রক্ত পরীক্ষায় কি ক্যান্সার শনাক্ত করা যায়? কিছু রোগীর ক্ষেত্রে এর ব্যবহার শুরু হয়েছে
৫০ বছরের সিডনি পেরেজ যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা। তিনি জানতে পারেন, রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে প্রাথমিক অবস্থাতেই ক্যান্সার শনাক্ত করা সম্ভব, এজন্য নাকি নতুন একটি ব্লাড টেস্ট উদ্ভাবিতও রয়েছে। যদিও সিডনি মনে করেছিলেন, তিনি সুস্থ আছেন, ক্যান্সারের কোনো ঝুঁকি তাঁর নেই। তবে স্বামীর পীড়াপীড়িতে শেষপর্যন্ত করান এই পরীক্ষা।
গ্যালেরি নামের এই রক্ত পরীক্ষার 'পজিটিভ' ফল আসা তাঁকে বিস্মিতই করে। পরে স্ক্যান করে জানা যায়, তাঁর কটিসন্ধিতে তৈরি হয়েছে ছোট্ট এক টিউমার, যাকে বলা হয় 'ম্যান্টেল সেল লিমফমা' – এটি খুবই বিরল তবে আগ্রাসী ধরনের ক্যান্সার।
তবে আগেভাগে শনাক্ত হওয়ায়, সঠিক চিকিৎসা নিয়ে ক্যান্সারমুক্ত হতে পেরেছেন তিনি। সিডনির মতে, "আমার জন্য এই পরীক্ষাটি ছিল দৈব সাহায্য। সত্যিকার অর্থেই এটি অসাধারণ।"
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এই ধরনের পরীক্ষায় রক্তে থাকা জৈবিক উপাদান শরীরে ক্যান্সার কোষের উপস্থিতির ইঙ্গিত দিতে পারে। ক্যান্সার শনাক্তে যা নতুন দিগন্তের সূচনা করছে। বিশেষত অগ্নাশয় বা ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার শনাক্তের ক্ষেত্রে। এই ধরনের ক্যান্সার রোগীর শরীরে দানা বাঁধলেও– শুরুতে তার লক্ষণ প্রকাশ পায় না। রোগ যখন তীব্র রূপ নেয়- কেবল তখনই লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে থাকে। ফলে এ ধরনের ক্যান্সারের চিকিৎসা করাও বেশ কঠিন।
গ্যালেরি নামের এই রক্ত পরীক্ষার উদ্ভাবন করেছে গ্রেইল নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তাদের একজন বিজ্ঞানী এরিক ক্লেইন বলেন, "এটি সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য দীর্ঘদিনের যে চাহিদা অপূর্ণ ছিল, এটি ঠিক তাই।"
এজনই রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে ক্যান্সার শনাক্তে চলছে জোর গবেষণা। প্রায় ২০টি ব্লাড টেস্ট উদ্ভাবন বা উন্নতকরণের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে – যেগুলো ক্যান্সারের 'সংকেত' বা টিউমার ডিএনএ'র ভগ্নাশেষের মতো রক্তে থাকা ক্যান্সারের জৈবিক উপাদানগুলোকে শনাক্ত করতে পারবে। এরমধ্যে কিছু পরীক্ষা আবার এত উন্নত যে ক্যান্সার আক্রান্ত অঙ্গ বা কোষকে চিহ্নিত করতে পারবে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় টিউমার বায়োলজিসহ চিকিৎসাক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয়ে অসাধারণ সব বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত উন্নতি হয়েছে। মেশিন লার্নিং বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচালিত কম্পিউটার টুল এই গবেষণায় আনছে বিপ্লব। এর মাধ্যমে রক্তে প্রবাহমান ডিএনএ ও অন্যান্য উপাদানকে শনাক্ত করার সক্ষমতা– নতুন ধরনের এই রক্ত পরীক্ষাগুলোকে সম্ভব করে তুলছে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
এরমধ্যে কিছু রক্ত পরীক্ষা শুধু বিশেষ কোনো ধরনের ক্যান্সার শনাক্ত করার জন্য। যেমন গার্ডান্ট হেলথ শিল্ড টেস্ট নামের ব্লাড টেস্টের উদ্দেশ্য অন্ত্রের ক্যান্সার শনাক্ত করা। আবার কিছু পরীক্ষা একাধিক ধরনের ক্যান্সার শনাক্ত যেন করতে পারে– সেভাবে উদ্ভাবন করা হচ্ছে। এরমধ্যে গ্রেইল কোম্পানির গ্যালেরি এবং এক্সাট সায়েন্সের ক্যান্সারগার্ড পরীক্ষা উল্লেখযোগ্য। ক্যান্সারগার্ড পরীক্ষার পূর্বসূরি ক্যান্সারসিক উদ্ভাবন করেছিলেন জন হপকিন্স সিডনি কিমেল সেন্টারের গবেষকরা।
ফুসফুসের ক্যান্সার শনাক্তে ফার্স্টলুক নামের রক্ত পরীক্ষা পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে ডেলফি নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এই পরীক্ষাটি রক্তে মৃত কোষ থেকে নির্গত বিশেষ ধাঁচের ডিএনএ খণ্ডকে শনাক্ত করতে পারে। ফুসফুসের ক্যান্সার যাদের নেই, তাদের রক্তে বিশেষ ধাঁচের এসব ডিএনএ থাকে না। এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে মেশিন লার্নিং টুল ব্যবহার করে ডেলফি। এমনটাই জানান কোম্পানির চিফ মেডিকেল অফিসার পিটার বাখ।
তিনি বলেন, "বিশেষ কিছু ধরনের ক্যান্সার আছে, যেখানে আমরা নিশ্চিতভাবেই জানি, এগুলোর শুরুর দিকে ধরা পড়লে অনেকের জীবন বাঁচবে। বর্তমানে সময়ে ফুসফুসের ক্যান্সারই হচ্ছে সবচেয়ে বড় ক্যান্সার সমস্যা।"
আসলে এই রক্ত পরীক্ষাগুলো সরাসরি ক্যান্সার শনাক্ত করে না। বরং রক্তে যেসব উপাদানের উপস্থিতির ভিত্তিতে ক্যান্সার 'পজিটিভ' বলে ফল দেয়– পরে সেগুলো শনাক্ত করতে অন্যান্য স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনও রক্ত পরীক্ষার নতুন এই পদ্ধতিগুলো– কোলনস্কোপি, ম্যামোগ্রাফি বা প্যাপ স্মিয়ারের মতো ক্যান্সার শনাক্তের প্রচলিত স্বাস্থ্য পরীক্ষাগুলোর জায়গা দখলের করে নেওয়ার মতোন অগ্রসর নয়। এজন্য আরো গবেষণার প্রয়োজন আছে। ক্যান্সার ব্লাড টেস্ট বর্তমানে এসব পরীক্ষার সহায়ক হিসেবেই কাজ করছে।
ক্যান্সার শনাক্তকরণ পরীক্ষার ফলপ্রসূতার ওপর করা একটি গবেষণা বলছে, গ্যালেরি টেস্ট ৮৮ শতাংশ নির্ভুলতার সাথে শরীরের কোথায় ক্যান্সার হয়েছে তা জানাতে পারে। ডেলফির ফুসফুসের ক্যান্সার পরীক্ষায় নির্ভুলভাবে শনাক্তের হার ৯০ শতাংশের বেশি। অন্যদিকে গার্ডেন্ট সংস্থার হেলথ শিল্ড পরীক্ষা ৮৩ শতাংশ নির্ভুলতার সাথে জানাতে পারে রোগীর মলাশয়ের বা কোলন ক্যান্সার হয়ে কিনা।
এসব ফলাফল সম্ভাবনাময় হলেও, বিশেষজ্ঞরা কিছু সীমাবদ্ধতার বিষয়েও সতর্ক করেছেন। তাঁরা বলছেন, রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে ক্যান্সার শনাক্ত করা মানেই যে রোগী আরো বেশিদিন বাঁচতে পারবে বা মৃত্যু কমবে অথবা রোগ নিরাময় হবে– এখনও তার
যথেষ্ট প্রমাণ মেলেনি।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের ক্যান্সার প্রতিরোধ বিভাগের উপ-পরিচালক লরি মিনাসিয়ান বলেন, "মানুষ বিশ্বাস করছে, মাত্র একটি পরীক্ষা করেই সব ধরনের ক্যান্সার শনাক্ত করা যাবে, পরীক্ষার ফল নেগেটিভ আসলে, যে যার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাবে। কিন্তু বিষয়টা এত সহজ নয়।"
ক্যান্সারের প্রাথমিক শনাক্তকরণ সহজ নয় কেন
যেসব রক্ত পরীক্ষা নির্দিষ্ট এক ধরনের ক্যান্সার শনাক্তে কাজ করে, তাদের নিয়ে তেমন উদ্বেগ নেই বিশেষজ্ঞদের। কিন্তু, একই পদ্ধতিতে একাধিক ক্যান্সার ধরনের শনাক্তের যেসব পরীক্ষা– সেগুলোর ওপর আস্থা কম তাদের। এমন কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, মাল্টি-ক্যান্সার ডিটেকশন টেস্টগুলো সব ধরনের ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করতে পারে না। এর আরেক কারণ কিছু ক্যান্সার খুব দ্রুতই শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।
সিয়াটলের ফ্রেড হাচিনসন ক্যান্সার সেন্টারের গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ক্যান্সার প্রতিরোধ কর্মসূচির মেডিকেল ডিরেক্টর উইলিয়াম গ্রেডি বলেন, "এটা নির্ভর করে কোন ধরনের ক্যান্সার তার ওপর। যেমন মস্তিকের ক্যান্সার প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করাটা খুবই কঠিন। ফলে এই পরীক্ষাগুলো ব্রেইন ক্যান্সারের জন্য কার্যকরী নয়, কারণ এই ক্যান্সার দ্রুত বিস্তার লাভ করে। এমনকী শুরুতে যখন ব্রেইন ক্যান্সার খুব ছোট থাকে, তখনও বেশিরভাগক্ষেত্রে এটি নিরাময়যোগ্য নয়।"
অনুবাদ: নূর মাজিদ