অ্যালবার্ট এক্কা: মুক্তিযুদ্ধে শহীদ এক দুঃসাহসী যোদ্ধা
অ্যালবার্ট এক্কা নামটি কি আমাদের পরিচিত? হাতে গোনা কয়েকজনের হবে হয়তো। তিনি বাংলাদেশের মুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গ করা আনুমানিক চার হাজার ভারতীয় যোদ্ধার একজন। আমাদের ৩০ লাখ শহীদের মধ্যে সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ। সকলের জীবন ও রক্তের মূল্য একই। নিজ নিজ পরিবারের কাছে প্রতি শহীদের বিয়োগই একই রকম ব্যথাতুর ঘটনা। তবুও বিশেষ বীরত্বের কারণেই সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ দেশের সর্বোচ্চ সামরিক খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। তেমনি অ্যালবার্ট এক্কাও বিশেষ পরাক্রমের সঙ্গে যুদ্ধ করে কৃতিত্ব প্রদর্শন করার পর শহীদ হয়ে তিনি ভারতের সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব পরমবীর চক্রে ভূষিত হয়েছেন।
অ্যালবার্ট এক্কার জন্ম ভারতের ঝাড়খণ্ডের (তৎকালীন বিহার) এক আদিবাসী খৃষ্টান পরিবারে। পাহাড়-জঙ্গলে ছাওয়া ঝাড়খণ্ডের অন্য আদিবাসীরা মতো শিশু-কিশোর বয়েসেই অ্যালবার্ট শিকারে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। শিকার করতে করতে একসময়ে তার মনে সেনাবাহিনীর সদস্য হওয়ার আগ্রহ জন্মায়। ১৯৬২ সালে তিনি সেনাসদস্য হিসেবে বিহার রেজিমেন্টে যোগ দেন। প্রশিক্ষণের পর তাকে ১৪ গার্ড ব্যাটালিয়নে পোস্টিং দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বন্ধুপ্রতীম দেশ ভারত তাতে সরাসরি অংশগ্রহণ না করে অন্তরালে থেকে সকল সহযোগিতা করা শুরু করে। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী এবং তাদের তাঁবেদার ও সহযোগীদের দ্বারা সংঘটিত বর্বরোচিত জেনোসাইডের বিপক্ষে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার এবং ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারত সরকার এ দেশের মুক্তিকামী জনগণের পক্ষে বিশ্ববিবেক জাগ্রত করার জন্য সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
১৯৭১-এর নভেম্বর নাগাদ পরিষ্কার হয়ে ওঠে জঘন্য জেনোসাইড ঘটিয়েও বাঙালি জাতিকে দমানো যায়নি। মুক্তিযুদ্ধে পাকবাহিনীর পরাজয় তখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। পাকিস্তান তখন তৎপর হয়ে উঠেছে যুদ্ধবিরতি আদায় করে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে। এতে সরাসরি পরাজয় এড়ানো যাবে এবং মুক্তিযুদ্ধের বিষয়কেও ঝুলিয়ে রাখা সম্ভব হবে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার ও ভারতের কাছে তখন যুদ্ধবিরতি গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশ তখন মুক্তির দ্বারপ্রান্তে। জাতিসংঘে পাকিস্তানের অনুরোধে আনীত যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব বারবার আটকে দিচ্ছে সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব।
পাকিস্তান তখন আরেক দুর্বুদ্ধির আশ্রয় নিল। যুদ্ধকে পাক-ভারত যুদ্ধে রূপ দিতে এবং দুই শত্রুভাবাপন্ন দেশের মধ্যে যুদ্ধ প্রমাণ করে যুদ্ধবিরতি কায়েম করার মানসে তারা পশ্চিম ফ্রন্টে ডিসেম্বরের ৩ তারিখ ছয়টি ভারতীয় বিমানঘাঁটিতে অতর্কিতে আক্রমণ চালাল। সে সঙ্গে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী পাঞ্জাব থেকে গুজরাট পর্যন্ত পাক-ভারত স্থলসীমান্তের বিভিন্ন পূর্ব নির্ধারিত এলাকা দখলে এগোতে শুরু করল। ভারতের উপযুক্ত প্রস্তুতি থাকায় তাদের ব্লিৎজক্রিগ পদ্ধতি কার্যকর হয়নি। এদিকে পূর্বরণাঙ্গনেও ভারত প্রস্তুত ছিল। বিভিন্ন সুবিধাজনক স্থানে তারা তাদের সেনাবাহিনীর বিন্যাস ঘটিয়ে রেখেছিল।
অ্যালবার্ট এক্কার ১৪ গার্ড ব্যাটালিয়ন ভারতীয় ফোর্থ কোরের অধীনে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা এলাকায় মোতায়েন ছিল। বাংলাদেশের কুমিল্লার গঙ্গাসাগরে পাকবাহিনীর তখন শক্ত অবস্থান। গঙ্গাসাগর রেলওয়ে স্টেশনটি আখাউড়ার কয়েক কিলোমিটার দক্ষিণে ভারত সীমানার সন্নিকটে এবং আগরতলা শহর সেখান থেকে পাক গোলাবর্ষণের আয়ত্ত্বাধীন দূরত্বে। গঙ্গাসাগরে পাকিস্তানের অবস্থান থেকে কোনো হঠকারী আক্রমণ ঠেকাতে এবং বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর দেশের অভ্যন্তরে আক্রমণ সহজতর করতে ৩ ডিসেম্বরেই ভারতীয় ফোর্থ কোর সিদ্ধান্ত নেয় গঙ্গাসাগর পাক ঘাঁটি আক্রমণ করে দখলে নেওয়ার। দায়িত্ব দেওয়া হয় অন্যান্য সহকারী ফর্মেশনসহ অ্যালবার্ট এক্কার ১৪ গার্ডসদের। ততক্ষণে ইস্টার্ন ফ্রন্টে যুদ্ধের জন্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার নেতৃত্বে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনী গঠিত হয়েছে।
পরিকল্পনা মোতাবেক যুদ্ধ শুরু হলো। এগিয়ে গেল অ্যালবার্টের বাহিনী গঙ্গাসাগরে পাক ঘাঁটির দিকে গুলি ছুড়তে ছুড়তে। সুসংহত অবস্থান থেকে শুরু হলো অব্যাহত পাক গোলাবর্ষণ। উভয়পক্ষের বৃষ্টির মতো গোলাবর্ষণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হলো মাত্রাতিরিক্ত। একটি সম্মুখসারির পাক বাংকারের লাইট মেশিনগান ছিল সুবিধাজনক অবস্থানে। সেটিকে স্তব্ধ করা না গেলে ক্ষয়ক্ষতি আরও বেড়ে যাবে। বীরযোদ্ধা এক্কা চরম সিদ্ধান্ত নিলেন। শত্রুর তুমুল গুলিবর্ষণের মধ্যে তিনি ক্রলিংরত অবস্থান থেকে তীরবেগে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন পাক বাংকারে। বেয়নেট দিয়ে নিধন করলেন পাকযোদ্ধাকে। স্তব্ধ হলো প্রাণঘাতী মেশিনগান। বীরবিক্রমে এগিয়ে চলল ১৪ গার্ডস। এই লড়াইয়ে আহত হলেন এক্কা। রক্তক্ষরণ সত্ত্বেও বাহিনীর সঙ্গে এগিয়ে গেলেন তিনি।
এরপর সামনে নতুন বাধা। একটি পাকা দালানে স্থাপন করা মাঝারি পাল্লার একটা মেশিনগান তখন এক্কার বাহিনীর ওপর প্রবল গুলিবর্ষণ করে চলেছে। এটিকে থামাতে না পারলে পশ্চাদপসরণ অবশ্যম্ভাবী। আবারও ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ অ্যালবার্ট এক্কা। আহত ও পরিশ্রান্ত এক্কা একই সিদ্ধান্ত নিলেন — প্রবেশ করলেন মৃত্যুকূপে। আবারও হাতাহাতি লড়াইয়ে বেয়নেটবিদ্ধ করলেন মেশিনগান চালককে। গঙ্গাসাগর পাক ঘাঁটি দখলে আর বড় কোনো বাধা রইল না।
যুদ্ধ জয় হতে হতে আহত হওয়া অঙ্গের রক্তক্ষরণে প্রাণবিয়োগ হলো এই মহাপ্রাণ যোদ্ধার। তার ১৪ গার্ডসের মোট ১২ জন সেনা এ যুদ্ধে প্রাণ দেন। সেই রাতেই তাদের মরদেহ সহযোদ্ধারা নিয়ে আসেন ভারতীয় এলাকার ডুকলি নামক এক পাহাড়ি জঙ্গলাবৃত জায়গায়। ডুকলি বর্তমান আগরতলা রেলওয়ে স্টেশনের কাছে, আগরতলা শহরের ৪–৫ কিলোমিটার দক্ষিণে। এলাকাটি তখন জনবহুল ছিল না। স্বল্পসংখ্যক এলাকাবাসীর সহযোগিতায় ১২ জন শহীদের শেষকৃত্য করেন সহযোদ্ধারা। হিন্দু ধর্মাবলম্বী নয়জনকে দাহ করা হয়। তিনজন খৃষ্টানকে সমাধিস্থ করা হয়। ৪ তারিখ সকালেই সহযোদ্ধারা শেষকৃত্য সেরে যুদ্ধে ফেরেন। ১৬ই ডিসেম্বর জয়ের পর এলাকাবাসী তখনকার পায়ে চলার পথের ধারে তাদের সাধ্যানুযায়ী একটি সাধারণ স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করেন। সেটি এখনও দৃশ্যমান।
বীর অ্যালবার্ট এক্কা ভূষিত হন পরমবীর চক্র সন্মানে। পরবর্তীকালে তার নামে আগরতলার অন্যতম দৃষ্টিনন্দন পার্কের নামকরণ করা হয়। ভারত সরকার তার সম্মানে ডাকটিকিট প্রকাশ করে। তার নিজের ঝাড়খণ্ডে রাস্তা, চৌক (স্কোয়ার), মূর্তি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আজও অ্যালবার্ট এক্কার গুণগান গেয়ে চলেছে।
এদিকে তাদের ১২ জনের শেষকৃত্যের স্থানের কথা প্রায় সবাই ভুলে গেছে। কয়েক বছর আগে এক্কার বিধবা স্ত্রী ও একমাত্র পুত্র সন্তান অ্যালবার্টের স্মৃতিবিজড়িত স্থান দেখতে আগরতলায় আসেন। তখন তাদের ডুকলি নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। স্থানীয় জনৈক দাসবাবু শেষকৃত্যের জায়গাটির দিকনির্দেশনা দিতে পেরেছিলেন। এক্কার স্ত্রী ও পুত্র ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে সেখানে যান।
তাদের সঙ্গে থাকা সাংবাদিকদের মধ্যে ছিলেন প্রখ্যাত ভারতীয় সাংবাদিক শ্রী মানস পাল। তিনি বর্তমানে দৈনিক ত্রিপুরা টাইমস ও ত্রিপুরানেট ডটকম নামক দুই প্রিন্ট ও অনলাইন পত্রিকার সম্পাদক। আমার সুহৃদ এবং নিয়মিত লেখা প্রকাশ করে তিনি আমাকে প্রশ্রয় দেন। আমার সাম্প্রতিক আগরতলা সফরে তার সঙ্গে আমার দেখা হওয়ার কথা ছিল। তিনি যথাসময়ে এলেন। তার গাড়িতে ওঠার পর বললেন, 'আজকে আপনাকে অফিসে নিয়ে যাচ্ছি না। আমরা যাচ্ছিলাম একটা মহৎ কাজে। মনে হলো আপনাকেও সঙ্গে নিয়ে যাই।'
ভারতীয় কর্তৃপক্ষ স্থির করেছেন, এই বছর বিজয় দিবসের দিনে অ্যালবার্ট এক্কা এবং তার সঙ্গী শহীদ জওয়ানদের সন্মান দেখাবেন তাদের শেষকৃত্যের জায়গায়। সঠিক জায়গাটি চিহ্নিত করতে তারা মানসদার সহযোগিতা চেয়েছেন। সে যাত্রায় আমাকে সঙ্গী করায় আমি দাদার প্রতি অতিশয় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। ডুকলিতে অনেক অনুসন্ধানের পর সেই দাসবাবুর স্ত্রীকে পাওয়া গেল। দাসবাবু ইতোমধ্যেই পরলোকে। দিদি আমাদের নির্দিষ্ট স্থান দেখালেন। ৫২ বছর আগেকার জংলা জায়গা এখন জনবহুল। তবুও স্থানটি চিহ্নিত হলো।
আজ ১৬ ডিসেম্বর আগরতলা থেকে সাইকেল র্যালি ডুকলি যাবে। সমাধি ও শেষকৃত্যের জায়গায় পুষ্পস্তবক অর্পিত হবে। দেশাত্মবোধক গান, কবিতা, বক্তব্য হবে। যথাযোগ্য সম্মান দেখানো হবে মৃত্যুঞ্জয়ী বীরকে।
অ্যালবার্ট এক্কা অমর হোন।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।