ইঁদুরের লালনপালন!
শখের বসে চারটি ইঁদুর পোষার জন্য এনেছিলেন। সেখান থেকেই এখন শয়ে শয়ে ইঁদুর পালন করে বিক্রি করছেন রাজশাহীর সালাহউদ্দিন মামুন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের গবেষণার পরিচারক তিনি। তিন বছর আগে শখ করে আনা ইঁদুর থেকে এখন তিনি শত শত ইঁদুরের মালিক। ইঁদুর বিক্রি করে মাসে হাজার হাজার টাকা উপার্জন করছেন। তার কাছ থেকে দেশের বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা ইঁদুর কিনে নিয়ে গবেষণার কাজে ব্যবহার করছে।
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজশাহীর কাটাখালীর পৌর এলাকায় তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ইঁদুর লালনপালনের করার জন্য ছোট আকৃতির একটি ঘরের পুরোটাই নেট দিয়ে ঢাকা। ভেতরে হার্ডবোর্ডের তৈরি ৮ থেকে ১০টি বাক্স। এসব বাক্স বোঝাই ইঁদুর। কোনো কোনো বক্সে সদ্য জন্ম দেওয়া ইঁদুর। কোনো বাক্সে বড়গুলো।
সালাহউদ্দিন মামুন জানান, ২০১৭ সালে প্রাণীবিদ্যা বিভাগের এক পিএইচডি গবেষকের গবেষণার পর অতিরিক্ত চারটি ইঁদুর বেঁচে যায়। তিনি সেই ইঁদুরগুলো ছেড়ে দিচ্ছিলেন। 'টিস্যু খুব দুর্বল হওয়ায় খোলা পরিবেশে টিকতে পারবে না মনে করে ইঁদুরগুলো আমি বাড়িতে নিয়ে আসি। তার মধ্যে দুটি মা ইঁদুর ছিল। এক মাস পর দুটি মা ইঁদুর থেকে ২০টা ইঁদুরের বাচ্চা জন্ম নেয়। এভাবে প্রায় প্রতি মাসে ইঁদুরের বাচ্চা বাড়তে থাকে। সেই চারটা ইঁদুর থেকে ১ হাজারটি ইঁদুর হয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'একটি মা ইঁদুর থেকে একবারে ৮ থেকে ১০টি বাচ্চা জন্ম দেয়। আমাদের আবহাওয়া ইঁদুর উৎপাদনের জন্য খুবই অনুকূল। এইজন্য বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে মা ইঁদুর বেশি সংখ্যকবার বাচ্চা দেয়। ইউরোপসহ অন্যান্য দেশে যেখানে বছরে দুই থেকে তিনবার একটি মা ইঁদুর বাচ্চা দেয়, সেখানে আমাদের দেশে আট থেকে ১০ বার বাচ্চা পাওয়া যায়। আবার লালনপালনের খরচও কম হওয়ায় খুব লাভজনক। একটা ইঁদুর দিনে চার থেকে পাঁচ গ্রাম খাবার খায়।'
'ইঁদুর বিক্রি করেও ভালো উর্পাজন হয়। শখের বসে শুরু হওয়া ইঁদুর পালন থেকে আমি এ পর্যন্ত ৫ হাজার ইঁদুর উৎপাদন করে বিক্রি করেছি দেশের বিভিন্ন গবেষণাগারে। মাসে ৩০ থেকে ৮০ হাজার টাকা উর্পাজন সম্ভব।'
সালাহউদ্দিন মামুন বলেন, 'লালনপালন শুরু করার এক মাস পর আমি প্রথম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের জাদুঘরকে ২০টি ইঁদুর দিই। জাদুঘরের খণ্ডকালীন গবেষণা সহযোগী আমার কাছ থেকে গবেষণার জন্য এই ইঁদুর সংগ্রহ করেন। ২০ ইঁদুর বাবদ আমাকে ১ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়। এর একমাস পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগকে আরও ২০টি ইঁদুর দেই। এভাবে ক্রমান্বয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমেস্ট্রি, ফার্মেসি ও প্রাণীবিদ্যা বিভাগ আমার কাছ থেকে নিয়মিত ইঁদুর নিতে শুরু করে। এছাড়া বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগও ইঁদুর নেয় আমার কাছ থেকে। শুরুতে একটি ইঁদুর বিক্রি করেছি ৪০ টাকায়।'
'বাচ্চা দেওয়ার এক মাসের মধ্যেই ইঁদুর বিক্রির উপযোগী হয়,' জানিয়ে মামুন আরও বলেন, 'করোনাভাইরাসের কারণে ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় প্রচুর ইঁদুর জমে গিয়েছিল। ফলে প্রচুর ইঁদুর অবিক্রিত থেকে যায়।'
গত অক্টোবর মাসেও তার কাছে ১ হাজারটি ইঁদুর ছিল। মাঝখানে ৭০ টাকা দরে ৪০০টি ইঁদুর ঢাকার দুটি ফার্মাসিউটিক্যালস প্রতিষ্ঠান দিয়েছেন।
সালাহউদ্দিন মামুনের কাছে এখন ১৫০টি ইঁদুর রয়েছে। ইঁদুরের চাহিদা ব্যাপক। তার কাছ থেকে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ইঁদুর নেয় এখন গবেষণার জন্য। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সিরাজগঞ্জের খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজও রয়েছে।
মামুন মনে করেন, ইঁদুর সরবরাহ হতে পারে নতুন পেশা। ইঁদুর বিক্রি করে এখন প্রতি মাসে গড়ে ৫ হাজার টাকা আয় হয় তার।
ইঁদুর চাষের জন্য প্রয়োজন শুধু একটা বড় নেট ঘেরা ঘর আর এক থেকে দেড়শ ইঁদুর। এমনিতেই ইঁদুর দ্রুত বংশ বৃদ্ধি করে। দেড়শ ইঁদুর থেকে এক মাসে প্রায় পাঁচ কি ছয়শ ইঁদুর উৎপাদন সম্ভব।
সালাহউদ্দিন মামুনের পরিকল্পনা, আরেকটি বড় ঘর করে সেখানে প্রতি মাসে ৫০০ থেকে ১০০০ ইঁদুর উৎপাদন করা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিকস অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবু রেজা বলেন, 'আমি কয়েক মাস পরপর তার কাছে থেকে ৫০টি করে ইঁদুর নিই। বিভিন্ন ধরনের গবেষণায় তার ইঁদুরগুলো কাজে লাগছে। গবেষণায় যত বেশি অ্যাপ্লিকেশন, তত বেশি ইঁদুরের প্রয়োজন হয়। কারণ গবেষণার অনেক কিছু সরাসরি মানবকুলের ওপর করা যায় না। সেক্ষেত্রে ইঁদুর বহুকাল থেকে ব্যবহার হয়ে আসছে গবেষণায়। আর সুইস অ্যালবিনো ইঁদুর মূলত গবেষণার কাজেই ব্যবহার করা হয়।'