়ে থাকে, সেদিন মারাকানায় প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার ব্রাজিলিয়ান সমর্থক উপস্থিত ছিলেন। ম্যাচ শেষের বাঁশি বাজার পর পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছিলো লাখো ব্রাজিলিয়ান বেষ্টিত মারাকনায়। যা ইতিহাসে মারাকানাজো নামেই পরিচিত পেয়ে যায়।
দ্যা মিরাকল অব বার্ন (১৯৫৪ বিশ্বকাপ, সুইজারল্যান্ড)
১৯৪০ থেকে ১৯৬০ এর দশকে হাঙ্গেরির বিপক্ষে খেলা মানেই ছিলো আতঙ্কের কারণ। প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের ছিঁড়েখুঁড়ে খাওয়ার জন্য হাঙ্গেরির দলে ছিলো সমৃদ্ধ অস্ত্রভান্ডার। স্যান্ডর ককসিস, ফেরেঙ্ক পুসকাসের মতো কালজয়ী খেলোয়াড় ছিলেন হাঙ্গেরি দলে। সেই হাঙ্গেরির বিপক্ষেই ১৯৫৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে মুখোমুখি হয় পশ্চিম জার্মানি। যাদেরকে কিনা গ্রুপ পর্বেই ৮-৩ গোলে বিদ্ধস্ত করেছে হাঙ্গেরি। বিশ্বকাপও যে হাঙ্গেরিই জিতবে সেটি নিয়েও কারো মনে সন্দেহ ছিলো না।
প্রত্যাশানুযায়ীই ফাইনালে মাত্র ৮ মিনিটের মধ্যেই ২-০ গোলে এগিয়েও যায় তারা, আরেকটি বড় পরাজয় অপেক্ষা করছিল পশ্চিম জার্মানির জন্য, এমনটাই যখন ভাবছে সবাই ঠিক তখনই নিজেদের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প লিখে তারা। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে পরপর ২ গোল করে সমতা ফেরায় জার্মানি, ৮৪ মিনিটে হেলমুট রানের ২য় গোল জার্মানদের এগিয়ে দেয় ৩-২ গোলে। বাকি সময় সেই লিড ধরে রেখে চ্যাম্পিয়ন হয় পশ্চিম জার্মানি। এই জয় স্বয়ং জার্মানদের কাছেই এতটাই অবিশ্বাস্য ছিলো যে তারা এই ম্যাচ নিয়ে পরবর্তীতে সিনেমাও বানায়। এবং সেই সিনেমার নামই ছিলো, 'দ্যা মিরাকল অব বার্ন'।
ব্যাটল অব সান্তিয়াগো (১৯৬২ বিশ্বকাপ, চিলি)
এই ঘটনার নাম থেকেই বুঝা যায় যে এটি কোনো বিখ্যাত তো নয়ই বরং কুখ্যাত একটি ঘটনা। ফুটবল মাঠ যেখানে শৈল্পিক সৌন্দর্য্য ছড়ানোর জায়গা সেখানে সেটিকে যুদ্ধের ময়দান বানিয়ে ফেলা মোটেই ভালো কিছু হতে পারে না। তেমনই এক যুদ্ধের ময়দানে পরিণত হয়েছিলো চিলির সান্তিয়াগো। তবে এই ম্যাচের কুখ্যাতি যতোটা না ফুটবলীয় কারণে, তারথেকে বেশি মাঠের বাইরের ঘটনায়। স্বাগতিক চিলির মুখোমুখি হয়েছিল ইতালি। ম্যাচের আগেই ইতালিয়ান কয়েকজন সাংবাদিক চিলিকে গরীব, দুর্নীতিগ্রস্ত, নেশায় বুঁদ, অশিক্ষিত দেশ বলে আখ্যা দেয়। জবাবে চিলিয়ানরাও ইতালিকে একনায়কতান্ত্রিক, সন্ত্রাসী এবং মাদকাসক্ত বলে আখ্যায়িত করে।
ম্যাচের আগের বাক্য চালাচালির বারুদই কিনা ম্যাচেও বজায় থাকে। পুরো ম্যাচে রেফারিকে মাত্র ২টি লাল কার্ড দেখানো লাগলেও চারবার পুলিশকে ম্যাচের মধ্যে বাগড়া দিতে হয় ঝগড়া থামানোর জন্য। ম্যাচটি শেষ পর্যন্ত চিলি জিতলেও অন্যান্য ঘটনার নিচে সেটির গুরুত্ব চাপা পরে যায়। আর ম্যাচটিও 'ব্যাটল অব সান্তিয়াগো' নামে পরিচিতি পায়।
হ্যান্ড অব গড (১৯৮৬ বিশ্বকাপ, মেক্সিকো)
ফকল্যান্ড নিয়ে যুদ্ধের সুবাদে রাজনৈতিকভাবে বৈরী সম্পর্ক চলছিলো আর্জেন্টিনা এবং ইংল্যান্ডের মধ্যে। ১৯৮৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার-ফাইনালে দুই দল মুখোমুখি হওয়ার আগে ফুটবলের থেকে রাজনৈতিক কথাবার্তাই বেশি শোনা যাচ্ছিল। সেই ম্যাচেই কিনা ডিয়েগো ম্যারাডোনা এমন এক কান্ড করে বসলেন যার ফলে মৃত্যুর পরেও তাকে ক্ষমা করতে পারনি ইংল্যান্ড।
ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে ইংল্যান্ডের বক্সের ভেতর ভেসে আসা ক্রস লাফিয়েও নাগাল পাননি ম্যারাডোনা, মাথা দিয়ে ছুঁতে না পেরে বা হাঁত দিয়ে বলটি ইংলিশ গোলরক্ষক পিটার শিলটনের হাতের পাশ দিয়ে গোলপোস্টে পাঠিয়ে দেন তিনি। ইংলিশ খেলোয়াড়দের চরম আপত্তির মুখেও গোল বাতিল করেননি রেফারি। ওই গোলের পরপরই ৬ ইংলিশ ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে করা 'গোল অব দ্যা সেঞ্চুরি'র কল্যাণে ইংল্যান্ডকে ২-১ গোলে হারিয়ে সেমি-ফাইনালে উঠে আর্জেন্টিনা। ম্যারাডোনা নিজেই তার এই গোলটিকে 'হ্যান্ড অব গড' বলে আখ্যায়িত করেন।
জিনেদিন জিদানের 'ঢুস' ও লাল কার্ড (২০০৬ বিশ্বকাপ, জার্মানি)
২০০৬ বিশ্বকাপে খেলারই কথা ছিলো না জিনেদিন জিদানের। কিন্তু শত অনুরোধের পর অবসর থেকে ফিরে এসে ফ্রান্সকে বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব উতরে নিয়ে যান জিদান। বিশ্বকাপেও দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দিয়ে দলকে ফাইনালে তুলেন ৩৪ বছর বয়সী জিদান। ফাইনালের মাত্র ৭ মিনিটেই পেনাল্টি থেকে তার গোলেই ইতালির বিপক্ষে এগিয়েও যায় ফ্রান্স। তবে মার্কো মাতেরাজ্জির গোলে সমতা ফেরায় ইতালি। এরপর নির্ধারিত সময়ে আর কোনো গোল না হলে ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। সেখানেই মেজাজ হারিয়ে মাতেরাজ্জির বুকে নিজের মাথা দিয়ে ঢুস মেরে বসেন জিদান।
রেফারি সরাসরি ঘটনাটি না দেখলেও লাইন্সম্যান্সের পরামর্শে জিদানকে সরাসরি লাল কার্ড দেখান। নিজের শেষ বিশ্বকাপের ফাইনাল জেতার স্বপ্ন অসম্পূর্ণ রেখেই মাঠ ছাড়তে হয় ফরাসি কিংবদন্তিকে। জিদানের লাল কার্ডের পরে টাই-ব্রেকারে ফ্রান্সকে ৫-৩ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ইতালি।