শাহিন শাহ আফ্রিদি: প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে ক্রিকেট বিশ্বের সিংহাসনে
পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্ত ঘেঁষে লান্ডি কোটাল নামের এক প্রত্যন্ত গ্রাম। পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখোয়া (কেপিকে) প্রদেশে পড়েছে গ্রামটি।
এখানকার বাসিন্দাদের জীবন খুবই সাদামাটা, শহুরে যান্ত্রিক জীবনযাত্রার ছোঁয়া লাগেনি সেখানে। এই গ্রামে কোনো ক্রিকেট মাঠ নেই বললেই চলে। আর শুধু ক্রিকেট মাঠ কেন, অন্য কোনো খেলা সংশ্লিষ্ট অ্যাকাডেমি বা সুযোগ-সুবিধাও এখানে বিরল।
তাই ঠিক এরকম একটি গ্রাম থেকেই যখন আবির্ভাব ঘটে শাহিন শাহ আফ্রিদি নামের এক রোগা টিঙটিঙে চেহারার ফাস্ট বোলারের, যিনি জাতীয় দলের জার্সিই শুধু গায়ে চাপান না বরং গোটা ক্রিকেট বিশ্বকেই নিজের গতির জাদুতে বশ করেন, সেটিকে রীতিমতো একটি অলৌকিক ঘটনাই বলা চলে।
বাঁহাতি এই বোলার খুব ভালোভাবেই জানেন, কীভাবে ব্যাটসম্যানকে লক্ষ্য করে আগুনের গোলা ছুড়তে হবে। সম্প্রতি পাকিস্তান সুপার লিগের ম্যাচেও সে দৃষ্টান্ত দেখা গেছে। বর্তমানে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, এই খেলোয়াড়ের নিছক নাম উচ্চারণ করতেই রোমাঞ্চের হাওয়া ছড়িয়ে পড়ে গোটা পাকিস্তানজুড়ে।
ছয় ফুট ছয় ইঞ্চি উচ্চতার আফ্রিদি মানুষ হিসেবে খুবই ঠান্ডা মাথার। মুখে সবসময় লেগে থাকে প্রশান্তির হাসি।
সাত ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট আফ্রিদি। তার মতে, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ক্রিকেট নিয়ে সবসময় যে উৎসাহ-উদ্দীপনা বিরাজ করে, সেটিই তার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণার উৎস।
"আমার ভাইদের মধ্যে সবাই-ই ক্রিকেটার। আমি তাদের দেখেই অনুপ্রাণিত হয়েছি," আল জাজিরাকে বলেন আফ্রিদি।
"আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্লাস পয়েন্ট হলো, আমার একজন বড় ভাই [রিয়াজ আফ্রিদি, একজন সাবেক টেস্ট ক্রিকেটার] আছেন, যিনি ক্রিকেট সম্বন্ধে বেশ ভালো রকমের ওয়াকিবহাল। আমি তাকে অনুসরণ করতাম, এবং তিনিই এই খেলাটি শেখার ক্ষেত্রে আমার আদর্শ।"
২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক পরিসরে অভিষেক হয় আফ্রিদির। অথচ এর আগে তার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে সবেধনি নীলমণি হিসেবে ছিল কেবল একটি ফার্স্ট-ক্লাস ম্যাচ। তবে অভিজ্ঞতা যত কমই হোক, তার অদম্য আগ্রাসী মানসিকতা খেলার মাঠে নানাভাবেই সাহায্য করে চলেছে পাকিস্তানকে।
এর মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয় নিঃসন্দেহে গত বছর দুবাইয়ে তার সেই ওপেনিং স্পেল, যার কল্যাণে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে ভারতকে হারাতে সক্ষম হয় পাকিস্তান।
অমন অসামান্য পারফরম্যান্সের উপর ভর করেই ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি)-র বর্ষসেরা পুরুষ ক্রিকেটার হিসেবে স্যার গারফিল্ড সোবার্স ট্রফি জিতে নিয়েছেন।
তরুণ প্রতিভা
স্রেফ মজা করতেই স্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়তে ক্রিকেট খেলা শুরু করেন আফ্রিদি। পরের চার বছরে তার প্রতিভা নজর কেড়ে নেয় আশপাশের সবার।
ওই অঞ্চলের যারাই একবার ভালো করে আফ্রিদির খেলা দেখেছে, সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেছে এই খেলায় সফলতা অর্জনের জন্য যা যা লাগে তার সবই আছে আফ্রিদির ভেতর। তিনিও পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পারবেন তার সমনামী, গ্রেট শাহিদ আফ্রিদির, যিনি আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজের অস্তিত্বের জানান দিয়েছিলেন মাত্র ১৬ বছর বয়সে।
তবে আফ্রিদি খুব ভালো করেই জানতেন, বিশ্বের এই পশ্চাৎপদ প্রান্তে বাস করার সুবাদে তাকে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে।
"যদিও আমি শুধু উপভোগের জন্য খেলছিলাম, সবাই আমাকে বলতে শুরু করে আমি নাকি খুবই ট্যালেন্টেড। কিন্তু আমার সামনে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল এমন প্রত্যন্ত একটি অঞ্চলে বাস করা। আমাদের এখানে না আছে কোনো মাঠ, না সুযোগ-সুবিধা বা অ্যাকাডেমি। তাই অধিকাংশ সময়ই ক্রিকেট খেলা ছিল অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার।"
এরপর ২০১৫ সালে লান্ডি কোটাল থেকে ৪০ মিনিটের দূরত্বে পেশোয়ারে চলে যায় তার পরিবার। তখন আফ্রিদি ভর্তি হন ইসলামিয়া ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে।
"এই সময়ই আমি ক্রিকেটকে কেন্দ্র করে সব বাস্তবতা ও বাধা-বিপত্তিগুলো উপলব্ধি করতে পারলাম," আফ্রিদি বলেন।
ওই অ্যাকাডেমিতে থাকতেই তিনি স্বচক্ষে দেখেন, উমর গুলের মতো কেপিকে অঞ্চলের তারকা ক্রিকেটাররা আসছেন প্রাকটিস করতে। ১৫ বছর বয়সি কিশোর হিসেবে আফ্রিদির জন্য সেই সময়গুলো ছিল বিস্মিত-বিমোহিত হওয়ার। তবে এখন তো তিনি এমন অনেক খ্যাতিমান ক্রিকেটারের সঙ্গেই একসাথে ড্রেসিংরুম শেয়ার করছেন!
খেলাটির প্রতি আফ্রিদির আগ্রহ যখন তুঙ্গে, তিনি ঠিক করে ফেলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার তাকে হতেই হবে।
"আমি গুলকে দেখতাম, তার কাছ থেকে শিখতে চাইতাম। আমি খুবই খুশি ছিলাম। ওই সময়গুলোকে দারুণভাবে উপভোগ করতাম। পরে আমি নিজেই নিজেকে বারবার বলতাম, হয়তো ভবিষ্যতে কোনো একদিন আমি ক্রিকেট খেলব, পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করব," তিনি বলেন।
"আমার ভাই তো সবসময়ই ছিল, কিন্তু আমি শাহিদ আফ্রিদিকেও ভালোবাসতাম। আমাদের দুজনের পদবী যে এক, এই ব্যাপারটি দারুণ। তিনি সবসময়ই আমার নায়ক থাকবেন।"
বাবা-মা সবসময়ই ভালোবাসার বৃষ্টিতে ভিজিয়েছেন আফ্রিদিকে। জুগিয়েছেন উৎসাহ-অনুপ্রেরণা। তবে আফ্রিদি এ-ও স্বীকার করেন, তার স্বাস্থ্যের ব্যাপারে প্রায়শই দুর্ভাবনায় পড়ত তার পরিবার।
হাসতে হাসতে আফ্রিদি আরও যোগ করেন, পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ হওয়ায় আশপাশের সবাই তার ব্যাপারে প্রচণ্ড রকমের 'পজেসিভ'-ও ছিল।
"সবাই দুশ্চিন্তা করত—আমি যেহেতু এত ছোট, বল গায়ে লেগে আমি নির্ঘাত চোট পাব। সত্যিও বেশ কয়েকবার আমার হাতে ফ্র্যাকচার হয়েছে।"
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে বুদ্ধি
কিন্তু আফ্রিদির বয়স যত বেড়েছে, তার দক্ষতা ও পারফরম্যান্সেরও ততই উন্নতি হয়েছে। স্বভাবতই নিজের দিকে আরও উৎসুক দৃষ্টি কেড়েছেন তিনি।
অ্যাকাডেমির ভর্তি হওয়ার পর সে বছরই ফেডারালি অ্যাডমিনিস্টার্ড ট্রাইবাল এরিয়াসের অনূর্ধ্ব-১৬ দলে ডান পান আফ্রিদি। সেখানেই প্রথমবারের মতো তার পরিচয় হয় হার্ড-বল ক্রিকেটের সঙ্গে।
সিলেকশনের দিকে ইমপোস্টার সিনড্রোম গ্রাস করে তাকে। নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতার ব্যাপারে সন্দিহান হয়ে পড়েন। ভয় পেতে থাকেন, বোধহয় নিজেকে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হবেন।
"দল নির্বাচন প্রক্রিয়া যখন চলছে, আমি আমার ভাইকে বলছিলাম আমার ডাক পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। এত এত তরুণ প্রতিভা এসে ভিড় জমিয়েছে এখানে, তাদের মাঝ থেকে আমাকে কারও দলে নিতে বয়েই গেছে!"
আফ্রিদি মাত্র দুটো বল করেছেন কি করেননি, তাকে বলা হলো সরে যেতে। তখনও তিনি জানেন না, ওই দুটো বলই হাট করে খুলে দিয়েছে তার তারকাখ্যাতির দরজা।
"মাত্র দুটো বল করার পরই আমি সিলেক্টেড হই," আজ এতগুলো বছর পরও সেদিনের উত্তেজনার রেশ টের পাওয়া যায় আফ্রিদির কণ্ঠে। "আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না, আমি আসলেই যোগ্য।"
কিন্তু এই সিলেকশনের মানে হলো, আফ্রিদিকে এখন যাত্রা করতে হবে দেশের অন্য প্রান্তে, করাচিতে। সেখানেই অনূর্ধ্ব-১৬ দলের ক্যাম্প বসেছিল।
জীবনে প্রথমবারের মতো যখন আফ্রিদি পা রাখলেন পাকিস্তানের বৃহত্তম শহরে, নিজেকে যেন তিনি হারিয়ে খুঁজছেন। মনের মধ্যে কেবল একটিই প্রশ্ন, "এ কোথায় এসে পড়লাম আমি!"
"প্রথমবারের মতো একটি বড় শহরে এসে আমার বেশ অদ্ভুতই লাগছিল। আমি বেড়ে উঠেছি একটি গ্রামে। আর এখন হুট করে আমি এক অজানা পৃথিবীতে! এই অভিজ্ঞতা থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। নতুন নতুন বন্ধু হয়েছে আমার। অনেকের মেন্টরশিপ পেয়েছি। সব মিলিয়ে এটি ছিল একই ভিন্ন ধরনের অনুভূতি।"
কিন্তু সেখান থেকে, আরও বৃহত্তর পরিসরে লোকের নজরে আসতে দেরি করেননি আফ্রিদি। ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়ায় অনূর্ধ্ব-১৬ দলের সফরে নিজের জায়গা করে নেন তিনি। এভাবেই ছোট্ট, প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলেটি উড়াল দিতে শুরু করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে।
সেবারের অস্ট্রেলিয়া সফরটি আফ্রিদির জন্য বেশ ভালো যায়। ফলে তিনি এশিয়া কাপের জন্য পাকিস্তান অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ডাক পান। তার উপর পড়া আলোর উজ্জ্বলতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। তিনি শুধু পিএসএলেই খেলেন না, ২০১৮ সালে প্রথমবার জাতীয় দলের খেলার স্বাদও পেয়ে যান।
দ্য গ্রেট গেম: ভারত বনাম পাকিস্তান
এবার এক লাফে চলে আসা যাক ২০২১ সালের ২৪ অক্টোবর, দুবাইয়ে। আইসিসি টি-২০ বিশ্বকাপের অন্যতম হাই-প্রেশার ম্যাচকে সামনে রেখে সেখানে সাজ সাজ রব।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে অনুষ্ঠিত ক্রিকেট ম্যাচগুলোকে বিবেচনা করা হয় এই খেলার সবচেয়ে বড় আকর্ষণের একটি হিসেবে। শত-কোটি মানুষ একযোগে দেখে ভারত-পাকিস্তানের লড়াই।
সুতরাং, এটি শুধু একটি খেলাই নয়। খেলার চেয়েও বেশি কিছু। এবং আফ্রিদি নিশ্চিত করেন, সবচেয়ে বড় মঞ্চে তিনি নিজের সেরাটাই উজাড় করে দেবেন।
সেই ম্যাচে ভারতকে ১০ উইকেটে বিধ্বস্ত করে পাকিস্তান। দুই দশক ধরে যে হারের বৃত্তে বন্দি ছিল তারা, অবশেষে সেখান থেকে মুক্তি মেলে। আফ্রিদি একে একে যখন সাজঘরে ফেরত পাঠান রোহিত শর্মা, কেএল রাহুল ও বিরাট কোহলিদের, দুবাইয়ে উপস্থিত পাকিস্তানের সমর্থকরা যেন উত্তেজনায় ফেটে পড়ে, আবেগের জোয়ারে ভেসে হয়ে যায় উন্মাতাল।
ওই দিনটির কথা মনে করতে গিয়ে দারুণ গর্ববোধ করেন আফ্রিদি।
সেদিন মাঠে থাকার স্মৃতিটাকে আফ্রিদির কাছে খুবই স্বতন্ত্র একটি অনুভূতি বলে মনে হয়। এমন কিছু, যা কেবল সেদিন সেই মুহূর্তে মাঠে উপস্থিত থাকা কারও পক্ষেই উপলব্ধি করা সম্ভব।
"এর সঙ্গে অন্য আর কিছুরই তুলনা চলে না। আমার মনে আছে, এমনকি আমি যখন স্কুলে পড়ি, তখনও ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ দেখার জন্য অন্য সবকিছু ছেড়েছুড়ে আসতাম।
"যারা ক্রিকেট খেলার নিয়মিত অনুসারী নয়, তারাও এই একটি ম্যাচ দেখে। ২৪ অক্টোবর উত্তেজনার পারদ এতটাই আকাশচুম্বী ছিল যে, আমি যেন পুরো শরীরময় তা অনুভব করতে পারছিলাম। আমি জানতাম, এই ম্যাচে আমার পারফরম্যান্স মনে রাখা হবে। এটিই আমার ক্রিকেটিং জার্নিকে ডিফাইন করবে। আমি খুবই খুশি যে সেদিন আমরা ভারতকে হারিয়েছি। কোনোদিন সেই দিনটির কথা ভুলতে পারব না।"
আইসিসির তরফ থেকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ পুরস্কারটি উঠেছে আফ্রিদির হাতে। তবু লান্ডি কোটাল থেকে উঠে আসা তরুণ তার পা রাখছেন মাটিতেই।
"আমি অতীত বা ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব বেশি ভাবি না। আমি কেবল বর্তমানের উপর ফোকাস করি। বর্তমানটাই আমার কাছে সবকিছু।
"আমি একরত্তিও বদলাইনি। আমার শিডিউল যত বিজিই হোক, একটু সময় পেলেই আমি বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যাই। আমি এসেছি উত্তরাঞ্চল থেকে, জীবন যেখানে সহজ নয়, প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার কথা যেখানে আশাও করা যায় না।
"ভেবে দেখুন, সেখানকার মানুষ যদি ঠিকঠাক সুযোগ-সুবিধা পায়, তারাই হবে দেশের ভবিষ্যত। হয়তো আমি এখন যতটা ভালো করছি, তারচেয়ে ১০ গুণ ভালো করবে," তিনি বলেন।
সূত্র: আল-জাজিরা