আবীর আবদুল্লাহর ক্যামেরায় জলবায়ু শরণার্থীদের সংগ্রামের গল্প
বন্যার জলে ভেসে যাওয়া মসজিদের ভেতর একটুখানি শুকনো পাকা মেঝে, তার উপর সেজদারত আছেন বন্যার্ত দুই মুসল্লি। সর্বস্বান্ত হয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে তাদের আকুল নিবেদনের এই দৃশ্য মুহূর্তেই যে কারো মনে সৃষ্টি করবে অপার বিষণ্ণতা ।
জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতার শিকার দেশের নানা প্রান্তের মানুষের দুরবস্থার এমনই ৩৪টি ছবি দিয়ে সাজানো আবীর আবদুল্লাহর আলোকচিত্র প্রদর্শনী 'জলবায়ু শরণার্থী' (Climate Migrants in Bangladesh)। রাজধানীর আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দো ঢাকার লা গ্যালারিতে ১২ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই একক আলোকচিত্র প্রদর্শনী চলবে ২৬ নভেম্বর পর্যন্ত, রোববার বাদে প্রতিদিন।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘর হারিয়ে নিজের জায়গা ছেড়ে অন্যান্য অঞ্চলে শরণার্থী হওয়া মানুষের সংখ্যা বছর বছর বেড়েই চলেছে। জীবন যুদ্ধে তাদের অবিরাম লড়াই ক্যামেরার লেন্সে ধারণ করে দেশ-বিদেশের দর্শকের সামনে তুলে ধরেন আবীর আবদুল্লাহ।
জলবায়ু শরণার্থীদের নিয়ে তার কাজের শুরু সম্পর্কে বলেন, "জীবনে কোনোদিন এসি ঘরে না থাকা, দামী গাড়িতে না চড়া, কার্বন নিঃসরণের বেশিরভাগ মাধ্যম থেকে দূরে থাকা মানুষগুলোই জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতার সবচেয়ে বড় শিকার। ২০০৭ সালে শিকাগো ট্রিবিউনের সাংবাদিকের সাথে সাথে কাজ করতে চাঁদপুরের নদীভাঙন কবলিত গ্রামে মোহাম্মাদ আলী নামের এক কৃষকের সাথে কথা বলে এই উপলব্ধি জন্মায়। বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকেও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রান্তিক মানুষদের ভোগান্তি নিয়ে জানতে পারি। সেই থেকেই আমার জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজের শুরু।"
শুরুতে তার কাজের ক্ষেত্রে 'জলবায়ু উদ্বাস্তু' (Climate Refugee) শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করলেও পরে তা পরিবর্তন করে 'জলবায়ু শরণার্থী' শিরোনামে নতুন কাজ প্রকাশ করেন।
"রিফিউজি শব্দটি অনেক বেশী যুদ্ধ রিলেটেড, যেখানে জলবায়ু বা পরিবেশের কারণে নয় বরং যুদ্ধের কারণে মানুষের দেশান্তরী হওয়াকে বোঝানো হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের দেশে অহরহ মাইগ্রেশন হচ্ছে। নদীভাঙন, বন্যার কারণে মাইগ্রেশন করে যারা ঢাকায় এসেছে তাদের জীবনের প্রতিচ্ছবি থাকবে আমার পরবর্তী কাজে", বলেন আলোকচিত্রী।
'জলবায়ু শরণার্থী' নামের এই প্রদর্শনী পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফটো জার্নালিজম ফেস্টিভ্যাল, প্যারিসের Visa pour l'Image-এ মনোনীত হয় চলতি বছর। আগস্টের ২৮ তারিখ থেকে সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত সেখানে প্রদর্শনী চলে। কানাডার কুইবেকের এক শহরে জুম ফটো ফেস্টিভ্যালেও অক্টোবর মাসে এই প্রদর্শনী চলে।
তবে আবীর আবদুল্লাহর মূল পরিকল্পনা ছিল গ্লাসগোতে কপ-২৬ সম্মেলনে এই প্রদর্শনীর আয়োজন করা, "যেহেতু এত বড় ইভেন্টে অনেক বিশ্ব নেতা, পলিসি মেকার, পরিবেশকর্মীরা আসবে তাই সেখানে এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বের জলবায়ু শরনার্থীদের চিত্র তুলে ধরা ফলপ্রসূ হতে পারত। "
নানা জটিলতায় শেষ পর্যন্ত গ্লাসগোতে প্রদর্শনীর আয়োজন করা না গেলেও ঢাকায় শুরু হওয়া এই প্রদর্শনী নজর কেড়েছে অনেক দর্শনার্থী ও গণমাধ্যমের। প্রদর্শনী ঘিরে তরুণদের আগ্রহ তুলনামূলক বেশি।
২০০৭ সালের সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, চিলমারীর বন্যার্ত এলাকায় টানা ১৪ দিনে তোলা ছবি, মুন্সিগঞ্জের নদীভাঙনের ও বন্যার ছবি, ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার সময়ে দেশের নানা স্থানে তোলা আবীর আবদুল্লাহর বিভিন্ন ছবি স্থান পেয়েছে 'জলবায়ু শরণার্থী' প্রদর্শনীর ৩৪টি ছবির মধ্যে। তবে আবীরের ছবিতে বরাবরই প্রাধান্য পেয়েছে নারী চরিত্র।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "শুরু থেকেই আমি লক্ষ করেছি আমাদের সমাজে নারীরা অনেক বেশী ভূমিকা রাখেন। সাধারণ সময়ে তো বটেই, দুর্যোগপূর্ণ সময়েও তারা লড়াই করে যান শক্তভাবে। তাদের উপর সবকিছু সামলিয়ে সংসার টিকিয়ে রাখার দায়িত্বও থাকে।" তাই জলবায়ু যোদ্ধাদের ছবিতে নারীদের ভুক্তভোগী হিসেবে না দেখিয়ে শক্তিশালী চরিত্র হিসেবে দেখিয়েছেন তিনি।
"ফটোগ্রাফারদেরও কনফ্রন্টেশনে পড়তে হয়, এই বোধটা এসেছিল সাতক্ষীরার হরিনগর গ্রামে ঘূর্ণিঝড় আইলার পরে ছবি তুলতে গিয়ে।" প্রদর্শনীতে থাকা ছবি তোলার স্মৃতি রোমান্থন করতে গিয়ে বলেন আবীর।
আইলায় ঘরবাড়ি প্লাবিত হওয়া শুরু করলে সেখান থেকে দলে দলে সরে যাচ্ছিলো গ্রামবাসীরা। সেখানে ছবি তোলার সময় এক বৃদ্ধা হঠাৎ দাঁড়িয়ে তাকে প্রশ্ন করেন, "বাবা ছবি তো তুললে, আমার ঘরটা কি ফেরত দিতে পারবে!" প্রশ্নটি তাকে কিছুক্ষণের জন্য বাকরুদ্ধ করে দেয়।
"আমি ক্যামেরাটা ঘাড়ে নিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম, কারণ আমার কাছে কোনো জবাব ছিল না," বলেন তিনি। প্রদর্শনীতে তার প্রিয় ছবির তালিকায় আছে সেই ছবিটি।
ছবি তুলতে গিয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষদের জীবনযুদ্ধ সরাসরি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ তাকে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করতে আরো উৎসাহী করে। প্রকৃতির নির্মম খেলায় কত অল্প সময়ে মানুষের জীবন, পরিবেশ বদলে যায় তা দেখে প্রতিনিয়ত বিস্মিত হন আবীর আবদুল্লাহ। তার ছবির আলোছায়ার খেলায় জলবায়ু শরণার্থীদের জীবনযুদ্ধ দেশ-বিদেশের দর্শকের চোখে জীবন্ত হয়ে ধরা পড়ে ।
আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের এই প্রদর্শনীতে শুরু থেকেই অনেক ভালো সাড়া পাচ্ছেন আবীর। "উদ্বোধনীর দিনে প্রদর্শনীতে মানুষের ভিড়ে জায়গা হচ্ছিল না," জানান তিনি। শিক্ষার্থীসহ নানা পেশার তরুণেরা প্রদর্শনী দেখতে যাচ্ছেন রোজ।
প্রদর্শনীর ছবিগুলো আকৃতি অনুযায়ী নানা দামে বিক্রির ব্যবস্থাও আছে। ৮′′ X ১২′′ আকৃতির ছবির ১০,০০০ টাকা, ২১′′ X ২৫′′ আকৃতির ছবির ২০,০০০ টাকা, ২০′′ X ৩০′′ আকৃতির ছবির ২৫,০০০ টাকা এবং ৩০′′ X ৪৫′′ আকৃতির ছবির ৩০,০০০ টাকা দাম ধরা হয়েছে।
ভবিষ্যতে চীনের কুম্মিনে জলবায়ু সম্মেলনে 'জলবায়ু শরণার্থী' থিমের ছবিগুলো নিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করার আলোচনা চলছে বলে জানান আবীর।
বাংলাদেশের বড় শহরগুলোতে ভ্রাম্যমাণ প্রদর্শনীর আয়োজন করতে চান তিনি, যেন ঢাকার বাইরের মানুষও পরিচিত হতে পারে তার কাজের সঙ্গে।