যুক্তরাষ্ট্র ক্রিকেটের অদ্ভুত উপাখ্যান: পতন এবং উত্থানের গল্প
বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই বাজিমাত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। কানাডাকে সাত উইকেটে হারিয়ে দুর্দান্ত সূচনা করেছে এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অন্যতম স্বাগতিক দলটি। বিশ্বকাপের ঠিক আগেই বাংলাদেশকে টি-টোয়েন্টি সিরিজও হারিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
দেশটিতে এখন যেন বইছে ক্রিকেটের জোয়ার। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিকেট একসময় খেলাই বন্ধ ছিল। বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলাগুলোর একটি কেন এই বড় দেশটিতে খুব একটা চর্চা করা হয়ে ওঠেনি আর কীভাবে এখন সেই চর্চা ফিরে এসেছে, সেটির পেছনে রয়েছে বেশ কিছু কারণ এবং গল্প।
ষোড়শ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে ক্রিকেট খেলার উৎপত্তি। ব্রিটিশদের উপনিবেশ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রিকেটের পরিধিও বাড়তে থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে যেতে থাকে খেলাটি। উত্তর আমেরিকায় ক্রিকেটের প্রসারের গল্পটা কিছুটা ভিন্নরকম, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটিতে ক্রিকেটের গুরুত্ব এক সময় বেশ ভালো রকমেরই ছিল। কিন্তু ঠিক কী কারণে সেই ক্রিকেট থেকেই নজর ফিরিয়ে নিল যুক্তরাষ্ট্র? আর কীভাবেই আবার ক্রিকেট যুক্তরাষ্ট্রে তার হারানো জনপ্রিয়তা ফিরে পেতে শুরু করেছে?
যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিকেটের প্রচলন যেভাবে
১৭০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিকেটের চল শুরু হয়। ১৭৩৯ সালে নিউইয়র্কের পত্রিকাগুলোতে ক্রিকেটার চেয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া শুরু হয়। ১৭৫১ সালে ম্যানহাটনে প্রথম কোনো ক্রিকেট প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। ক্রিকেটের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের আগ্রহ দিনদিন বেড়ে চলেছিল।
উনবিংশ শতাব্দীতে যুক্তরাষ্ট্রের সব বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্রিকেট বেশ শক্তপোক্ত একটা অবস্থান তৈরি করে নেয়। বিভিন্ন স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের মধ্যে টুর্নামেন্ট খেলা শুরু করে। ১৮৮১ সালে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেট এসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা হয়। যেখানে পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, প্রিন্সটন ও কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো সেখানে যুক্ত হয়।
ফিলাডেলফিয়া হয়ে ওঠে ক্রিকেটের কেন্দ্রবিন্দু। ১৮৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ফিলাডেলফিয়া ক্রিকেট ক্লাব। যুক্তরাষ্ট্রে খেলাধুলার পথিকৃৎ হয়ে দাঁড়ায় তারা। ১৮৩৩ সালে হাভারফোর্ড কলেজ প্রথম কোনো আমেরিকান ক্রিকেট দল বানায়।
স্বাধীনতার পর যুক্তরাষ্ট্রে যেভাবে জনপ্রিয়তা হারাল ক্রিকেট
শুরুর দিকে বেশ সাড়া জাগালেও নাটকীয় ভাবে ক্রিকেটের পতন ঘটে যুক্তরাষ্ট্রে। ব্রিটিশদের জন্ম দেওয়া খেলাটি যুক্তরাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক মনোভাবের সঙ্গে বৈপরীত্য তৈরি করে। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ খেলাটি থেকে দূরে সরে যেতে থাকেন। এই ঘটনার সঙ্গে বোস্টন চা চক্রের ঘটনার অনেকটাই মিল পাওয়া যায়, যেখানে ব্রিটিশ চা'কে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ প্রত্যাখান করেছিলেন প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে ক্রিকেটের আঁটোসাটো সম্পৃক্ততা থাকা যুক্তরাষ্ট্রে খেলাটির পতনের অন্যতম কারণ। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ নিজেদের একটি আলাদা পরিচয় তৈরি করতে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠে, যেখানে ব্রিটিশদের আমদানি করা কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকবে না। ক্রিকেট তখন হয়ে পড়ে অচ্ছুৎ।
যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিকেটের পতনের কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকে দেয় ১৯০৯ সালে গঠিত হওয়া ইম্পেরিয়াল ক্রিকেট কনফারেন্স (আইসিসি)। যারা কমনওয়েলথ ভুক্ত না এমন কোনো দেশকে নিজেদের সদস্য বানাতে অস্বীকৃতি জানায়। যার কারণে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে উন্নতি করার জন্য যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা দরকার, সেটি পাওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের জন্য।
বেসবলের উত্থান
অন্যান্য কারণের সঙ্গে আরেকটি বড় কারণ ছিল বেসবলের উত্থান। এ জি স্প্যাল্ডিং নামের এক ভদ্রলোক খেলাটির পরিচয় ঘটান যুক্তরাষ্ট্রে। একজন ব্যবসায়ী এবং বেসবল প্রেমী হিসেবে স্প্যাল্ডিং খেলাটির প্রসারের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। তিনি পেশাদার লিগ গঠন করেন, খেলাটিকে ব্যবসার দিক থেকে লাভবান করে তোলেন। বেসবলকে সবার হাতের নাগালে নিয়ে আসার জন্য কাজ করেন স্প্যাল্ডিং। যেখানে ক্রিকেট কেবল গুটিকয়েক মানুষই খেলার সুযোগ পেতেন।
বেসবল খুব দ্রুত যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। ক্রিকেটকে ছাপিয়ে বেসবল হয়ে ওঠে আমেরিকানদের পছন্দের খেলা। ক্রিকেটকে দেখা হতে থাকে ব্রিটিশদের অবসর কাটানোর মাধ্যম হিসেবে। এমনকি স্লোগানও তৈরি হয়, 'ক্রিকেট অবসর কাটানোর জন্য, বেসবল যুদ্ধের সমান'। এভাবেই ক্রিকেট আরও পিছিয়ে পড়ে এবং বেসবল এগিয়ে যেতে থাকে।
যতসব ভ্রান্ত ধারণা
যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিকেটের প্রসার না ঘটার কারণ হিসেবে বলা হয়ে থাকে, শীতল আবহাওয়া কারণে এটি সেখানে খেলা কঠিন। কিন্তু এটি অযৌক্তিক বলেই প্রমাণিত হয় যখন বেসবলের মতো গ্রীষ্মকালীন খেলা একই জায়গায় জনপ্রিয়তা পায়। তাছাড়াও, ক্রিকেটের জন্ম যেখানে, সেই ইংল্যান্ডও ঠান্ডা আবহাওয়ার জন্যই কুখ্যাত। কিন্তু ক্রিকেট সেখানে ঠিকই এগিয়েছে।
আরেকটি কারণ হিসেবে দেখানো হয় যে ক্রিকেট ধীরগতির খেলা যা আমেরিকান মুল্যবোধের সঙ্গে যায় না। এটিও অযৌক্তিক কারণ টেস্ট ক্রিকেট হয়তো ধীরগতির, কিন্তু ওয়ানডে কিংবা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট দ্রুত সময়েই শেষ হয়ে থাকে। আবার অন্যান্য খেলা যেগুলোতে ধৈর্য্য ও সময়ের প্রয়োজন হয়, যেমন টেনিস ও গলফ- এসব আমেরিকানরা ঠিকই উপভোগ করে। তাই ধীরগতির খেলা বলে ক্রিকেটকে বাদ দেওয়ার যে যুক্তি, সেটিও ধোপে টেকে না।
ক্রিকেট খেলায় অনেক ধরনের নিয়ম মেনে চলতে হয় বলে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ সেটি খেলতে আগ্রহী নন, এমন কথাও শোনা গেছে। কিন্তু ফুটবল কিংবা বাস্কেটবলের মতো খেলাতেও অনেক নিয়ম মেনে চলতে হয়। সেখানে তাদের কোনো সমস্যা হয় না। তাই ক্রিকেটে নিয়ম মেনে চলার বিষয়টিও তাদের জন্য খুব বেশি সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
সর্বশেষ যে কারণটি দেখানো হয়, সেটি হলো ব্রিটিশদের প্রতি আমেরিকানদের বিতৃষ্ণা। কিন্তু এই যুক্তিও খুব শক্তিশালী হয় না যখন অন্যান্য ব্রিটিশ খেলাগুলো আমেরিকানরা আনন্দের সঙ্গে খেলে থাকেন। টেনিস ও গলফই যার উদাহরণ।
যৌক্তিক ব্যাখ্যা
সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত যে কারণটি দেখানো যায়, সেটি হলো বেসবলের উত্থান। বেসবল জনপ্রিয়তা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রিকেটের আবেদনও কমতে থাকে। বেসবলের বাজার যেভাবে বেড়ে উঠছিল এবং খেলাটিকে যেভাবে প্রতিযোগিতামূলক এবং জোরালো একটি খেলা হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছিল, সেগুলোর সঙ্গে ক্রিকেট পেরে ওঠেনি।
বেসবলকে দেখা হতো আমেরিকানদের প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবেরই একটি রূপ হিসেবে। এছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বেসবলে ভালো খেলা কাউকে বৃত্তি দেওয়া হতো, এসব কারণে খেলাটি আরও শক্ত অবস্থান তৈরি করে নেয় এবং ক্রিকেটকে দূরে ঠেলে দেয়।
ক্রিকেটকে দেখা হতে থাকে বড়লোকদের অবসর কাটানোর মাধ্যম হিসেবে। যেটির কাছে যাওয়া জনগণের বড় অংশের জন্য কঠিন ছিল। উঁচু শ্রেণির ব্রিটিশরা ক্রিকেটকে কানাডাতে প্রচার করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সেটিও ব্যর্থ হয় কারণ তরুণ কানাডিয়ানদেরকে খেলাটিকে ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নিতে অনুৎসাহিত করা হতো।
যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিকেটকে মেয়েদের খেলা হিসেবে দেখা হওয়া শুরু হয়, যা বেসবলের পুরোষচিত খেলার চিত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে।
আধুনিক যুগে ক্রিকেটের উত্থান
একবিংশ শতাব্দীতে যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিকেট পুনরায় জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেছে। এটির বড় কারণ হলো, দক্ষিণ এশিয়ার মানুষজনের যুক্তরাষ্ট্রে বসতি স্থাপন। ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মতো ক্রিকেট পাগল জাতিগুলো আমেরিকার মাটিতে ক্রিকেটের প্রতি আবারও আগ্রহ জন্মাতে সাহায্য করে যাচ্ছে। বিভিন্ন ক্রিকেট টুর্নামেন্ট ও লিগ অনুষ্ঠি হচ্ছে দেশটিতে। যা যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিকেটের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার দিকেই নির্দেশ করে।
ফিলাডেলফিয়া এখনও ক্রিকেটের জন্য অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে রয়ে গেছে। ফিলাডেলফিয়া ক্রিকেট ক্লাব নিয়মিতই ফিলাডেলফিয়া আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ফেস্টিভালের আয়োজন করে যাচ্ছে। এই টুর্নামেন্টে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে দল আসে অংশ নেওয়ার জন্য। স্কুল এবং কলেজগুলোতেও ক্রিকেটের প্রসার ঘটানোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। আমেরিকার তরুণদের খেলাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ বেড়েছে।
সব কথার সারমর্ম এই যে, যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিকেটের গল্পটা বেশ আগ্রহজাগানিয়া বটে। একসময় যে খেলা নিয়ে মাতামাতি হতো সেটিরই আবার পতন ঘটে বিভিন্ন কারণে। সময়ের চাকায় ঘুরে বর্তমান সময়ে আবারও উত্থানের পথেই আছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রিকেট। বিশ্বকাপ আয়োজন করাই যার প্রমাণ। নতুন প্রজন্মের কাছে ক্রিকেটের আবেদন বেড়ে চলেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের ক্রিকেটের জন্য ভালো বার্তাই বয়ে আনছে।