বাংলাদেশের স্বপ্ন সারথিদের বিশ্বকাপ লক্ষ্য
ঘরের মাঠের বিশ্বকাপ চলে গেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে। বাংলাদেশকে অবশ্য আয়োজক স্বত্ব হারাতে হয়নি, মেয়েদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের এবারের আসরটির আনুষ্ঠানিক আয়োজক তারাই। ঘরের মাঠের মতো স্বাচ্ছন্দ্যে লড়াই করা যাবে না, এরপরও আত্মবিশ্বাসে টান নেই বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের। বরং এবারই বড় আশা নিগার সুুলতানা জ্যোতি, জাহানারা আলম, মারুফা আক্তারদের। ২০১৪ সালের পর চারটি আসরে কোনো জয় না পেলেও এবার সেমি-ফাইনালে চোখ বাংলাদেশের।
বিশ্বকাপে অংশ নিতে ২৬ সেপ্টেম্বর দেশ ছাড়বে বাংলাদেশ, ৩ অক্টোবর উদ্বোধনী ম্যাচে তাদের প্রতিপক্ষ স্কটল্যান্ড। যাদের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে কখনও হারেনি বাংলাদেশ। এই ম্যাচটি জিতে ১০ বছরের জয়খরা কাটিয়ে শেষ চারে ওঠার মিশনে ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে কঠিন চ্যালেঞ্জ জানাতে চান নাহিদা-রাবেয়ারা। দেশ ছাড়ার আগে মিরপুর স্টেডিয়ামে আনুষ্ঠানিক ফটো সেশনের দিন উন্মুক্ত মিডিয়া সেশনে বিশ্বকাপ স্বপ্ন নিয়ে কথা বলেন ক্রিকেটাররা। বিশ্বকাপ দল ডাক পাওয়া ১৫ ক্রিকেটারের সঙ্গে আলাদাভাবেও কথা বলেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
নিগার সুলতানা জ্যোতি, উইকেটরক্ষক ব্যাটার (অধিনায়ক): বিশ্বকাপে লক্ষ্য অবশ্যই ম্যাচ জেতা। ২০১৪ সাল ছাড়া বিশ্বকাপে আমরা আর কখনও কোনো ম্যাচ জিততে পারিনি। ভালো ক্রিকেট খেলেছি, কিন্তু জিততে না পারলে সেটার কোনো মানে নেই। প্রথম তাই লক্ষ্য থাকবে ম্যাচ জেতা। দ্বিতীয়ত, যখন আমরা ফ্লো পাব… সেই ফ্লোতেই… সেমি-ফাইনাল কে না খেলতে চায়! আমাদেরও লক্ষ্য থাকবে তেমন কিছু করা। আমরা জানি যে, আমাদের ক্রিকেট যদি এক ধাপ এগিয়ে নিতে চাই, তাহলে বিশ্বকাপের চেয়ে বড় জায়গা আর হতে পারে না।
নাহিদা আক্তার, স্পিনার (সহ-অধিনায়ক): আমার প্রতি দলের চাওয়া কখনও আমার কাছে চাপ নয়, এটা আমাকে বাড়তি অনুপ্রেরণা দেয়। আমাদের কাছে আশা করে বলেই অধিনায়ক ভরসার রাখার কথা বলেছেন। আমরা আমাদের অধিনায়কের আশা পুরণের চেষ্টা করবো। আমরা ২০১৫ সাল থেকে এক সাথে খেলছি। জ্যোতি আপুর সম্পর্কে আমার ভালো ধারণা আছে, আমার সম্পর্কে তার আছে। দলের উন্নতিতে সব সময়ই আমাদের মধ্যে কথা হয়। বিশ্বকাপে দরকে নিজের সেরা পারফরম্যান্স দেওয়ার চেষ্টা থাকবে।
জাহানারা আলম, পেসার: এটা নিয়ে আমরা ষষ্ঠ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলবো। আমি গর্বিত সদস্য যে, সবগুলোতে অংশগ্রহণ করতে পেরেছি। ২০১৪ বিশ্বকাপে ঘরের মাটিতে আমরা শ্রীলঙ্কা ও আয়ারল্যান্ডকে হারিয়েছিলাম, সৌভাগ্য হয়েছিল। আমার বিশ্বাস, এবারের বিশ্বকাপটা আমাদের জন্য একটু কঠিন। আমাদের গ্রুপে এশিয়ার কোনো দল নেই। সেদিক থেকে অবশ্যই কঠিন। তবে কিছুই অসম্ভব নয়। আমরা যদি ২০১৮ সালের এশিয়া কাপের মতো দলগত পারফরম্যান্স করতে পারি, কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।
মারুফা আক্তার, পেসার: বিশ্বকাপে অবশ্যই আমি আমার সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করবো। আর বাকিটা আল্লাহ ভরসা। কোনো পেস বোলার ভাইয়ার সাথে কথা হয়নি। আমি বোলিংয়ে ভুল করলে জাহানারা আপু সব কিছু ঠিক করে দেন। আমার বোলিংয়ে সুইং আছে, যদিও বিশ্বকাপের উইকেট হয়তো অন্যরকম হবে। আমি চেষ্টা করবো আমার সেরাটা দিয়ে দলের জন্য অবদান রাখতে।
ফাহিমা আক্তার, অলরাউন্ডার: আমি যেহেতু অলরাউন্ডার, বোলিংয়ের পাশাপাশি ব্যাটিংয়ে অবদান রাখাটা দলের জন্য অনেক দরকার। কোচদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি, তারা আমাকে নিয়ে অনেক কাজ করেছেন। শ্রীলঙ্কাতে খেলে এলাম, ওখানে আমরা অনেক বেশি কাজ করেছি। আমি মনে করি এখন আমি বোলিংয়ের থেকে ব্যাটিং নিয়েই বেশি চিন্তা করি। কেউ আমাকে নিয়ে কাজ করলেও আমি মনে করি আমি আমাকে বেশি চিনি যে ব্যাটিংয়ে কতোটকু অবদান রাখার সামর্থ্য আছে আমার। বিশ্বকাপে যদি ব্যাটিংয়ে সুযোগ আসে, আমাকে যদি ১০ বলে ২০ রান করতে হয়, সেটা অবশ্যই করার লক্ষ্য থাকবে।
সোবহানা মোস্তারি, ব্যাটার: শেষ সিরিজটাতে আত্মবিশ্বাস নিয়ে ব্যাটিং করেছি, ভালো হয়েছে কিছু ম্যাচে। এই আত্মবিশ্বাস নিয়ে বিশ্বকাপে গিয়ে দলকে সর্বোচ্চটা দিতে চাই। আমার প্রতি দলের চাওয়া আছে, আমি তাদেরকে সেটা দিতে চাই। অনেক কিছু নিয়েই অ্যানালাইসিস করেছি। ঘরোয়া বা আন্তর্জাতিক ম্যাচে পারফর্ম করার ক্ষেত্রে কী কমতি আছে। হয়তো বল নির্বাচনের ব্যাপার থাকে, হয়তো দলের অবস্থা অনুযায়ী খেলতে পারছি না বা বাজে শট খেলে ফেলছি। এসব কাটিয়ে উঠতে অনেক চেষ্টা করেছি।
মুর্শিদা আক্তার, ব্যাটার: সবারই বিশ্বকাপে লক্ষ্য থাকে। বিশ্বকাপ আমাদের সবচেয়ে বড় মঞ্চ। সবারই স্বপ্ন থাকে এখানে ভালো কিছু করার। আমার চেষ্টা থাকবে আমি যদি সুযোগ পাই, আমি আমার সেরা পারফরম্যান্সটা দিবো। দলের অবস্থা অনুযায়ী আমাকে যেখানে খেলতে হবে, আমি সেখানেই খেলবো। অধিনায়ক বা কোচের পরিকল্পনা থাকতে পারে, এটা দলের পরিকল্পনা। সবকিছু দলের ওপর নির্ভর করে।
রিতু মনি, অলরাউন্ডার: আমার মনে হয়, ব্যাটিংয়ে দলের জন্য বেশি অবদান রাখার সময় হয়েছে। একজন ব্যাটারের অনেক বেশি ভূমিকা থাকে দলে। সেই জায়গার উন্নয়নে কাজ করছি, চেষ্টা করছি। বিশ্বকাপ নিয়ে সবারই লক্ষ্য থাকে, স্বপ্ন থাকে। আমারও লক্ষ্য আছে। ইনশাআল্লাহ, বিশ্বকাপে যেন আমারা স্ট্রাইক রেট যেন ১০০'র বেশি থাকে, সেই চেষ্টা করবো। সেভাবেই কাজ করেছি।
স্বর্ণা আক্তার, অলরাউন্ডার: আমার আশা বিশ্বকাপে ভালো কিছু করার। যেহেতু আমি মিডল অর্ডারে ব্যাটিং করি, আমার একটা দায়িত্ব থাকে দলের প্রতি। বাংলাদেশের হয়ে খেলছি, খেলতে পেরে অনেক গর্বিত। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে কিছু করার চেষ্টা করবো। যেকোনো অবস্থায় দলের জন্য অবদান রাখতে চাইবো। যেহেতু আমি অলরাউন্ডার, বোলিং-ফিল্ডিংয়েও একই লক্ষ্য। অলরাউন্ডিং পারফরম্যান্স করতে চাই। সবারই ইচ্ছা থাকে এমন বড় পর্যায়ে ভালো কিছু করার। আমার ইচ্ছাও তাই।
রাবেয়া খান, স্পিনার: এটা আমি উপভোগ করি (দলের গুরুত্বপূর্ণ বোলার হয়ে ওঠা) এবং এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিই। বেশি উপভোগ করি, আমার যে বোলিং পার্টনার থাকেন, তারাসহ দলের সবাই আমাকে উৎসাহিত করেন যে, "তুই পারবি, তুই এটা কর, এটা করলে ভালো হয়।" দলটা (বিশ্বকাপ দল) ভালো হয়েছে, সেমি-ফাইনাল পর্যন্ত আমরা আশা রাখতেই পারি। আমাদের সেই সামর্থ্য আছে। ব্যক্তিগত বলতে কিছু নেই, যেহেতু এটা দলগত খেলা। এখানে ব্যক্তিগতভাবে কিছু হয় না, করলে দলগতভাবে করতে হবে। দলগতভাবে খেলার চেষ্টা করব।
দিলারা আক্তার, উইকেটরক্ষক ব্যাটার: ইনশাআল্লাহ, এবার লম্বা ইনিংস দেখা যাবে, ওটা নিয়ে কাজ করছি। কোচের সাথে কথা হয়েছে, এমনকি জ্যোতি আপুর সাথেও কথা বলেছি যে কীভাবে ইনিংস লম্বা করা যায়। কারণ আমার হাতে শট আছে, আমি খেলতে পারি কিন্তু আমি ইনিংস লম্বা করতে পারি না। কথা হয়েছে, কাজও করেছি, বাকিটা আল্লাহর ওপর, দেখা যাবে বিশ্বকাপে। চিন্তা-ভাবনা মাথায়, মাঠে বাস্তবায়ন করতে হবে।
তাজ নেহার, ব্যাটার: বিশ্বকাপ দলে জায়গা পেয়েছে খুবই আনন্দিত আমি। কখনও চিন্তাই করতে পারিনি যে সরাসরি এভাবে বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পাব। খুবই আনন্দ লেগেছে, সত্যি বলতে বিশ্বকাপ দলে নিজের নামটা দেখার পরে অবাক হয়ে গেছি। এটা পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত, এভাবে সুযোগ আসবে আশা করিনি। বিশ্বকাপে খেলার হলে নিজের সেরাটা দিয়ে খেলার চেষ্টা করবো।
সুলতানা খাতুন, স্পিনার: আমি যেহেতু বোলার, বোলার হিসেবে দলে সুযোগ হয় আমার। তো বোলার হিসেবে আমার দায়িত্ব হচ্ছে দলের জন্য ভালো বোলিং করা। আমি যদি প্রথম দুই ওভারে উইকেট এনে দিতে পারি, আমাদের দল ভালো ফল আনতে পারবে। আমি চেষ্টা করবো যেন কম খরুচে বোলিং করতে পারি, এর পাশাপাশি উইকেট নিতে পারলে আরও ভালো হবে।
সাথি রানী, ব্যাটার: আমি যখন ক্রিকেট খেলা শুরু করি, তখন আমি বিশ্ব ক্রিকেটে ইনিংস শুরু করার ব্যাপারটি লক্ষ্য করি। কারণ বিশ্ব ক্রিকেটে দেখা যায়, ৫০-৬০ বলে তারা সেঞ্চুরি করছে। ওই মিশনটা আমার ছিল। ওই প্রক্রিয়ায় এগোতে চেয়েছি, এখনও আল্লাহ ভালো একটা শেপে রেখেছেন। যেহেতু আমি শুরু থেকে এটা করে এসেছি, তেমন কোনো চাপ নেই। বিশ্বকাপেও আমি আমার স্বাভাবিক খেলাটা খেলব। কারণ এটা আমার সঙ্গে মানিয়ে গেছে। বাংলাদেশে সাকিব ভাইকে অনুসরণ করি। তিনি এমন একজন মানুষ, সবকিছু মানিয়ে নিতে পারেন। মাঠ এবং মাঠের বাইরে উনার থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।
দিশা বিশ্বাস, অলরাউন্ডার: বিশ্বকাপের জন্য অনেক ভালো প্রস্তুতি নিয়েছি। যখনই সুযোগ আসবে, নিজের সেরাটা যেন দিতে পারি, সেভাবে নিজেকে প্রস্তুত রাখছি। কঠোর পরিশ্রম করছি, এটা নিজে বললে কেমন যেন হয়ে যাবে। চেষ্টা করছি নিজের জায়গা থেকে। যে পরিমাণ পরিশ্রম করলে আমি আমার দলের জন্য ভালো কিছু করতে পারব, ভবিষ্যতের জন্য কিছু একটা রেখে যেতে পারবো যেন পরের প্রজন্ম বলে একজন সিনিয়র খেলোয়াড় কিছু একটা রেখে গেছেন, আমাদেরও কিছু করতে হবে। ওভাবে চেষ্টা করছি, কঠোর পরিশ্রম করছি যেন একটা তৃপ্তি নিয়ে ক্যারিয়ার শেষ করতে পারি।
হাশান তিলকারত্নে, প্রধান কোচ: আমাদের প্রস্তুতি এবার ভালো হয়েছে। যেমন প্রস্তুতি দরকার ছিল, তেমনই হয়েছে। আমি খুবই আত্মবিশ্বাসী যে, মেয়েরা ভালো করবে। আশা করি ওরা এবার যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী এবং দলের জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো করবে। আমি বিশ্বাস, এই দলের ভেতর সব উপকরণই আছে। অনেকটা দূর যাওয়ার সামর্থ্য আছে এই দলের। ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিংয়ে পরিকল্পনায় অটুট থাকার ব্যাপার এটা। আমরা যদি তা করতে পারি, পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করতে পারি, তাহলে কেন পারবো না।