করোনা মোকাবেলায় ভেন্টিলেটর সঙ্কট
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় অত্যাবশ্যকীয় যন্ত্রটির নাম ভেন্টিলেটর। অনেকেই হয়তো সারা জীবনে যন্ত্রটির নাম এই প্রথম শুনেছেন।
আক্রান্ত হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে রোগীর অবস্থা এমন এক ধাপে চলে যেতে পারে যে জীবন বাঁচানো কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে এই যন্ত্রটি ছাড়া।
বিশ্বজুড়ে এ পর্যন্ত সাড়ে তিন লক্ষ মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এবং মৃতের সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার জন।
সমস্যা হচ্ছে, সারা পৃথিবীতেই এরকম একটি কঠিন সময়ে এই ভেন্টিলেটরের প্রচণ্ড অভাব পড়েছে। আমেরিকাসহ ইউরোপের উন্নত ও ধনী দেশগুলোতেও যথেষ্ট সংখ্যায় এই যন্ত্রটি নেই।
কিন্তু কি সেই যন্ত্র? কেনই বা করোনা আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় যন্ত্রটি এত জরুরি? বিবিসির এক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে এর খুঁটিনাটি সব।
ভেন্টিলেটর কী?
করোনা ভাইরাস মানুষের ফুসফুসে আক্রমণ করে। কখনও কখনও এমন অবস্থা তৈরি হয় যে রোগী ঠিক মতো শ্বাস নিতে পারে না।
এসময় রোগীর দেহে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায়, বেড়ে যায় কার্বন ডাইঅক্সাইডের মাত্রা। ফলে রোগীর মস্তিষ্ক ও হৃদপিণ্ডের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ প্রত্যঙ্গও অচল হয়ে যেতে পারে।
এই জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে ভেন্টিলেটর।
এই যন্ত্রটি তখন নাক কিম্বা মুখের ভেতর দিয়ে অথবা গলায় ছিদ্র করে লাগানো টিউবের সাহায্যে ফুসফুসে অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং দেহ থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড বের কিরে নিয়ে আসে। কম্পিউটারের সাহায্যে এই যন্ত্রটি পরিচালনা করা হয়।
কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে পরস্থিতি গুরুতর হলে রোগীর নিউমোনিয়া হয়, ফলে তার ফুসফুসের নিচে অংশ পানি জমে যায় এবং তখন শ্বাস গ্রহণ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
ভেন্টিলেটর ছাড়া ওই রোগী তখন আর শ্বাস নিতে পারে না। যন্ত্রটি তখন ফুসফুস থেকে পানি ও রোগীর দেহ থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড বের করে নিয়ে আসে এবং ফুসফুসে অক্সিজেন সরবরাহ করে কৃত্রিমভাবে রোগীকে বাঁচিয়ে রাখে।
রোগী যতক্ষণ পযন্ত স্বাভাবিকভাবে নিশ্বাস গ্রহণ করতে না পারে ততক্ষণ ভেন্টিলেটর লাগানো থাকে। এসময় তিনি কথা বলতে পারেন না, মুখ দিয়ে কিছু খেতেও পারেন না। সেসময় তাকে টিউবের সাহায্যে খাবার দেওয়া হয়।
নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিনে প্রকাশিত একটি গবেষণা রিপোর্টে দেখা গেছে, চীনে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের পাঁচ শতাংশকে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে চিকিৎসা দিতে হয়েছে এবং তাদের অর্ধেক সংখ্যক রোগীকে কৃত্রিম যন্ত্রের সাহায্যে শ্বাস প্রশ্বাস গ্রহণ করতে হয়েছে।
বলা হচ্ছে, সারা বিশ্বে যত মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবেন তার ১০% থেকে ২০% রোগীকে আইসিইউতে চিকিৎসা করানোর প্রয়োজন হতে পারে। এবং তাদের অনেকেরই বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন হবে এই ভেন্টিলেটরের।
কিন্তু পৃথিবীজুড়ে ভেন্টিলেটরের সঙ্কট
ধারণা করা হয় একটি ভেন্টিলেটর তৈরি করে বাজারে ছাড়তে সাধারণত দুই থেকে তিন বছর সময় লেগে যেতে পারে। এর দামও হয় প্রচুর। একটি ভেন্টিলেটর কিনতে খরচ হয় পায় ৫০ হাজার ডলার।
একারণেই অনেক কোম্পানি যাকে তাকে দিয়ে ভেন্টিলেটর তৈরির ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
নিউ ইয়র্ক টাইমস বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের সমস্ত হাসপাতালে সব মিলিয়ে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার ভেন্টিলেটর আছে। জরুরী সময়ের জন্যে মজুত রাখা আছে আরো প্রায় ১২,৭০০ ভেন্টিলেটর।
স্বাভাবিক সময়ে ভেন্টিলেটরের এই সংখ্যা যথেষ্ট কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান সঙ্কটে এর চাইতেও আরো বহু গুণে ভেন্টিলেটরের প্রয়োজন।
আমেরিকান হসপিটাল এসোসিয়েশনের হিসেবে বিশ্ব-মহামারির সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৯ লাখ ৬০ হাজার মানুষের ভেন্টিলেটর প্রয়োজন হতে পারে।
আর ব্রিটেনে এনএইচএসের হিসেবে সারা দেশে আছে ছয় হাজারের মতো ভেন্টিলেটর। তার মধ্যে বড়দের জন্য পাঁচ হাজার আর শিশুদের জন্যে আছে ৯০০।
ব্রিটিশ স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমান সঙ্কট মোকাবেলায় জরুরি ভিত্তিতে তাদের আরো ২০,০০০ ভেন্টিলেটর প্রয়োজন।
জার্মানির মিডিয়াতে বলা হচ্ছে, দেশটিতে বর্তমানে ভেন্টিলেটরের সংখ্যা ২৫,০০০। সরকার স্থানীয় একটি কোম্পানি ড্র্যাগারকে আগামী বছরের মধ্যে আরো ১০,০০০ ভেন্টিলেটর তৈরি করতে বলেছে।
ইটালির সংবাদ মাধ্যমেও বলা হচ্ছে যে দেশটির হাসপাতালগুলোতে এই যন্ত্রটির বড় রকমের ঘাটতি রয়েছে। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে পশুর জন্যে তৈরি ভেন্টিলেটর মানুষের জন্যে কাজ করে কীনা সেটাও পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।
একারণে ইতালিতে, যেখানে স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থা অত্যন্ত উন্নত ও আধুনিক, সেখানেও এই যন্ত্রটির অভাবে বহু মানুষকে চিকিৎসা করা সম্ভব হয়নি।
সেখানে ডাক্তারদেরকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে কোন রোগীকে এই যন্ত্রটি দেওয়া হবে এবং কাকে দেওয়া হবে না।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশের হাসপাতাল থেকেও বলা হচ্ছে যে শুধুমাত্র ভেন্টিলেটর না থাকার কারণে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত অনেক রোগীর জীবন হুমকির মুখে পড়েছে।
এই পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশের সরকার জরুরি ভিত্তিতে ভেন্টিলেটর কিনতে চাইলেও সরবরাহের অভাবের কারণে এতো অল্প সময়ের মধ্যে এই যন্ত্রটি কেনা সম্ভব হচ্ছে না।
নিউ ইয়র্ক শহরের মেয়র বিল ডে ব্ল্যাসিও-ও সতর্ক করে দিয়েছেন যে আগামী দশদিনের মধ্যে হাসপাতালগুলোতে ভেন্টিলেটরসহ চিকিৎসা সামগ্রী ফুরিয়ে গেলে পরিস্থিতি মারাত্মক দিকে চলে যেতে পারে।
নিউ ইয়র্ক টাইমসকে হ্যামিলটন মেডিকেল নামের একটি কোম্পানির প্রধান নির্বাহী বলেছেন, বাস্তবতা হচ্ছে বর্তমান বিশ্বের হাতে যথেষ্ট সংখ্যক ভেন্টিলেটর নেই।
হ্যামিলটন মেডিকেল সুইজারল্যান্ডের একটি কোম্পানি এবং সারা বিশ্বে যেসব প্রতিষ্ঠান ভেন্টিলেটর তৈরি করে তাদের মধ্যে এটি শীর্ষস্থানীয়।
"ইতালিতেও আমরা সেটা দেখেছি, দেখেছি চীনেও। আমরা ফ্রান্সসহ অন্যান্য দেশেও একই অবস্থা দেখেছি," বলেন তিনি।
ইতালিতে সিয়ার নামের যে কোম্পানি ভেন্টিলেটর তৈরি করে তাদেরকে সহায়তা করার জন্যে সরকার ওই কোম্পানিতে প্রকৌশলী ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দক্ষ কর্মকর্তাদের পাঠিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারা পৃথিবীতে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ যে হারে ও যতো দ্রুত গতিতে বাড়ছে - তাতে ভেন্টিলেটরের এই সংখ্যা খুবই নগণ্য।
উন্নত দেশগুলো ভেন্টিলেটর তৈরি করবে বলছে
সেকারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের ধনী দেশগুলোর সরকার যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মতো করে ভেন্টিলেটর উৎপাদনের কথা বিবেচনা করছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেন যেভাবে জরুরী ভিত্তিতে স্পিটফায়ার যুদ্ধবিমান তৈরি করেছিল, এখন ঠিক একইভাবে ভেন্টিলেটর উৎপাদনের কথাও বলা হচ্ছে।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ইতোমধ্যেই গাড়ি নির্মাণকারী ও ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আহবান জানিয়েছেন জরুরী ভিত্তিতে ভেন্টিলেটর উৎপাদনের জন্য।
নিসান, রোলস রয়েস, ফোর্ড, ম্যাকলারেন, টেসলা, হোন্ডাসহ বিশ্বের বিভিন্ন কোম্পানি ইতোমধ্যেই ঘোষণা করেছে যে তারা এই যন্ত্রটি উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে।
ভেন্টিলেটর কীভাবে তৈরি করা হয়
জীবন রক্ষাকারী ভেন্টিলেটর যন্ত্রটি খুবই জটিল। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কয়েকশো যন্ত্রাংশ দিয়ে এটি তৈরি করা হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কোম্পানি আলাদা আলাদাভাবে এসব যন্ত্রাংশ উৎপাদন করে থাকে। ফলে ভেন্টিলেটরের উৎপাদন হঠাৎ করেই বাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়।
ভেন্টিলেটর প্রস্তুতকারক ছোট্ট একটি কোম্পানি অ্যালাইড হেলথকেয়ার প্রডাক্টস, যারা বছরে এক হাজার ভেন্টিলেটর তৈরি করে, তার প্রধান নির্বাহী আর্ল রেফসলান্ড বলেছেন, "এসব ভেন্টিলেটর মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। আমরা তো গাড়ির চাকা তৈরি করছি না। ফলে এর উৎপাদনে সময় লাগবে।"
তাই কতোটা দ্রুততার সঙ্গে এই যন্ত্রটি তৈরি করা সম্ভব হবে তা নিয়ে অনেক কোম্পানি সংশয় প্রকাশ করেছে। কারণ এই যন্ত্রটি তাৎক্ষণিকভাবে তৈরি করা সম্ভব হয়। এটি তৈরি করতে দক্ষতার প্রয়োজন।
তৈরি করা হলেও সেটিকে দীর্ঘ সময় ধরে পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়ার পরেই বাজারে ছাড়া হয়।