রুদ্ধশ্বাস লড়াইয়ে কুমিল্লার তৃতীয় শিরোপা
শেষ বলে এক রান তুলতে পারলেন তৌহিদ হৃদয়। ফিল্ডারের পাঠানো বল গ্লাভসবন্দি করে স্টাম্পই উপড়ে নিলেন লিটন কুমার দাস। জয়ের অন্যতম স্বারক যে এই স্টাম্প! ততোক্ষণে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স শিবিরে আনন্দের লহর। আকাশে তখন হাত ছুঁড়ছেন অধিনায়ক ইমরুল কায়েস, কিছুক্ষণ পর জার্সি খুলে যেন বোঝাতে চাইলেন গায়ের শক্তিও। রুদ্ধশ্বাস লড়াইয়ে সাকিব আল হাসানের ফরচুন বরিশালকে হারিয়ে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) শিরোপা নিজের করে নিলো কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স।
শুক্রবার মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে উত্তেজনায় ঠাসা বিপিএলের ফাইনালে ফরচুন বরিশালকে ১ রানের হারিয়েছে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স। এক ফ্র্যাঞ্চাইজির অধীনে খেলার হিসেবে রেকর্ড তৃতীয়বারের মতো ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি আসরটির শিরোপা ঘরে তুললো কুমিল্লা। ঢাকা ফ্র্যাঞ্চাইজি তিনবার শিরোপা জিতলেও মালিক ছিল দুটি। মাশরাফি বিন মুর্তজার পর প্রথম অধিনায়ক হিসেবে একাধিক শিরোপা জয়ে নেতৃত্ব দিলেন ইমরুল। চারবারের শিরোপাজয়ী মাশরাফির পরই ইমরুল, তার দখলে দুটি শিরোপা।
নিশ্বাস দূরত্বে শিরোপা, বিপিএলের ট্রফি নিজেদের করে নিতে ফরচুন বরিশালের দরকার ১২ বরে ১৬ রান। বোলিংয়ে এলেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের পেস আক্রমণের সেরা অস্ত্র মুস্তাফিজুর রহমান। ৬ রান খরচায় নাজমুল হোসেন শান্তর উইকেট তুলে নিলেন বাঁহাতি এই পেসার। শেষ ৬ বলে ১০ রানের রোমাঞ্চকর লড়াইয়ে জিতলেন কুমিল্লার পেসার শহিদুল ইসলাম, পারলেন না তৌহিদ হৃদয়, মুজিব-উর-রহমানরা। তিনবার ফাইনালে উঠেও শিরোপা ছুঁয়ে দেখা হলো না বরিশাল ফ্র্যাঞ্চাইজির, পাঁচবার ফাইনাল খেলা সাকিবও হারলেন তৃতীয়বারের মতো।
মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেটে স্টেডিয়ামে টস জিতে আগে ব্যাটিং করতে নামে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স। ম্যাচসেরা সুনীল নারাইনের ঝড়ো হাফ সেঞ্চুরির পর মঈন আলী ও আবু হায়দার রনির ব্যাটে ৯ উইকেটে ১৫১ রান তোলে কুমিল্লা। জবাবে নারাইন, তানভীর ইসলামদের দারুণ বোলিংয়ের মুখে সৈকত আলীর ঝড়ো হাফ সেঞ্চুরি, গেইলের মাঝারি ইনিংসও যথেষ্ট হলো না। বরিশালের ইনিংস থামে ৮ উইকেটে ১৫০ রানে।
জয়ের লক্ষ্যে ব্যাটিং করতে নেমে শুরুতেই উইকেট হারায় বরিশাল। আগের কয়েক ম্যাচে দারুন ব্যাটিং করা মুনিম শাহরিয়ার এদিন কিছু করতে পারেননি। ডানহাতি এই ওপেনার রানের খাতা খোলার আগেই বিদায় নেন। শুরুর চাপ কাটিয়ে উঠতে সময় নেননি ক্রিস গেইল ও সৈকত আলী।
গেইল তার স্বভাবজাত খেলা এই ম্যাচেও খেলতে পারেননি। তাকে এক পাশে রেখে তাণ্ডব চালান সৈকত। ফাইনালের আগে ফরচুন বরিশালের খেলা ১০ মাচের কেবল তিনটিতে একাদশে সুযোগে হয়েছিল সৈকতের। যেখানে ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান পারেননি নিজেকে সেভাবে মেলে ধরতে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ ফাইনালে একাদশে ডাক পড়লে মনের মাধুরী মিশিয়ে খেলেন তিনি।
দ্বিতীয় উইকেটে গেইলের সঙ্গে ৭৪ রানের জুটি গড়ার পথে সৈকত মিরপুরের ২২ গজে শাসন কায়েম করেন। ২৬ বলে ১০টি চার ও একটি ছক্কায় তুলে নেন হাফ সেঞ্চুরি। এরপর আর এগোতে পারেননি, ৫৮ রান করে থামেন তিনি। সৈকতের বিদায়ে পর জ্বলে ওঠার আভাস দেন পুরো আসরে অনুজ্জ্বল থেকে যাওয়া গেইল।
ওয়ানডে মেজাজ থেকে বেরিয়ে ব্যাট চালানো শুরু করেন ক্যারিবীয় এই ব্যাটিং কিংবদন্তি। কিন্তু স্বদেশী নারাইনের বাধাতেই থামতে হয় তাকে। ৩১ বলে ২টি চার ও একটি ছক্কায় ৩৩ রান করেন গেইল। এরপর নুরুল হাসান সোহান ও নাজমুল হোসেন শান্ত আশা জাগিয়েও পারেননি। সোহান ১৪ ও শান্ত ১২ রান করেন। শেষ বল পর্যন্ত চেষ্টা চালানো তৌহিদ হৃদয় ৯ রানে অপরাজিত থাকেন। ব্যাটিংয়ের পর অবিশ্বাস্য বোলিং করে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জেতা নারাইন ৪ ওভারে মাত্র ১৫ রানে ২ উইকেট নেন। তানভীরও নেন ২ উইকেট। একটি করে উইকেট পান মুস্তাফিজ ও শহিদুল।
এর আগে ব্যাটিং করা কুমিল্লার শুরুটা ভালো ছিল না। আগের ম্যাচে লিটন কুমার দাস শুরুতেই থামেন। অধিনায়ক ইমরুল কায়েসকে অন্য প্রান্তে রেখে তাণ্ডব চালান নারাইন। তুলে নেন ১৩ বলে বিপিএলের ইতিহাসের দ্রুততম হাফ সেঞ্চুরি। এই ম্যাচে লিটন কিছুটা সময় উইকেটে ছিলেন। তবে তাকে কিছুই করতে হয়নি। ব্যাট হাতে সাইক্লোন গতিতে রান বন্যা বইয়ে দেন নারাইন।
তার ব্যাটে ২.৫ ওভারেই ৪০ রান পেয়ে যায় কুমিল্লা। এমন সময় ৬ বলে ৪ রান করা লিটন বিদায় নেন। নতুন ব্যাটসম্যান মাহমুদুল হাসানকে সঙ্গে নিয়ে ঝড় চালিয়ে যেতে থাকেন নারাইন। যা চলে ৫.২ ওভার পর্যন্ত, ততক্ষণে ৬৯ রানে পৌঁছে যায় কুমিল্লা। দলকে উড়ন্ত সূচনা এনে দেওয়া নারাইন ২১ বলে ৫টি চারও ৪টি ছক্কায় হাফ সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন। শেষ পর্যন্ত ২৩ বলে ৫টি করে চারও ও ছক্কায় ৫৭ রান করে আউট হন তিনি।
নারাইনের বিদায়ের পর এলোমেলো হয়ে পড়ে কুমিল্লার ইনিংস। দ্রুত ফিরে যান মাহমুদুল হাসান জয় ও ফাফ ডু প্লেসি। অধিনায়ক ইমরুলও দলকে টানতে পারেননি, ১২ বলে ১২ রান করেন ফিরে যান তিনি। এরপর মঈন আলী ও আবু হায়দার রনিই যা রান করেছেন। দলটির শেষ চার ব্যাটসম্যানের কেউই রানের খাতা খুলতে পারেনি।
সপ্তম উইকেটে ৫২ বলে ৫৪ রানের জুটি গড়েন মঈন-রনি। ৩২ বলে ২টি চার ও একটি ছক্কায় ৩৮ রান করেন মঈন। ২৭ বলে একটি করে চার ও ছক্কায় ১৯ রান করেন রনি। কুমিল্লার মাত্র চারজন ব্যাটসম্যান দুই অঙ্কের রান করেন। বরিশালের মুজিব-উর-রহমান ও শফিকুল ইসলাম ২টি করে উইকেট নেন। একটি করে উইকেট পান সাকিব আল হাসান, ডোয়াইন ব্রাভো ও মেহেদি হাসান রানা।