এক চা-পাতায় ২১০ ধরনের চা বানান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশিক
- ফেসবুক ও ইউটিউব থেকে চা বানানো শিখেছেন আশিক।
- প্রতিদিন অন্তত ৫০০ কাপ চা বিক্রি করেন।
- চা বিক্রি করে আশিকের মাসিক আয় দেড় লাখ টাকা।
- দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ আসেন আশিকের চা খেতে।
সিলেটকে চায়ের দেশ বলা হলেও, চায়ে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশিকুর রহমান আশিক। এক চা-পাতা দিয়ে ২১০ ধরনের চা বানাতে পারেন এই তরুণ। শ্রীমঙ্গলের সাতরঙা চায়ের সুনামকে ছাপিয়ে আশিকের চকলেট কাজুবাদাম চা, স্ট্রবেরী কাজুবাদাম চা আর মালাই চায়ের মতো হরেক স্বাদ ও গন্ধের চায়ের সুখ্যাতি এখন সর্বত্র। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষজন আসেন আশিকের তৈরি চা খেতে। আর এই চা বিক্রি করেই মাসে প্রায় দেড় লাখ টাকা আয় করছেন আশিক।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার শাহবাজপুর ইউনিয়নের শাহবাজপুর গ্রামের হাবলিপাড়া এলাকার মৃত আলী হায়দার মিয়ার ছেলে আশিক ৭ ভাই-বোনের মধ্যে চতুর্থ। ২০০৩ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের হাল ধরেন আশিক। সেজন্য পড়াশোনায় বেশিদূর এগোতে পারেননি। অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় পড়াশোনাকে ইতি জানাতে হয় তাকে।
আশিক জানান, ২০০৬ সালে বাড়ির পার্শ্ববর্তী শাহবাজপুর বাসস্ট্যান্ডে ছোট্ট একটি চায়ের দোকান দেন তিনি। আগে দোকানে শুধু সাধারণ রং চা ও দুধ চা বিক্রি হতো। তবে বিভিন্ন দেশের হরেক স্বাদের চায়ের প্রতি আগ্রহ ছিল তার। সেই আগ্রহ থেকে এখন তিনি ২১০ ধরনের চা তৈরি করছেন। গত ১ বছর ধরে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভারত ও ইরানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রচলিত বিভিন্ন স্বাদের চা তৈরি করছেন বলে জানান আশিক।
প্রতিদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাশপাশি ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষজন আসেন আশিকের তৈরি চা খেতে। আশিকের এক কাপ চা যেন দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে আসা মানুষগুলোর সকল ক্লান্তি দূর করে দেয় নিমিষেই।
কেউ আসেন প্রিয়তমাকে সঙ্গে নিয়ে, আবার কেউ আসেন বন্ধু আর পরিবার নিয়ে। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত সরগরম থাকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক সংলগ্ন আশিকের ছোট্ট চায়ের দোকানটি। আশিকের সঙ্গে তার ছোট ভাই মাসুদ রহমানও চা তৈরি করেন। দুই ভাইয়ের তৈরি চায়ের মাধ্যমে তাদের এলাকার সুনামও ছড়িয়ে গেছে দেশের বিভিন্ন স্থানে।
আশিকের দোকানে এখন সবচেয়ে বেশি চলছে মালাই চা, শাহী কাজুবাদাম চা ও চকলেট কাজুবাদাম চা এবং লেমন ও মাসালা চা। এছাড়া ব্যাচেলর রং চা-ও তরুণদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে। আশিকের দোকানে তৈরিকৃত চা তৈরিতে ব্যবহৃত হয় গাভীর দুধ, মিল্ক পাউডার, ক্যাডবেরি চকলেট, স্ট্রবেরি, কাজুবাদাম, হরলিক্স, মাল্টোভা, আলুবোখারা, নাগা মরিচ, কাঁচামরিচ, মেথি, রসুন, তেঁতুল, লেবু, এলাচ ও দারুচিনিসহ বিভিন্ন উপকরণ। ধরনভেদে এক কাপ চায়ের দাম ৫ টাকা থেকে ১০০ টাকা।
প্রতিদিন গড়ে ৫০০-৬০০ কাপ চা বিক্রি হয় আশিকের দোকানে। সব খরচ বাদ দিয়ে দৈনিক ৪-৫ হাজার টাকা আয় হয় তার।
আশিকের দোকানে চা খেতে আসা মাদারীপুরের এনজিও কর্মকর্তা নরেন্দ্রনাথ জয়ধর বলেন, 'চাকরির সুবাদে সরাইলে আছি। প্রতিদিনই কয়েকবার আশিকের দোকানে আসি চা খেতে। তিনি খুব যত্ন করে চা বানান। তার চায়ের স্বাদ অন্য কোনো দোকানের চায়ে নেই। আমার কাছে মালাই ও লেমন চা বেশি ভালো লাগে'।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল-বিশ্বরোড় এলাকার তরুণ মো. ইমন জানান, শাহবাজপুর এলাকার এক বাসিন্দা তাকে আশিকের চায়ের দোকানে নিয়ে এসেছিলেন। চা ভালো লাগায় এখন নিয়মিত বন্ধুদের নিয়ে আসেন আশিকের দোকানে। একেক দিন একের স্বাদের চা খান বলে জানান তিনি।
শাহবাজপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. উজ্জল জানান, আশিকের চায়ের টানে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ এখন শাহবাজপুরে আসে। এতে করে এলাকার সুনাম ছড়াচ্ছে। অনেক পরিশ্রম করে আশিক এই খ্যাতি অর্জন করেছেন। ছেলে-বুড়ো সবার কাছেই সমান জনপ্রিয় আশিকের চা।
দুই শতাধিক চায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে আশিক বলেন, 'রং চা ও দুধ চা তো সব চায়ের দোকানেই পাওয়া যায়। মানুষকে আমার দোকানের চা খাওয়াতে হলে ব্যতিক্রম কিছু করতে হবে। সেই চিন্তা থেকেই ফেসবুক ও ইউটিউবে আমি চা সংক্রান্ত ভিডিওগুলো দেখতে থাকি। এভাবে ভিডিও দেখে শেখার পর নিজে বানানোর চেষ্টা করতাম। চেষ্টায় সফল হলে সেগুলো দোকানে চালু করতাম। এভাবে একটা একটা করতে করতে এখন ২১০ ধরনের চা বানাতে পারি'।
'মানুষজন খেয়ে যখন প্রশংসা করে, তখন আমার অনেক ভালো লাগে। আমার এখন স্বপ্ন চায়ের দোকানটা আরও বড় করা। কারণ প্রচুর মানুষজন আসে দোকানে। পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে চা খেতে হয়। এছাড়া নতুন আরও কয়েক স্বাদের চায়ের রেসিপি নিয়ে কাজ করছি', বলেন আশিক।
শাহবাজপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাজীব আহমেদ বলেন, 'আশিক তার নিজস্ব চিন্তা ও মেধার সমন্বয় ঘটিয়ে ২১০ ধরনের চা তৈরি করছে। তার মাধ্যমে শাহবাজপুর ইউনিয়নের নাম দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়েছে। সরকারের অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক দিয়ে যাত্রাপথে আশিকের দোকানে এসে চা খেয়ে যান। এটি আমাদের জন্য আনন্দের এবং গর্বের। আশিকের যে কোনো ধরনের প্রয়োজনে আমরা তাকে সহযোগিতার জন্য রয়েছি'।