আপনি কি ‘সুপার স্মেলার’? যে কারণে কিছু মানুষ ঘ্রাণ সংবেদনশীল হয়ে ওঠে
কিছু কিছু গন্ধ কি আপনার মধ্যে অস্বস্তিকর অনুভূতির জন্ম দেয়, এমনকি আপনার শারীরিক অবস্থা অবনতি ঘটায়? অথবা আপনার নাক সুগন্ধ শনাক্ত করতে পারে সহজেই? নাসিকা গ্রন্থির এই সক্ষমতা কি আপনার মধ্যে ভালো লাগা আর না লাগার অনুভূতি জন্ম দেয়? পাঠকের ক্ষেত্রে এসব প্রশ্নের কোনটির উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে আপনি একজন সুপার স্মেলার, বা অতিরিক্ত ঘ্রাণ সংবেদনশীল ব্যক্তি।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে এটি অবশ্য হাইপারোসমিয়া নামেই পরিচিত। সুপার স্মেলার- হচ্ছেন এমন ব্যক্তি যার নাসারন্ধ্রের ঘ্রাণ শনাক্তের সক্ষমতা অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি। এদের কেউ কেউ সুগন্ধ দ্বারা বেশি প্রভাবিত হন, অন্যরা দুর্গন্ধের কারণে তীব্র অস্বস্তি এবং শারীরিক সমস্যায় ভোগেন।
হাইপারোসমিয়া তুলনামূলকভাবে বিরল, তাই এখনও এ সম্পর্কে খুব বেশি একটা জানেন না গবেষকরা। তবে কিছু কিছু কারণে হাইপারোসমিয়া দেখা যেতে পারে। এমন কিছু কারণ এখানে তুলে ধরা গেল।
শারীরিক অবস্থা:
বেশকিছু গবেষণায় হাইপারোসমিয়ার জন্য স্বাস্থ্যগত কিছু সমস্যার সঙ্গে এর সংযোগ তুলে ধরা হয়েছে। যেমন; লাইম ডিজিস, মাইগ্রেন, শারীরিক তরল বণ্টনে তারতম্য, হরমোন ঘাটতি এবং বিশেষ কিছু ওষুধ গ্রহণকারীর ক্ষেত্রে এটি দেখা যেতে পারে।
এসব রোগ কীভাবে হাইপারোসমিয়া জন্ম দেয়- তা অবশ্য জানা যায়নি। কিন্তু, চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের ধারণা, এদের কারণে শরীরের ইলেক্ট্রোলাইট প্রভাবিত হয়, যার কারণে নাসারন্ধ্রের গন্ধ শনাক্তকরণ সক্ষমতা বেড়ে যায়।
তাছাড়া শারীরিক কোষের কিছু বিবর্তন এবং KAL1 জিনের বিবর্তনও এর জন্য দায়ি হতে পারে। এ বিবর্তনের মাধ্যমে উৎপন্ন হয় অ্যানসোমিন নামের এক ধরনের প্রোটিন, যা আমাদের নাকের ঘ্রাণ শনাক্তকারী স্নায়ু কোষগুলোর চলাচল এবং বিকাশে প্রভাব ফেলে। এভাবেও কেউ কেউ গন্ধ সংবেদনশীলে পরিণত হন।
এমনই এক প্রোটিনের জেনেটিক সংকেতকে কিছু কিছু সুগন্ধ/ দুর্গন্ধ শনাক্তের সক্ষমতা বাড়াতে নাসারন্ধ্রের কোষের সঙ্গে যুক্ত হতে দেখা গেছে। এটি অবশ্য কমবেশি সবার ক্ষেত্রেই ঘটে। কিছু ব্যক্তির ক্ষেত্রে তা অন্যদের তুলনায় বেশি হওয়ায়, তাদের ঘ্রাণ চেনার তার ক্ষমতাও থাকে অন্যদের থেকে অনেক বেশি।
গর্ভধারণ:
গর্ভবতী নারীদের অনেকেই বিশেষ কিছু গন্ধ তীব্রভাবে পাওয়ার দাবি করেন। এগুলো তাদের গর্ভধারণের আগে বিরক্ত না করলেও, গর্ভবতী থাকা অবস্থায় তাদের মধ্যে বমি বমি ভাব জন্ম দেয়। অনেক সময় একারণে তারা অসুস্থও হয়ে পড়তে পারেন। বৈজ্ঞানিক একটি পর্যবেক্ষণ বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেছে, গর্ভবতী নারীদের কেউ কেউ অস্থায়ীভাবে 'সুপার স্মেলার' হয়ে উঠতে পারেন।
৫০টির বেশি গবেষণা নিবন্ধের ফলাফল তুলনা করে- গর্ভধারণ কীভাবে অতিরিক্ত গন্ধ সংবেদনশীলতা জন্ম দেয়, তা বের করার চেষ্টা করেন বিজ্ঞানীরা। এরপর তারা জানান, গর্ভবতী নারীদের সকলেই এ দ্বারা প্রভাবিত না হলেও, কেউ কেউ বিশেষ গন্ধের ব্যাপারে বেশি সংবেদনশীল হতে পারেন। তবে অন্যান্য গন্ধের ব্যাপারেও তাদের গন্ধ শনাক্তকরণ কোষের গড়পড়তা সক্ষমতা বাড়ে কিনা- তার স্বপক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
অনেক কিছু জানা না গেলেও, একটা বিষয় স্পষ্ট। হঠাৎ করে গন্ধ চেনার এ ক্ষমতা সচরাচর দীর্ঘস্থায়ী হয় না। হলেও এমন ঘটনার সংখ্যা মুষ্টিমেয়।
মগজের পার্থক্য:
সুপার স্মেলারদের মগজের কোষ অন্যদের থেকে ভিন্নভাবে কাজ করে কিনা- তা জানতে ২০১৯ সালে এক গবেষণা করা হয়। নিজেকে অতিরিক্ত গন্ধ সংবেদনশীল মনে করেন এমন ২৫ জন পুরুষ এবং সাধারণ গন্ধ সক্ষমতার ২৫ জন পুরুষকে; গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর ব্রেন স্ক্যানের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা উভয় দলের ব্যক্তিদের মগজের ধূসর অংশের তুলনা করেন। নাসিকা গ্রন্থির ঘ্রাণ শনাক্তের সঙ্গে মস্তিকের এই অংশের কোষগুলোই জড়িত।
ঘ্রাণ সংকেত মস্তিষ্কে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে সুপার স্মেলারদের মগজের দুইটি অংশ বেশি সক্রিয় থাকে, দেখতে পান বিজ্ঞানীরা। এদুটি অংশ আমাদের মগজে শিক্ষা এবং স্মৃতিধারণের ভূমিকাও পালন করে।
ঘ্রাণ সংবেদনশীলদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের মগজের কার্য-প্রক্রিয়ায় পার্থক্য নির্ণয় করা গেলেও, জেনেটিক বৈশিষ্ট্য বা অন্য কোনো কারণে এমন হচ্ছে কিনা- তা নিশ্চিত হতে পারেননি বিজ্ঞানীরা।
আগে থেকেই জানা ছিল গন্ধের সঙ্গে আমাদের স্মৃতিকোষ ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। ২০১৪ সালের এক গবেষণায় ৫৫ গন্ধ সংবেদনশীল দাবিকারী স্বেচ্ছাসেবক অংশ নেন। গন্ধ চিহ্নিতকরণ সক্ষমতা সাধারণ বলে দাবিকারী একই বয়সের আরেকটি দলকে এর আওতায় আনা হয়।
এরপর সুপার স্মেলার বা ঘ্রাণ সংবেদনশীলদের প্রতি বেশকিছু কাঠামোবদ্ধ প্রশ্ন রাখেন গবেষকরা। প্রশ্নগুলো ছিল চারপাশের পরিবেশের নানা প্রকার গন্ধ তাদের মাঝে কেমন অনুভূতি জাগায়, সে প্রসঙ্গে।
সুপার স্মেলাররা জানান, কিছু কিছু পারিঃপার্শ্বিক গন্ধ যেমন যেমন; প্রসাধনী, মানুষের ঘামের গন্ধ তাদের মধ্যে অস্বস্তি জন্ম দেয়, কিছুক্ষেত্রে বাজে অতীত ঘটনাও স্মৃতিতে ভেসে ওঠে এর ফলে। এছাড়া, অন্য কিছু পরিবেশগত দুর্গন্ধ বিরক্তি এবং বিবমিষার জন্ম দেয়, বলেও জানান তারা।
গবেষণাটি অবশ্য আরও অন্যান্য গন্ধের ব্যাপারে অংশগ্রহণকারীদের সংবেদনশীলতা নিয়ে অনুসন্ধানের চেষ্টা করেনি। তাই এদের সকলেই সব ধরনের দুর্গন্ধের ব্যাপারে অতি-সংবেদনশীল কিনা- তা জানা যায়নি।
অন্যান্য কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, ফরমালডিহাইড এবং পিরিডিনের মতো রাসায়নিকের গন্ধের প্রতি সুপার স্মেলাররা বেশি সংবেদনশীল। যা তাদের মধ্যে বাজে অভিজ্ঞতার জন্ম দেয়। কর্মক্ষেত্রে রাসায়নিক উপাদানের গন্ধের পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকেই রাসায়নিক গন্ধ সম্পর্কে বাজে অনুভূতি হতে দেখা গেছে, অনেকের মধ্যে।