কেন সবার পছন্দ মামা হোটেল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আশপাশে শিক্ষার্থীদের প্রিয় খাবারের জায়গার তালিকা যদি করা হয়, একদম শুরুর দিকেই থাকবে মামা হোটেলের নাম।
ক্যাম্পাসের ভেতরেই বিভিন্ন হলসহ ডাকসু, টিএসসির ক্যাফেটেরিয়া, বিভিন্ন অনুষদের নিজস্ব ক্যান্টিন, কার্জন পেরিয়ে চাঁনখারপুলে নানা ধরনের ভাত ও বিরিয়ানির দোকানের সমাহার সত্ত্বেও, নীলক্ষেতের গাউসুল আজম মার্কেটে অবস্থিত মামা হোটেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মনে দখল করে নিয়েছে স্বতন্ত্র স্থান।
কম দামে মুখরোচক খাবার, হোটেলের কর্মচারীদের আন্তরিক ব্যবহার আর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ – এই তিনের সমন্বয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীদের কাছে মামা হোটেল হয়ে উঠেছে আস্থা ও ভালোবাসার অপর নাম।
মামা হোটেলের হদিস পাওয়া খুব সহজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণ পেরিয়ে ডান দিকে গেলে নীলক্ষেত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও নীলক্ষেত হাই স্কুলের ঠিক উল্টো পাশেই গাউসুল আজম মার্কেট। সেই মার্কেটেরই ডানপাশের গলি ধরে একটু সামনে এগোলেই চোখে পড়বে মামা হোটেলের সাইনবোর্ড। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলে আবিষ্কার করবেন, ভোজনরসিকদের পদচারণায় গমগম করছে গোটা হোটেল। সেই সঙ্গে খাবারের গন্ধে ম ম করছে পরিবেশ।
মোটামুটি মাঝারি মাপের হলরুমের মতো ঘরে খাওয়ার ব্যবস্থা। ছয় জন বসার ব্যবস্থা এক-একটি টেবিলে। একসঙ্গে ৬০ জনের মতো স্থান সঙ্কুলান হয়। লাঞ্চ ও ডিনারের 'পিক আওয়ারে' স্বাভাবিকভাবেই প্রচণ্ড ভিড় থাকে হোটেলে। ফলে ঢোকামাত্রই বসার জায়গা পাওয়া বিরল ব্যাপার। চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করতে হয়, কখন খালি হবে কোনো টেবিল।
কিন্তু যদি কিছুক্ষণ ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে পারেন, তবে টেবিল আপনি পাবেনই। আর টেবিলে বসতেই হোটেলের কর্মচারীরা আপনাকে স্বাগত জানাবেন মরিচ ভর্তা, ডাল ভর্তা, সবজি আর পাতলা ডাল পরিবেশনের মাধ্যমে। এসব খাবার দেখে ও ঘ্রাণ শুঁকে আপনার পেটের মধ্যে ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা খিদে যে আরও চাগিয়ে উঠবে, সে কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
"এসব তো আমরা চাইনি!" বলতে হোটেলে প্রায় ২০ বছর ধরে কর্মরত মতিউর রহমান নির্ভয় দিয়ে বলেন, "কাস্টমাররা যে খাবারই অর্ডার দেন না কেন, সেগুলোর সঙ্গে এই আইটেমগুলো কমপ্লিমেন্টারি।" অর্থাৎ, এগুলোর জন্য বাড়তি টাকা গুনতে হবে না আপনাকে।
পোলাও, বিরিয়ানি বা তেহারি পাওয়া না যাক, সাদা ভাতের সঙ্গে নানা পদের মাছ-মাংসই মামা হোটেলের প্রধান আকর্ষণ। সেগুলোর দামও একদমই হাতের নাগালে। ভাত প্রতি প্লেট ১০ টাকা। এছাড়া হাঁসের মাংস ১২০ টাকা, লইট্টা ফ্রাই ১২০ টাকা, মুরগির ঝাল ফ্রাই ১০০ টাকা, খাসি বা গরুর মগজ ভুনা ১২০ টাকা, রুই মাছ ১০০ টাকা, রুই মাছের ডিম ১০০ টাকা, বোয়াল মাছ ১২০ টাকা, শোল মাছ ১২০ টাকা, চিংড়ি ১৫০ টাকা, কবুতরের মাংস ১৫০ টাকা, রূপচাঁদা মাছ ১৫০ টাকা, কোয়েলের মাংস ১০০ টাকা। সব মিলিয়ে রোজ কম করে হলেও ১৮-১৯ পদের রান্না হয়। ক্রেতাদের সামনে রয়েছে যেকোনো পদ 'আনলিমিটেড' পরিমাণে নেওয়ার সুযোগ।
সকাল সাড়ে এগারটা থেকে রাত সাড়ে এগারটা পর্যন্ত হোটেলে লেগে থাকে জনসমাগম। তবে রাত বারোটা-একটার সময়েও পেটে খিদে নিয়ে হাজির হন অনেকে। মামা হোটেল হতাশ করে না তাদের কাউকেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে সব শ্রেণি-পেশার ক্রেতাদের সঙ্গেই বন্ধুর মতো আচরণ করেন দোকানের কর্মচারীরা। মতিউর জানান, "আমরা মোট ১৮ জন কর্মচারী আছি। এদের মধ্যে দুজন বাবুর্চি আর দুজন বুয়া। কাস্টমারদের মধ্যে বেশিরভাগ ঢাবি, ঢামেক আর বুয়েটের শিক্ষার্থীই থাকেন।"
মামা হোটেলে খেতে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আরউইন আহমেদ বলেন, "হলের একঘেয়ে খাবার থেকে মুক্তি পেতেই এখানে আসি। আশপাশের অন্যান্য হোটেল থেকে এখানে খাবারের দামটাও কম। এদের খাসির মগজ ভুনা আমার প্রিয় আইটেম।"
দামে কম মানে ভালো বিচিত্র ধরনের খাবারগুলোই তার সবচেয়ে পছন্দের বলে জানান আরউইন।
এদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের আরেক শিক্ষার্থীর কাছে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায় মামা হোটেলের পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। তিনি বলেন, "আমাদের মেডিকেল কলেজের সামনে-পেছনে অনেক খাবারের দোকানই আছে। এছাড়া চাঁনখারপুলও তো একদম কাছেই। তবু বন্ধু-বান্ধব নিয়ে মামা হোটেলে আসি এখানকার পরিবেশটা ভালো বলে।"
শিক্ষার্থী ছাড়াও নীলক্ষেতসহ আশপাশের এলাকার আরও বিভিন্ন পেশার মানুষেরই সমাগম ঘটে মামা হোটেলে। সেরকমই একজন নীলক্ষেতের একটি বইয়ের দোকানের কর্মচারী সোহেল।
তিনি বলেন, "দুপুরে বাসা থেকে খাবার না আনলে এই হোটেলের খাবারই আমার একমাত্র ভরসা। ভাতের সাথে ইচ্ছামতো নানা আইটেম নিয়ে পেট ভরে খাওয়া যায় আবার দামটাও খুব বেশি না।"
খাবার শেষে বিল দেওয়ার সময় দরাদরি করে দাম কিছুটা কমানো যায়, এমন 'গোপন তথ্য'ও ফাঁস করেন তিনি।
এতক্ষণে নিশ্চয়ই আপনার মনে প্রশ্ন জেগেছে, এ হোটেলের নাম মামা হোটেল কেন? সেই প্রশ্নের জবাব পেতে হলে, আগে জানতে হবে কছিম উদ্দিন নামের এক বাবুর্চির কাহিনি। এই মানুষটির হাত ধরেই যে গোড়াপত্তন মামা হোটেলের।
সাভার থেকে আসা কছিম উদ্দিন স্বাধীনতার আগে থেকেই কারওয়ান বাজার, আইসিএমএ ক্যান্টিনসহ নানা স্থানে খাবার বিক্রি করতেন। স্বাধীনতার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের সামনের রাস্তায় খিচুড়ি বিক্রি শুরু করেন। এরপর আসেন গাউসুল আজম মার্কেটের সামনের রাস্তায়। সেটা ৩২ বছর আগের কথা। এখানে থাকতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে 'মামা' নামে পরিচিতি পান তিনি। আর তার হোটেলকে সবাই ডাকতে শুরু করে 'মামা হোটেল' নামে।
১৯৯৯ সাল থেকে গাউসুল আজম মার্কেটের দোতলার বর্তমান ঠিকানায় ঘাঁটি গেড়েছে মামা হোটেল। সময়ের সাথে সাথে এর খ্যাতি ও পরিচিতি কমেনি বরং ক্রমশই আরো বেড়েছে।
সাত বছর আগে, ২০১৪ সালে কছিম উদ্দিন মারা যান। সেই থেকে হোটেলের দেখাশোনার দায়িত্ব নেন তার তিন ছেলে - আসলাম উদ্দিন রাজু, তাইজুল ইসলাম সাজু ও হৃদয় হোসেন রানা। তবে তিন ভাই মিলে হোটেল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করলেও, কিঞ্চিৎ অবদান রয়েছে তাদের মা আসমা বেগমেরও। একসময় হোটেলের বাজার-সদাইয়ে প্রয়াত স্বামীকে সাহায্য করতেন তিনি। সেই অভ্যাস বজায় রেখেছেন আজও। ব্যাটে-বলে মিললে এখনও হোটেলের বাজার-সদাইয়ের খোঁজখবর রাখেন তিনি।
কথা হয় বর্তমানে হোটেলের অন্যতম স্বত্বাধিকারী ও ব্যবস্থাপক হৃদয় হোসেন রানার সঙ্গে। হোটেলের বিক্রিবাট্টা সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা দেন তিনি। "রোজ ভিড় অনুযায়ী ১০-১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। পহেলা বৈশাখের মতো উৎসব থাকলে ২৫-৩০ হাজারের মতোও বিক্রি হয়ে যায়।"
মামা হোটেলের ঠিক পাশে তো বটেই, এছাড়া নীলক্ষেতের বইয়ের বাজারেও গত কয়েক দশকে গড়ে উঠেছে আরও অসংখ্য খাবার হোটেল। তারপরও ভাটা পড়েনি মামা হোটেলের জনপ্রিয়তায়। দুপুর ও রাতে খাবার সময়ে হোটেলে দেখা যাওয়া উপচে পড়া ভিড় থেকেই মেলে সেই প্রমাণ।
হোটেলের এমন জনপ্রিয়তার রহস্য কী জানতে চাইলে রানা অকপটে বলেন, "কাস্টমারদের আপ্যায়নের যে ব্যবস্থা আমার বাবা শুরু করেছিলেন, তাতে কোনো কমতি আসতে দেইনি আমরা তিন ভাই। কাস্টমারদের মুখে মুখেই আমাদের মামা হোটেলের সুনাম ছড়ায়।"
তবে করোনাকালে অন্য সব ব্যবসার মতো ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে মামা হোটেলকেও। সে প্রসঙ্গেও কথা হয় রানার সঙ্গে।
"করোনার শুরু থেকে এতদিন বন্ধ থাকায় অনেক লস হয়ে গেল। এ বছর জুলাই থেকে হোটেল খুললেও এতদিন ভার্সিটি বন্ধ থাকায় তেমন কাস্টমার পাইনি। ভার্সিটি খোলার পর থেকে কাস্টমার বাড়ছে।"
তবে কতদিনে করোনাকালের ক্ষতি পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারবেন, জানেন না রানা।
অবশ্য যত ক্ষতিই হোক, অদূর ভবিষ্যতে পৈতৃক ব্যবসায় পাততাড়ি গোটানোর কোনো পরিকল্পনা নেই রানা বা তার ভাইদের। নিজেদের 'ব্র্যান্ড ভ্যালু' সম্পর্কে এতটাই আত্মবিশ্বাসী তারা যে, ব্যবসা সম্প্রসারণের চিন্তাভাবনাও করছেন এখন।
"খুব তাড়াতাড়িই চাঁনখারপুলে আমাদের নতুন শাখা খোলার কথা চলছে। মামা হোটেলের সুনাম বজায় রেখে আরো এগিয়ে যেতে চাই আমরা।"