একাত্তরের ডিসেম্বর: ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে ঢাকা ডায়েরি
পিটার আর কান ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ কাভার করার জন্য নিয়োজিত ছিলেন। সে সময় তিনি ঢাকায় অবস্থান করেন এবং যুদ্ধের কারণে রিপোর্ট পাঠাতে না পারায় ঢাকা ডায়েরি লেখেন, যা পরে প্রকাশিত হয় এবং পিটার কানকে এনে দেয় পুলিৎজার পুরস্কার। ১৯৭৬ সালে তিনি দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এশিয়ার সম্পাদক ও প্রকাশক নিযুক্ত হন এবং ১৯৮৮ থেকেই তিনি মূল ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রকাশক। ১৯৯২ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত তিনি বিখ্যাত ডাউজোন্স অ্যান্ড কোম্পানির প্রধান নির্বাহী ও চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেন। ডাউজোন্স অ্যান্ড কোম্পানির প্রসারের কৃতিত্ব যেমন তাকে দেওয়া হয়, আর্থিক ধসের জন্যও পিটার কানকে দায়ী মনে করা হয়। পিটার কানের ঢাকা ডায়েরি ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত হয়।
শুক্রবার ৩ ডিসেম্বর
ঢাকা পূর্ব পাকিস্তান। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের এলিভেটরে উঠতে যাচ্ছি, এমন সময় অন্য একজন রিপোর্টার দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, 'আপনি কি জানেন যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে? তখনো রাত ৮টা বাজেনি। এলিভেটরে নোটিসটির ওপর চোখ পড়ল : সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৮টা ফুর্তির সময়, হ্যাপি আওয়ার্স, কেবল শুক্রবার বাদ। অন্যান্য সাংবাদিকের সঙ্গে সন্ধ্যার বাকি সময়টা কাটল দল বেঁধে শর্টওয়েভ রেডিও ঘিরে।
স্পষ্টত আজ অপরাহ্ণে ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্তে যুদ্ধ লেগে গেছে। ভারত বলেছে পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু করেছে, পাকিস্তান বলেছে ভারত। কে জানে? তবে দশ দিন ধরে ভারত পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে সীমিত আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। যখন যুদ্ধ লেগে যায় আর টেলিগ্রাফ অফিস বন্ধ থাকে, তখন আপনি কী আর করতে পারেন? পোকার খেলতে পারেন, ঘুমোতে যেতে পারেন।
শনিবার ৪ ডিসেম্বর
দিনটা শুরু হলো আগেভাগে, ভোর ৩টার দিকে। এয়ারপোর্টের আকাশে পাকিস্তানি উড়োজাহাজ বিধ্বংসী কামানের গোলায় অদ্ভুত আতশবাজি চলছে। ভারতীয় বিমানবাহিনীর আক্রমণ নাকি গোলন্দাজদের মহড়া। প্রশ্নটি তখনো অমীমাংসিত; কিন্তু সকাল নাগাদ ভারতীয় মিগ নিয়মিত রকেট আক্রমণ চালাতে শুরু করেছে। তখন আপনার মনে জাগতে পারে, ফটোগ্রাফার হলে ভালো ছিল। স্বচ্ছ নীল আকাশে মিগ ডাইভ দিচ্ছে। নিচ থেকে ছোড়া কামানের গোলার সাদা ধোঁয়াও দেখা যাচ্ছে। এমনকি হোটেলের ওপর আকাশে বেশ কটি ফলাফলশূন্য ডগফাইটও দেখা গেল। কয়েকটি ভারতীয় উড়োজাহাজ ভূপতিত হলো। কিন্তু সব পর্যবেক্ষকেরই নিজস্ব হিসাব রয়েছে। টেলিভিশনের একজন বলেছেন, 'পার্ল হারবারের চেয়ে ভালো করছে'। ঘণ্টায় ঘণ্টায় সারা দিনই আকাশপথে আক্রমণ চলতে লাগল।
মাথায় তালপাতা লাগিয়ে অন্যান্য মিশ্রিত লতাগুল্মের ক্যামোফ্লেজ করে রাস্তায় বেরোনো কয়েকটি সামরিক যানবাহন ছাড়া ঢাকা শহরের রাস্তা জনশূন্য হয়ে পড়েছে। রাস্তায় টহল দেওয়া পুলিশের মাথায়ও লতাপাতা বেঁধে রাখা হয়েছে। ঢাকার ডিপ্লোমেটিক কোরের ডিন নেপালের কনসাল অফিসে চলে এসেছেন। তিনি জানিয়েছেন, বিরাজমান সংকট নিয়ে পর্যালোচনার জন্য ডিপ্লোমেটিক কোরের একটি সম্মেলন ডেকেছেন, কিন্তু সংকটের কারণেই এটি বাতিল করেছেন।
রবিবার ৫ ডিসেম্বর
গতকালের চেয়ে অনেক বর্ণহীন একটি দিন। গতকালের চমৎকার আকাশ দৃশ্যের সঙ্গে কোনো কিছুরই তুলনা চলে না। চারদিকে অনেক গুজব রটছে। এর মধ্যে সবচেয়ে মুখরোচক ছিল ভারতীয় সশস্ত্র সেনাবাহিনী ঢাকা থেকে মাত্র ষাট মাইল দূরে। কেউ একজন ম্যাপ নিয়ে মেপে দেখাল ঢাকা থেকে পূর্বদিকে ভারতীয় সীমান্তের দূরত্ব ৬০ মাইলের কম। পাশ্চাত্যের যারা ঢাকায় আবাসিক ছিলেন, তারা সপরিবারে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে সমবেত হচ্ছেন। গুজব ছিল, জাতিসংঘের রিলিফ ফ্লাইট ব্যাংকক থেকে এসে বিদেশিদের উদ্ধার করবে। হোটেলের পানশালায় সন্ধ্যায় জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় গুজবটি সত্য বলে নিশ্চিত হওয়া গেল। একেবারে গ্রেগরি পেকের সিনেমার দৃশ্যের মতো পাকা চুলের একজন বিশিষ্ট জাতিসংঘ কর্মকর্তা জানালেন, আগে উদ্ধার করা হবে নারী ও শিশুদের। হোটেলের বার থেকে কেউ একজন ৩৫ ডলার দিয়ে এক বোতল স্কচ কিনলেন। মজুদ করার মতো ব্যাপার, সময়টা তেমনই।
একজন রিপোর্টার বললেন, সার্ত্রে থাকলে এখানে খনন শুরু করতেন।
কেন? নো এক্সিট। বেরোনোর পথ নেই।
সোমবার ৬ ডিসেম্বর
ঢাকা থেকে ৫০ মাইল পশ্চিমে সড়কপথে শিবালয়ের দিকে গেলাম। ধারণা হলো সরঞ্জামের অভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তান হারাতে বাধ্য। রাস্তার পাশে স্বল্পসংখ্যক সৈন্যবাহী গাড়ি থেমে আছে। রেডিয়েটর অতিরিক্ত গরম হয়ে গেছে কিংবা অন্য কোনো সমস্যা। যখনই সেনা কনভয় থামে কৃষকরা আশপাশের জমি থেকে পালিয়ে যায়। এখন পর্যন্ত পাকিস্তানি সৈন্যদের ট্রাক মানে মুক্তিবাহিনী অনুসন্ধান, গ্রামে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া এবং বেসামরিক জনগণ হত্যা। এখন আর এসব করার মতো সময় সেনাবাহিনীর নেই।
পরিহাস : যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় বাঙালিরা এখন আগের চেয়ে বেশি নিরাপদ।
রাতেই ইন্টারকন্টিনেন্টালে ফিরে আসি। হোটেলের সান্ধ্য আলফা : ঢাকা থেকে ১০ মিনিটের দূরত্ব পর্যন্ত এসে জাতিসংঘের উদ্ধারকারী উড়োজাহাজ ফিরে যাচ্ছে, কারণ ভারতীয় বিমানবাহিনী এয়ারপোর্টে আক্রমণ চালাচ্ছে। কাজেই একটি সাময়িক যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা দরকার। বিকেলবেলা জেনারেল রাও ফরমান আলী খান একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, পাকিস্তানি বাহিনী রসদ সরবরাহ সমস্যা মোকাবিলা করছে, সাময়িকভাবে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, কিছু সময়ের জন্য প্রতিরক্ষামূলক লড়াই করে যাচ্ছে। তিনি বলেছেন, পাকিস্তানের জন্য সর্বোত্তম প্রতিরক্ষা কৌশল হচ্ছে অগ্রসরমাণ ভারতীয় বাহিনীর কাছে কিছু জায়গা ছেড়ে দেওয়া। গত সপ্তাহে ফরমান আলীর বস জেনারেল নিয়াজি বলেছেন সর্বোত্তম প্রতিরক্ষা হচ্ছে আক্রমণাত্মক হওয়া; কিন্তু সময় বদলে গেছে।
মঙ্গলবার ৭ ডিসেম্বর
ঢাকা যুদ্ধের সঙ্গে বসবাস করতে শিখছে বলে মনে হচ্ছে বরং বলা যায়, যুদ্ধের হুমকির সঙ্গে। কারণ ভারত এপর্যন্ত শহরের বাইরের দিকটায় কয়েকটি সামরিক লক্ষ্যবস্তুর ওপর শুধু বোমাবর্ষণ করেছে। কিন্তু জনগণ বিচলিত হয়ে আকাশের দিকে তাকাচ্ছে। জাতিসংঘ আবার উদ্ধারকারী উড়োজাহাজ পাঠিয়েছে, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান উপকূলে সম্ভবত ভারতীয় নৌবাহিনীর গোলা সে উড়োজাহাজে আঘাত করেছে। এখানে আটকে পড়া পশ্চিমাদের মধ্যে ভারতের প্রতি সদয় খুব বেশি নেই।
হোটেলের লবিতে আমেরিকানদের কেউ কেউ জানতে চাইছেন, তাদের উদ্ধার করার জন্য আমেরিকান মেরিন কেন পাঠানো হচ্ছে না। একজন আমেরিকান বললেন, 'আমরা তো কঙ্গোতে তাই করেছি'। অন্যজন বললেন, এটা তো কঙ্গো নয়'। প্রথমজন বললেন, 'শিগগির এটা কঙ্গো হয়ে যাবে'।
আমি তখন এয়ারপোর্টের কাছে, বিমান হামলার সাইরেন বাজছে। আত্মরক্ষার জন্য গর্ত খুঁজতে ছুটি। আরও চারজন রিকশাওয়ালাও এসে আমার সঙ্গে যোগ দেয়। আমরা সবাই একটি খোঁড়াগর্তের কাছে এসে উপুড় হয়ে বসি, কেউই প্রথম গর্তে ঢুকতে চাচ্ছে না, তা ছাড়া এতে তিনজনের বেশি মানুষের জায়গাও হবে না। ততক্ষণে মাথার ওপর দিয়ে প্লেন চলে যায়। আমরা ভাগাভাগি করে একটি সিগারেট খাই।
পাকিস্তানি বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী সামরিক পরিস্থিতি অস্পষ্ট। একজন মার্কিন কূটনৈতিক বলছেন, পাকিস্তান বিপদে আছে, যেদিকে যেতে চায় সেখানেই সমস্যা। এখানে আটকে পড়া পিআইএর একজন পশ্চিম পাকিস্তানি পাইলটের সঙ্গে লাঞ্চ করলাম। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, কী করার পরিকল্পনা করছেন?' তার জবাব 'এখানেই মরব।' প্রায় সবাই ভাবছে শিগগির আর একটি ভীষণ রক্তপাতের ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। বাঙালিরা অবাঙালি সংখ্যালঘু বিহারি এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগসাজশকারীদের ওপর প্রতিশোধ নেবে। চোখের বদলে চোখ, বহু বিহারির চোখ যাবে।
গুজব রটেছে হোটেলে খাবার সরবরাহে ঘাটতি পড়েছে। মেন্যুর টেবিল কমে যাচ্ছে তবে খাবার এখনো যথেষ্ট সুস্বাদু এবং প্রচুর মাখনও মিলছে। হোটেল ড্যানিশ ডায়েরি প্রকল্পের সবই যুদ্ধের আগে কিনে নিয়েছিল। একজন বিদেশি জিজ্ঞেস করল, 'মানুষ কি কেবল মাখন খেয়ে বাঁচতে পারে?'
বিকেলে ভারতীয় বিমানের আরও আলামত চলল। অনেক ওপর থেকে বোমাবর্ষণ। এখন হোটেলের ছাদ (ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল) সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফারে পরিপূর্ণ। একজন ক্যামেরাম্যান সুইমিংপুল থেকে উঠে সেই পোশাকেই ওপরে চলে এসেছেন। একজন রিপোর্টার ছাদে চেয়ার নিয়ে এলেন। একজন কূটনীতিবিদ বললেন, যারা বাড়ি ছেড়ে এসেছে বিহারিরা সেসব বাড়িঘরে লুটপাট চালাচ্ছে! একটি সাধারণ অনুভূতি হচ্ছে, যতক্ষণ এমন অবস্থা বিরাজ করছে, বিহারিরা এটাকে মজা মনে করছে। একজন শান্তভাবে গণহত্যার কথা বললেন। গত নয় মাস বা তার কাছাকাছি সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পাঁচ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছে। পূর্ব পাকিস্তান হয়ে উঠেছে স্পঞ্জের মতো, সব ভোগান্তি শুষে নিচ্ছে। একজন কূটনৈতিক বললেন, বায়াফ্রাকে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর ছুড়ে দিন, এরপর আর খুঁজেও পাবেন না।
বুধবার ৮ ডিসেম্বর
সকালে নাশতার টেবিলের গুজব গতরাতে একটি ছোট উড়োজাহাজে জেনারেল নিয়াজি বার্মা পালিয়ে গেছেন। গত সপ্তাহে তিনি বলেছেন, যত ভারতীয় ঢুকবে তত ভারতীয় মারা যাবে। তাতেই আমার আনন্দ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা বুঝতে পারলাম নিয়াজির পালিয়ে যাওয়ার খবরটি সত্য নয়, তবে পালালেই ভালো হতো, এটা নিশ্চয়ই তিনি মনে করছেন।
সামরিক পরিস্থিতি এখনো অস্পষ্ট, তবে আমরা খবর পেয়েছি ভারতীয় বাহিনী ঢাকা থেকে ৩৫ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিম পর্যন্ত এগিয়ে এসেছে। দূতাবাস সূত্রে আমরা জেনেছি সামরিক পরিস্থিতি অভাবনীয় রকম খারাপ হয়ে আসছে। লড়াই এখন যেদিকে এগোচ্ছে, তাতে বাঙালিরা সন্তুষ্ট মনে হচ্ছে। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটতে এক সপ্তাহের বেশি সম্ভবত লাগবে না। জাতিসংঘ এখান থেকে উদ্ধার করার জন্য যে ফ্লাইট পাঠাবে, বলেছে তা সম্ভবত ভুলে গেছে। জাতিসংঘের লোকজন সব সময়ই সম্মেলন নিয়ে ব্যস্ত। এটা কৌতূহলের বিষয়Ñ ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে আটকে পড়া কয়েক শ মানুষের জন্য আমাদের মতোই না মনোযোগ। গত নয় মাসে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ মরেছে, এক কোটি সীমান্তের ওপারে শরণার্থীশিবিরে আটকা পড়ে আছে। কী কারণে কয়েক শ পাশ্চাত্যের মানুষ এত মূল্যবান হয়ে উঠল?
ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে বিমান আক্রমণ দেখতে যে ভিড় জমেছিল, তা কমতে শুরু করে। খবর এসেছে একজন ফটোগ্রাফারের নিতম্ব দেশে ধারালো কিছু ঢুকিয়ে দিয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানি সশস্ত্র বেসামরিক লোকে ইন্টারকন্টিনেন্টাল ভরে যাচ্ছে, তাতে হোটেলের অন্যান্য অতিথি অস্বস্তিবোধ করতে শুরু করেছে। রেডিওতে শোনা গেল প্রেসিডেন্ট নিক্সন বলেছেন, যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় সংবেদনশীল সমঝোতার সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে গেলে, সে সমঝোতায় পূর্ব পাকিস্তান কার্যত সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন পেয়ে যেত।
গত মার্চে বাঙালিরা 'কার্যত স্বায়ত্তশাসন'-ই দাবি করেছিল, কিন্তু এখন বড্ড দেরি হয়ে গেছে। টেলিভিশন সংবাদদাতারা গোপন খবর এনেছেন, রাতের বেলা গোপনে ছোট পাকিস্তানি উড়োজাহাজ ছাড়বে এবং সংগোপনে বার্মার কোয়ার এয়ারস্ট্রিপে অবতরণ করবে, পাইলট ফিল্ম ও খবরের কাগজ বহন করতে রাজি আছে। ফিল্ম একটি স্যুটকেসে ভরাই আছে, যেকোনো সময় হস্তান্তর করা যাবে। এক সপ্তাহের অনাকাক্সিক্ষত বহু ঘটনার আজ সন্ধ্যায় পোকার খেলার টেবিলে একটি মোমবাতির আলোয় আমরা মার্শাল ল'গুলোকে ভেজে নিলাম।
বৃহস্পতিবার ৯ ডিসেম্বর
নাশতার সময় একজন আমেরিকান ব্যবসায়ী বললেন, ক্রিসমাস কেনাকাটার মাত্র দশ দিন হাতে পাচ্ছি। কিন্তু এই ঝামেলা তো শেষ হচ্ছে না। অন্য একজন আমেরিকান ইনকাম-ট্যাক্স ফর্ম আনতে কনস্যুলেট অফিসে গেলেন। তিনি বললেন, 'আমি হয়তো আশাবাদী, কিন্তু কিছু একটা তো করতে হবে।' আতঙ্কিত মানুষও আছে। ধূসর লোমওয়ালা একটি কুকুর হোটেলে আটকে পড়া তার 'প্যারেন্টস' সঙ্গে আছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই কুকুরটাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হচ্ছে।
এটা নিশ্চিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পতন ঘটতে যাচ্ছে। নিয়াজির পালিয়ে যাওয়ার গুজবটি এখনো এ কান ও কান ঘুরছে। আমাদের খবর ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইউনিট ঢাকা থেকে কুড়ি মাইলের মধ্যে বসে পড়েছে। ভারতীয় বেতার বলছে, ঢাকা এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের সব প্রধান শহরের পতন ঘটেছে।
পাকিস্তানের বেতার তা নাকচ করে দিয়েছে। শোনা যাচ্ছে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে শহরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পজিশন নিচ্ছে। তারা যক্ষ্মা হাসপাতাল থেকে সব রোগী রাস্তায় বের করে দিয়ে সিট দখল করে নিয়েছে। আমরা গাড়ি নিয়ে শহরে বের হই, অল্পসংখ্যক সৈন্যের দেখা পাই, কিন্তু একজন পশ্চিম পাকিস্তানি পুলিশকে দেখলাম একজন বাঙালিকে লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে। তাদের আচরণের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি, আগের মতোই আছে। সবাই এটাই ভাবছেÑ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শেষ পর্যন্ত ঢাকা শহরের ওপর তাদের মরণ-কামড় বসাবে কি না। জাতিসংঘের কয়েকজন বলাবলি করছেন, পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সৈন্যদের শর্তযুক্ত আত্মসমর্পণের কথা চলছে। শর্ত হচ্ছে, পশ্চিম পাকিস্তানের নিরাপদে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ। কিন্তু সেই গ্যারান্টি কে দেবে?
আবাসিক এলাকা দেখতে বের হই, সেখানে গতরাতে তিনটি বোমা পড়েছে। এটা ছিল এতিমখানা। এখন তিনটি বড় গর্ত, গর্তের চারপাশে মাটি ও ধ্বংসাবশেষের পাহাড়। দেখলাম মাটি সরিয়ে কয়েকটি ছোট ছোট দেহ বের করা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত এতিমদের 'দেহ গুণে' সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে গেল।
আন্তর্জাতিক রেড ক্রস (জেনেভা) শেষ পর্যন্ত হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ও একটি হাসপাতালকে 'নিরপেক্ষ অঞ্চল'-এর ঘোষণা দিতে পেরেছে। সন্ধ্যাবেলায় রেড ক্রসের একটি দল এবং সাংবাদিকরা প্রত্যেক রুমে রুমে ঘুরে অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে এলো। মূলত এগুলো পশ্চিম পাকিস্তানি অতিথিদের কাছেই ছিল। মেয়েদের টয়লেটে বেশ কয়েক প্যাকেট বিস্ফোরক পাওয়া গেল। এগুলো হোটেলের লনে সরিয়ে আনা হয়েছে এবং বালির বস্তা দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। এর ফলে হোটেলের সুইমিংপুল বন্ধ করে দেওয়া হলো।
শুক্রবার ১০ ডিসেম্বর
নাশতার টেবিলে রাত ১০টার বোমাবর্ষণ নিয়ে কথাবার্তা, বোমা পড়েছে হোটেলের কাছাকাছি কোথাও। তুলনামূলকভাবে বেশি নিরাপদ মনে করে আরও অনেক বাঙালি ঢাকা শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে আশ্রয় নিচ্ছে। বাঙালি বন্ধু কান্নাভেজা চোখে অনেক উপশহরে বাঙালি হত্যাযজ্ঞের কাহিনী শোনাচ্ছে। তাদের মধ্যে 'কত যে শিশু' এই বলে তিনি ফোঁপাতে শুরু করেন। অবাঙালি সংখ্যালঘুরা অধিকতর নিরাপদ মনে করে গ্রাম ছেড়ে ঢাকা আসতে শুরু করেছে। ঢাকায় অবস্থানরত বাঙালিরা সবাই মনে করছে গত দুবার এতিমখানাসহ বেসামরিক যে বোমাবর্ষণ হয়েছে তার দায় ভারতের ওপর চাপানোর জন্য পাকিস্তানি উড়োজাহাজ থেকেই করা হয়েছে। বিশ্বস্ত বিদেশি সূত্র থেকে জানা গেছে, এগুলো মিগ থেকে নিক্ষেপ করা বোমা নয়, প্রাপলার-চালিত উড়োজাহাজ থেকে ফেলা; এমনকি বোমা রাখার জন্য তৈরি করা তাকও নিচে পড়ে গেছে। অবস্থাগত পরিবেশই সত্যের সাক্ষী দেয়। সবই মনে হচ্ছে ঠাণ্ডা মাথায় করা কাজ। কিন্তু একজন কূটনীতিবিদ বলেছেন, 'মার্চ থেকে যারা এখানে আছেন এবং দেখে আসছেন এ ধরনের কাজ যে পাকিস্তানিদের করা এ নিয়ে এতটুকুও সন্দিগ্ধ হবেন না।'
একটি গুজব খোলাসা হয়েছে। জেনারেল নিয়াজি হোটেলের গেটে দেখা দিয়েছেন, তার মানে তিনি যে বার্মাতে নেই এটা নিশ্চিত। রেডক্রসের নতুন বিধি অনুযায়ী তাকে বলা হয়েছে, তিনি তার অস্ত্র নিয়ে হোটেলে ঢুকতে পারবেন না। আটকে পড়া নাগরিকদের তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য পাকিস্তান ও ভারতের সঙ্গে জাতিসংঘের আলোচনা সফল হয়েছে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে। সন্ধ্যা ৬টা থেকে আগামী ২৪ ঘণ্টা কলকাতা-ঢাকা করিডরে অস্ত্রবিরতি কার্যকর করা হবে। উদ্ধারকারী উড়োজাহাজ অন্তত নারী ও শিশুদের নিয়ে আগামীকাল সকালে যাত্রা করার জন্য নির্ধারিত হয়েছে। তবে এ সিদ্ধান্ত তো আগেরই। যুদ্ধ শুরু হয়েছে ঠিক এক সপ্তাহ হয়ে গেল।
শনিবার ১১ ডিসেম্বর
সকালের মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাষ্ট্র তথ্যকেন্দ্রে (ইউসিস) বিস্ফোরণ। ধ্বংসাবশেষ আশপাশে একশ গজ পর্যন্ত ছড়িয়েছে। চারদিকে বইপত্র ছিটকে পড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে 'দ্য নিউক্লিয়ার ইয়ার্স' 'দ্য রোল অব পপুলার পার্টিসিপেশন ইন ডেভেলপমেন্ট'। ধ্বংস করার জন্য সবার অংশগ্রহণের দেশ এটি। কাজটা কি মুক্তিবাহিনী করেছে? লাইব্রেরিয়ান বললেন, যে লোকটা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, তার জবান উর্দু, পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষা। কে জানে, হতেও পারে। কয়েক মিনিটের মধ্যে ধ্বংসাবশেষের ভেতর থেকে সব বই লুট হয়ে গেল। একজন বৃদ্ধ তার বগলে করে নিয়ে গেলেন 'রিলিজিয়ন অ্যান্ড এথিকস' নামের একটি বই।
সারা দিনের বড় গুজব ডেপুটি মার্শাল ল' অ্যাডমিনিস্ট্রেটর জেনারেল রাও ফরমান আলী, তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর 'জেন্টেলম্যান জেনারেল' হিসেবে পরিচিত, পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর শর্তযুক্ত আত্মসমর্পণের লক্ষ্যে আপাতদৃষ্টিতে জাতিসংঘের সঙ্গে গোপন সমঝোতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আরও গুজব তার এই পদক্ষেপ এখানকার কমান্ডার জেনারেল নিয়াজি এবং প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান জেনে গেছেন। আজ থেকে আটকে পড়া নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার যে পরিকল্পনা ছিল, এসব ঘটনার প্রভাব তার ওপর পড়ে, আজ উড়োজাহাজ আসেনি। উড়োজাহাজ নিয়ে সমস্যার একটি কারণ ভারত চাচ্ছে রাজনৈতিক কারণে কলকাতা থেকে উড়োজাহাজ ঢাকায় যাক, আবার রাজনৈতিক কারণেই পাকিস্তান তা চাচ্ছে না।
আটকে পড়া বিদেশিরা ভাবতে শুরু করেছেন তারা এখন রাজনৈতিক জিম্মি। কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানাচ্ছে, শহরে আরও সৈন্য টেনে আনা হচ্ছে অথবা নিজেরাই তাদের সদর দপ্তরে ফিরে আসছে। শুনেছি এয়ারপোর্টে নিয়াজি একজন রিপোর্টারকে বলেছেন, 'আপনারা এখানে থেকে আমাকে মরতে দেখবেন।
'
আমেরিকান কনস্যুলেট অত্যন্ত বিষণ্ন অবস্থায় রয়েছে। কারণ আমেরিকা সমর্থন করেছে হারতে যাওয়া পক্ষকে। এর কূটনৈতিক পরিণতি ভুগতে হবে, অন্য কোনো পরিণতিও হতে পারে।
একজন পশ্চিমা কূটনৈতিক বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরিস্থিতি পুরো লেজে-গোবরে করে ফেলেছে। আজ অপরাহ্ণে শহরে কারফিউ বলবৎ করা হয়েছে। রাস্তা জনশূন্য। আমাদের ধারণা, শহরের তেরো লাখ মানুষের অর্ধেকের কম এখনো রয়ে গেছে।
রেডক্রস হোটেলে বৈঠক ডেকেছে। সভাপতিত্ব করেছেন একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিটিশ কর্নেল, এখন রেডক্রসের কর্মকর্তা। দেখতে নায়ক ডেভিড নিভেনের মতো। তিনি হোটেলবাসীদের বললেন, অসাধারণ গুজব, যা কিছু শুনতে পাচ্ছেন কোনোটাই কানে তুলবেন না। হোটেলের ওপরের তলাগুলোতে যারা থাকছেন, তারা কিছুটা নিচে নেমে আসতে চাইছেন।
হোটেলের নিরাপত্তা কর্মকর্তা মিস্টার বেগ বেশ ভালো একটা কাজ করেছেন, টয়লেটে পাওয়া বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয় করেছেন এবং এগুলো বিমান আক্রমণের সময় আত্মরক্ষার জন্য তৈরি একটি ট্রেঞ্চে ঢুকিয়ে মাটিচাপা দিয়েছেন, কাজেই সুইমিংপুল আবার খুলে দেওয়া হয়েছে। তখন হাততালি পড়ে। আবার সতর্ক করেও দেওয়া হয় বেয়নেটসহ বন্দুক সুইমিংপুল থেকে তোলা হয়েছে। কাজেই নিজ দায়িত্বে ড্রাইভ দিতে হবে।
সাংবাদিকরা পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে ফোন করে চলেছেন কোনো পাকিস্তানি বা ভারতীয় কোনো সেনাসদস্য তা ধরছেন কি না পরীক্ষা করতে চাচ্ছেন। অধিকাংশ ফোন লাইনই অচল, তবে আমরা খুলনা পেয়ে গেলাম। কয়েক দিন আগে ঢাকা থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমের এ শহরটি ভারতীয় বাহিনীর দখলে চলে আসে। কোনো এক সার্জেন্ট ফোন ধরেন। আমরা জিজ্ঞেস করি, ভারতীয়রা কোথায়? কাউবয় সিনেমার মতো জবাব, 'এখানে নেই'।
রবিবার ১২ ডিসেম্বর
কার্যত সারাদিনই কারফিউ। পুরো শহর নিস্তব্ধ, যেন কোনো মহামারি হঠাৎ শহরের সব মানুষ মেরে ফেলেছে, চারদিকে শুধু কালো কাক উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। অবশ্য এটা মহমারি নয়, এই শহরের জন্য মহামারির নামে আতঙ্ক। সি-১৩০ উড়োজাহাজ মাথার ওপর বৃত্তাকারে ঘুরছে, শব্দে আমরা জেগে উঠি। মনে হচ্ছে নারী ও শিশুদের তুলে নেওয়ার জন্য উদ্ধারকারী উড়োজাহাজ এসে গেছে। যদি উড়োজাহাজ ফিরে যায় তাহলে সঙ্গে আমার ডায়েরিটিও যাচ্ছে।
[তারপর মাত্র এক দিন, ডায়েরি ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল প্রতিনিধির কাছে পৌঁছে, পরদিন ১৪ ডিসেম্বর তা প্রকাশিত হয়। ঠিক দুদিন পর ১৬ ডিসেম্বর বিকেল বেলায় ঢাকা রেসকোর্সে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।]