উডবার্ন লাইব্রেরির তিনশ বছরের প্রাচীন পাণ্ডুলিপি হুমকির মুখে
গণগ্রন্থগার অধিদপ্তর প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নেয়ায় বগুড়া উডবার্ন সরকারি গ্রন্থাগারের ৩'শ বছরের পুরোনো বেশ কয়েকটি পান্ডুলিপিসহ মূল্যবান অনেক বই সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না।
বগুড়া উডবার্ন সরকারি গণগ্রন্থাগারে রয়েছে ৩'শ বছরেরও বেশি পুরনো পুঁথির পাণ্ডুলিপি: প্রাচীন পদ্মপুরাণ, গোবিন্দ কথামৃত ও হিরন্যকাশিপুর পুঁথির পাশাপাশি আছে দুষ্প্রাপ্য বইও। কিন্তু এসব মূল্যবান পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণের জন্য বেশ কয়েকবার চিঠিও দেওয়া হয়েছে গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরে।
গ্রন্থাগারটির সাবেক গ্রন্থাগারিক মো: রোকুনজ্জামান জানান, অধিদপ্তর থেকে ৪০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে পুঁথিসহ অন্যান্য বই সংরক্ষণে।
তবে সংরক্ষণের পদক্ষেপ নেওয়াতে ইতোমধ্যেই দেরি হয়ে গেছে। বগুড়া উডবার্ন সরকারি গণগ্রন্থাগারের সহকারি গ্রন্থাগারিক মো: আমির হোসেনের সঙ্গে কথা বলেও সেরকম তথ্যই পাওয়া গেছে।
তিনি জানান, তুলট কাগজে ১৪ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য এবং ৩ ইঞ্চি প্রস্থের দেবী মনসার প্রশংসা করে লেখা ৮০০ পৃষ্ঠার প্রাচীন পদ্মপূরান ইতোমধ্যেই নষ্ট হতে শুরু করেছে। প্রাচীন পুন্ড্রনগরীর অন্যতম রাজা গৌড় গোবিন্দের গুনকীর্তন করে ১০০০ পৃষ্ঠার সুবৃহৎ পুঁথি গোবিন্দ কথামৃত আর ভারতের মেদিনীপুর জেলার হিরন্যকাশিপুরের গুণবর্ণনা সম্বলিত ৭০০ পৃষ্ঠার হিরন্যকাশিপুর পুঁথির অবস্থাও একই রকম। প্রাকৃত, পালি ও সংস্কৃত ভাষায় লেখা এ পূঁথিগুলোর রচয়িতা শ্রী ভগবত জ্ঞানেন্দ্র কুমার ভট্রাচার্য। তিনি রাজকবি ছিলেন।
উপমহাশেরে আর কোথাও এসব পুঁথির অস্তিত্বের কথা এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। রচনার সময়কাল বিচারেও এইসব পুঁথি দুষ্প্রাপ্য ও মহামূল্যবান। কিন্তু উডবার্ন লাইব্রেরির মূল্যবান এই পুঁথিগুলোর কোনটিরই সংরক্ষণে কোনো উদ্যোগ কখনই নেওয়া হয়নি। গবেষকদের জন্য এই পুথি নিঃসন্দেহে মূল্যবান, পুঁথিগুলোর পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হলে রচনার সময়কাল কিংবার এই অঞ্চলের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ও গুরূত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে। একই সঙ্গে এ ধরনের প্রাচীন যে কোনো জাতির জন্যও অমূল্য সম্পদ।
গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের রাজশাহী বিভাগীয় পরিচালক মো: আবু সাইদ অবশ্য জানান, গুরুত্বপূর্ণ সব পান্ডুলিপি এবং বই সংরক্ষণে ইতোমধ্যেই উদ্দ্যোগ নেয়া হয়েছে। "সরকারি বরাদ্দ থেকে পাওয়া টাকার বেশির ভাগই দেয়া হচ্ছে বগুড়ায় ওই গ্রন্থাগারে থাকা সব পান্ডুলিপি ও বই সংরক্ষণে। তবে এখন পর্যন্ত সব বই আর পান্ডুলিপি সংরক্ষণ করা যায়নি। পর্যাক্রমে এসব পান্ডুলিপি ও দুষ্প্রাপ্য বই সংরক্ষণ করা হবে," বললেন মো: আবু সাইদ।
পুঁথিগুলো কীভাবে পাওয়া গেল? এ প্রশ্নের জবাবে গ্রন্থাগার সহকারি আনিছুল হক জানান, ২০১৩ সালে উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরি বগুড়া উডবার্ন সরকারি গণগ্রন্থাগারে একীভুত হবার পর অন্যান্য বইয়ের সঙ্গে পুঁথির পান্ডুলিপিগুলো এ লাইব্রেরিতে আনা হয়। কিন্ত তারও আগে উডবার্ন লাইব্রেরিতে এই দুস্প্রাপ্য পাণ্ডুলিপি কিভাবে এল সে সম্বন্ধে পরিস্কার কোনো তথ্য নেই।
গ্রন্থাগারের আরেক কর্মকর্তা সৈয়দ মোহাম্মাদ রেজানুল আলম জানান, উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরির পদ্ম নামে একজন পাঠক তার পূর্ব পুরুষদের কাছে থাকা এ অমূল্য সম্পদটি সংরক্ষনের জন্য উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরিতে দান করেন। তবে এর সমর্থনে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
১৮৫৪ সালে স্থানীয় গন্যমান্য ব্যক্তিদের সহযোগিতায় এই পাবলিক লাইব্রেরিটির গোড়া পত্তন হয়। পরে ১৯০৮ সালে জেলা কালেক্টর মি: জে এন গুপ্ত তদানীন্তন বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার জন উডর্বানের নামানুসারে এই লাইব্রেরির নাম রাখেন উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরি।
১৯৪৭ নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর বড় ভাই শরৎ চন্দ্র বসু, কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও কিরণশংকর দাসসহ অনেক মহান ব্যক্তি এই উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরিতে এসেছেন। বগুড়ার নবাব সৈয়দ আবদুস সোবহান চৌধুরী এ লাইব্রেরির জন্য একটি ভবন তৈরি করে দেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যরা লাইব্রেরির বিরাট ক্ষতি সাধন করেন। তারা যুদ্ধকালিন ক্যাম্পের খাবার রান্নায় জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার করে উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরীর প্রায় ১৮ হাজার বই। এ সময়ে আরও অসংখ্য দুষ্প্রাপ্য এবং মূল্যবান বই ক্ষতির মুখে পড়ে।
এই ক্ষতির পরেও এই লাইব্রেরিতে টিকে যায় ১৮৫৫ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত লেখক চার্লস কিংলির দুষ্প্রাপ্য বই দি হেরোস অফ গ্রিক ফেয়ারি টেইলস। অক্ষত রয়ে গেছে ১৯২৯ সালে প্রকাশিত শ্রী প্রভাস চন্দ্র সেনের লেখা বগুড়ার ইতিহাস। এই বইটি বগুড়ার ইতিহাস জানার জন্য সবচেয়ে প্রামাণ্য গ্রন্থ বলে বিবেচিত হয় এখন।
এর বাইরে এখনও এ লাইব্রেরিতে এমন অনেক দূর্লভ বই রয়েছে যা নিয়ে কোনো কাজ হয়নি। কোনো ক্যাটালগিং হয়েছে কিনা তাও কেউ নিশ্চিত করতে পারেনি। বইয়ের নামধাম পর্যন্ত অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে। বগুড়া উডবার্ন গণগ্রন্থাগারে এখন বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৪৫ হাজার।
করোনার কারণে গত ৭ মাস ধরে বন্ধ হয়ে আছে সরকারি এ গণগ্রন্থাগারটি। বন্ধ হবার আগে এ লাইব্রেরিতে প্রতিদিন গড়ে ১৫০ জন পাঠক আসতেন।