ফুটবলকে যেভাবে বদলে দিয়েছে ডিজাইন
'বিশ্ব কাঁপে বিশ্বকাপে'- ফুটবলের বৈশ্বিক আবেদন বোঝাতে এ বাক্যের জুড়ি মেলা ভার। সত্যিই পায়ে পায়ে বলের চালে, খেলাটির সর্বোচ্চ আসর কাঁপায়- এশিয়া থেকে আফ্রিকা, ইউরোপ থেকে দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার প্রান্তর। এ আসর বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার, উত্তেজনার। ১৯৩০ সালে প্রথম ফুটবল বিশ্বকাপ ফাইনালের শুরুও হয় এক বিবাদের মাধ্যমে। গোল (হট্টগোল) বাধে, বল কে সরবরাহ করবে তা নিয়ে।
ঐতিহাসিক এ ম্যাচে বল সরবরাহ করতে চেয়েছিল ফাইনালিস্ট—উরুগুয়ে ও আর্জেন্টিনা—উভয় দলই, কারণ দুই দলই নিজ দেশে তৈরি ক্রীড়া উপকরণে খেলেই ছিল অভ্যস্ত। তাছাড়া, একে-অপরকে তারা এব্যাপারে বিশ্বাসও করতো না। এমন অচলাবস্থা নিরসনে এক সমাধানের প্রস্তাব করা হয়, ম্যাচের প্রথম অর্ধেক আর্জেন্টিনার আর দ্বিতীয় অর্ধেক খেলা হবে উরুগুয়ের বলে। প্রস্তাব সবারই মনঃপুত হলো, চলতে থাকলো ময়দানে আসল বল নিয়ন্ত্রণের লড়াই।
কিন্তু, ফলাফলে পার্থক্য ছিল বিস্ময়কর। হাফটাইমের আগে ২-১ গোলে এগিয়েছিল আর্জেন্টিনা। কিন্তু, শেষপর্যন্ত ৪-২ গোলের ব্যবধানে ইতিহাসের প্রথম বিশ্বকাপ ট্রফি ঘরে নেয় উরুগুয়ে।
লন্ডনের ডিজাইন মিউজিয়ামের একটি নতুন প্রদর্শনী 'ফুটবল: ডিজাইনিং দ্য বিউটিফুল গেম'- এর প্রধান কিউরেটর এলানর ওয়াটসন বলেন, "প্রথম বিশ্বকাপের একটি বলে ছিল ১২টি প্যানেল, অন্যটিতে ১১টি। প্যানেলিং ও সেলাইয়ে পার্থক্য থাকায়, দুটি বলের ওজন ও মসৃণতাও ছিল সামান্য ভিন্ন।"
তার মতে, "খেলোয়ারদের পারফরম্যান্সের কারিগরি দিক থেকে বিচার করলে, এই পার্থক্য সত্যিকার অর্থেই ম্যাচের চূড়ান্ত ফলাফলে প্রভাব ফেলেছিল।"
ফিরে আসছে আবারও বিশ্বকাপের আসর। ২০২২ সালে এ আসরের আয়োজক কাতার। আগামী নভেম্বরে পর্দা উঠতে চলেছে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বীতার।
তার আগে লন্ডনের ডিজাইন মিউজিয়াম, ফুটবলে নকশার ইতিহাস এ প্রদর্শনীতে তুলে ধরেছে। এখানে আসা দর্শনার্থীদের প্রথমেই স্বাগত জানাবে প্রবেশপথের কাছেই রাখা প্রথম বিশ্বকাপ ফাইনালের দুই বল। আধুনিক ফুটবল কত বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে আজকের অবস্থায় এসেছে, প্রথম বিশ্বকাপ ফাইনালের বল দুটিই তার সাক্ষী।
প্রাচীন ফুটবল শৈলীর প্রতিনিধি বল দুটি অমসৃণ ত্বক ও অতি-সেলাই নির্ভর দেখায় আজকের তুলনায়।
সে তুলনায় এখনকার বিশ্বকাপের বল হয় অনেক মসৃণ, হালকা নকশার আর বিজ্ঞানসম্মত।
কিন্তু, ফুটবল মানে শুধুই কী বল! এ খেলার অজস্র পোশাক-আশাক, ব্যাজ, ছবি, ব্যানার, পোস্টারের সাথে প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে এমনকি কিছু ঐতিহাসিক স্টেডিয়ামের ইট-পাথরের টুকরোসহ ৫০০টি বস্তু। এসব কিছু দেখানোর উদ্দেশ্য, এগুলোর নকশায় আসা বদল কীভাবে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলাকে আমূল বদলে দিয়েছে তা দর্শনার্থীদের সামনে তুলে ধরা।
নকশার সাথে খেলার বদলে যাওয়ার এই সম্পর্ক তুলে ধরা সহজ নয় বলেই মন্তব্য করেন কিউরেটর ওয়াটসন।
তার মতে, "লুকোচুরি না করেই বলি, প্রথম যখন আমি এই (প্রদর্শনীর) প্রস্তাব দেই, শুনে আমাদের মার্কেটিং শাখার প্রধান খুব অসন্তুষ্ট হন। তিনি এক কথায় বললেন, এর চেয়ে বাজে আইডিয়া আর হয় না। আধুনিক ফুটবলের বাজার সুবিস্তৃত, নকশার মাধ্যমে এ খেলার জগতে আসা পরিবর্তন তুলে ধরলে তা বিতর্ক উস্কে দেবে। কারণ, অনেকেই এ পরিবর্তনগুলোকে মনে করবেন বাজারিশক্তির কারসাজি যা মূল খেলার শৈলী বদলেছে।"
সব বিরোধীতাকে জয় করেই বাস্তবে রূপ নিয়েছে এ আয়োজন। যেখানে নকশাকার ও প্রকৌশলীরা কীভাবে ১৮৮০'র দশকে পেশাদার ফুটবল আবির্ভাবের পর থেকে এর নতুন রূপ দিয়ে গেছেন তা তুলে ধরা হচ্ছে জনসম্মুখে। ক্রীড়া ইতিহাসের গোপন এই বীরদের কথা মানুষকে নতুন করে জানাচ্ছে ডিজাইনের প্রদর্শনী। পুরোনো দিনের ফুটবল স্টেডিয়ামের স্থাপত্যশৈলী থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময়ের ই-স্পোর্টস ফুটবল টুর্নামেন্টের গ্রাফিক ডিজাইন, কালেক্টেবল- সবই আছে।
ফুটবল ইতিহাস সেরা খেলোয়াড় জর্জ বেস্ট ও লিওনেল মেসির জুতো হোক বা নারী খেলোয়াড়দের জন্য তৈরি বিশেষ বুট-সবই রয়েছে প্রদর্শিত বস্তুর তালিকায়। জার্মান দুই ভাই অ্যাডি ও রুডি ডেসলার বিখ্যাত দুই প্রতিদ্বন্দ্বী স্পোর্টস ব্র্যান্ড অ্যাডিডাস ও পুমার প্রতিষ্ঠাতা। পারিবারিক বিরোধই দুই ভাইকে করে তোলে ব্যবসাতেও প্রতিযোগী। সে ইতিহাসও তুলে ধরা হয়েছে নিপুণভাবে।
এলানর ওয়াটসন বলেন, "১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে ফিফা ওয়ার্ল্ডকাপের ফাইনাল খেলছিল পশ্চিম জার্মানি- এই শেষ দলটিই ছিল টুর্নামেন্টের সেরা দল এবং হট ফেভারেট। তারা ম্যাচে জিতেও যাচ্ছিল, তখনই আকস্মিকভাবে বাধ সাধে বৃষ্টি।"
অ্যাডির কোম্পানি অ্যাডিডাস তখন পশ্চিম জার্মান টিমের আনুষ্ঠানিক জুতা সরবরাহক- বৃষ্টির বাধা দেখে তিনি খেলোয়াড়দের জুতোর ক্লিট (জুতোর তলায় মাটি আকড়ে ধরে রাখার সংযোজন) বদলে তার জায়গায় আরও লম্বা ক্লিট লাগিয়ে দেন, ফলে খেলোয়াড়রা পিচ্ছিল মাঠ জুতো দিয়ে আরও মজবুতভাবে আকড়ে থাকার সুবিধা পান। এভাবে সেবার ফাইনালে জিতে শিরোপা ঘরে তোলে পশ্চিম জার্মানি।
ওয়াটসন বলেন, "তখন সবাই বুঝতে পারলেন ফুটবলে ক্রীড়া সরঞ্জামের গুরুত্ব। খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স বাড়াতে এসব উপকরণ যে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগী সক্ষমতা এনে দেয়- তা আর কারো জানাবোঝার বাকি থাকলো না।"
সূত্র: সিএনএন