কোভিড-১৯: টিকার তৃতীয় ডোজ কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
২০২০ সালের ৯ ডিসেম্বর, এদিন কোভিড-১৯ টিকার প্রথম ডোজ নেন ৯১ বছরের মার্গারেট কেনান ও ৮১ বছরের উইলিয়াম শেক্সপিয়ার। উইলিয়ামের নামে যেমন বিখ্যাত কবির সঙ্গে মিল, ঠিক তেমনি থাকেনও কবির জন্মস্থান ওয়ারউইকশায়ারে। তিনি ও মার্গারেট দুজনই ছিলেন ক্লিনিক্যাল ট্র্যায়ালের বাইরে বিশ্বের প্রথম কোভিড টিকাপ্রাপ্ত পুরুষ ও নারী।
বয়োবৃদ্ধদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দেওয়া হয় যুক্তরাজ্যে, বিশ্বে প্রথম কোভিড টিকা অনুমোদন ও নির্দিষ্ট জনসংখ্যাকে দেওয়া শুরু করেছিল দেশটি।
উইলিয়াম ও মার্গারেটের টিকাগ্রহণ ছিল আনন্দঘন ও উদযাপনের মুহূর্ত। এসময় কক্ষে উপস্থিত সকল স্বাস্থ্যকর্মী জোর করতালির মাধ্যমে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন।
এ দিনটিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্র শক্তির বিজয়ের দিন, বা নাৎসি জার্মানির হাত থেকে ইউরোপের মুক্তি দিবসের অনুকরণে 'ভি-ডে' নাম দেওয়া হয়।
গণমাধ্যমের উচ্ছ্বাসও ছিল লক্ষ্যণীয়, একটি ব্রিটিশ দৈনিক মজার শিরোনামে এ ঘটনাকে 'ফ্লু'কে বশ মানানো' বলে উল্লেখ করে। প্রথম টিকাগ্রহীতাদের ছবি দ্রুতই সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। আর বিশ্ব গণমাধ্যমে ফেলে তুমুল সাড়া। সকলেই ভেবেছিলেন টিকা আসায় মহামারির বিরুদ্ধে যুদ্ধ বুঝি শেষ, যদিও এটা ছিল প্রথম পদক্ষেপ মাত্র।
ওই ঘটনার ৯ মাস পর এপর্যন্ত প্রায় ৫৭০ কোটি ভ্যাকসিনের ডোজ বিশ্বব্যাপী দেওয়া হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এতে বিশ্বের অন্তত ৪১.৮ শতাংশ মানুষ কিছুটা হলেও সুরক্ষা পেয়েছেন। তবে দিন দিন টিকা ও করোনাভাইরাস নিয়ে নতুন নতুন তথ্য সামনে আসছে, বাড়ছে অজানার পরিধিও।
ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনের ইমিউনোলজির অধ্যাপক ড্যানি অ্যালটম্যান বলেন, "এ মহামারির সবচেয়ে বিচ্ছিরি দিক হলো, আমাদের সিদ্ধান্তে মানুষ বিভ্রান্ত ও ক্ষুদ্ধ হচ্ছেন। কারণ, কোভিড-১৯ এমন একটি পরিবর্তনশীল লক্ষ্যবস্তু যে আমার মতো বিজ্ঞানীদের প্রায়শই নতুন নতুন পরামর্শ দিতে হচ্ছে।"
সোজা কথায়, আগামী বহু বছর কোভিড-১৯ ও এর ধরনগুলো বিশ্বকে নতুন ধাঁধার মুখে ফেলতে থাকবে- এমন সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিত। এ প্রেক্ষাপটে টিকার দুই ডোজই যথেষ্ট কিনা- এটি পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে দেখা দিচ্ছে।
বিষয়টির ব্যাখ্যা করে অ্যালটম্যান জানান, গত এপ্রিল ও মে মাসে তিনি নিজের লেখা বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে টিকার দুই ডোজ গ্রহণই যথেষ্ট হবে বলে দৃঢ় যুক্তি দেন। টিকা নেওয়া বেশিরভাগ মানুষ রোগ থেকে সুরক্ষিত ও তাদের অতিরিক্ত ডোজ নিতে হবে না- বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ভাইরাসের জৈবিক পরিবর্তনের কারণে এসব কথাকে এখন আহাম্মকি বলে মন্তব্য করেছেন এ বিজ্ঞানী।
"তখন ভেবেছিলাম টিকার কল্যাণে শরীরে হাজারগুণ বেশি আন্টিবডি তৈরি হওয়ায় ভাইরাসের নতুন ভেরিয়েন্ট কোন ক্ষতি করবে না।"
বিশ্বে প্রথম অনুমোদিত ফাইজার-বায়োএনটেক ও মর্ডানা টিকার কার্যকারিতাও সেসময় অত্যন্ত ইতিবাচক বলে প্রমাণিত হয়। খোদ জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও ৫০ শতাংশর উপর কার্যকর কোনো টিকার অনুমোদনকে সমর্থন দেয়। কিন্তু, কোভিড-১৯ মহামারি বিজ্ঞানের প্রচলিত তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে; তৈরি হয় সার্স কোভ-২ ভাইরাসের মারাত্মক সব ভেরিয়েন্ট।
ডেল্টা ভেরিয়েন্টের ভয়ঙ্কর প্রাদুর্ভাব- বাংলাদেশ, ভারত, ইন্দোনেশিয়াসহ কিছু দেশে মৃত্যুর মিছিল সৃষ্টি করে, এপর্যন্ত ১৮০টির বেশি দেশে এর সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে।
এমনকি টিকাপ্রাপ্তরাও সুরক্ষিত নন, তাদের মধ্যে সংক্রমণের ঘটনাকে বলা হয়- ব্রেক থ্রু কেস, অভিযোজিত ভাইরাস টিকা প্রদত্ত সুরক্ষা কবচের ব্যূহ ভেদ করায় এ নামকরণ।
অ্যালটম্যান বলেন, এখন আমরা সন্তোষজনক মাত্রার অ্যান্টিবডি গড়ে ওঠাদের দেহেও ব্রেক থ্রু সংক্রমণ লক্ষ্য করছি।
বিশ্বব্যাপী দেওয়া হয়েছে অনেকগুলো সংস্থার তৈরি কোভিড-১৯ টিকা। একেকটির কার্যকারিতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও ভিন্ন।
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, এবার কী টিকাপ্রাপ্তদের মৃত্যুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে? সার্বিকভাবে টিকার বুস্টার ডোজ কতোটা কার্যকর এবং সেটি দেওয়ার সেরা উপায় কী?
সবচেয়ে বড় সমস্যা তৈরির করেছে বিভিন্ন বয়সের জনসংখ্যার পরিবর্তনশীল রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা, তাই হিসাবে ভুল হলে, কারো কারো দেহের বিদ্যমান রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৃতীয় ডোজের ফলে আরও কমে যাবে, তাত্ত্বিকভাবে এমন সম্ভাবনাও রয়েছে।
প্রাথমিক টিকাদান আর বুস্টার ডোজ দেওয়ার কর্মসুচি একেবারেই ভিন্ন দুটি উদ্যোগ।
অ্যালটম্যান বলেন, "প্রথমটি খুবই সহজ। মানব ট্রায়ালে আমরা বিভিন্ন বয়সের মানুষের দেহে টিকা নেওয়ার ফলে রোগ প্রতিরোধ গড়ে উঠছে কিনা- তা পর্যবেক্ষণ করেছি। কিন্তু, বুস্টার ডোজের ক্ষেত্রে বিষয়টি বেশ জটিল।"
সুরক্ষিত নয় টিকাদানে এগিয়ে থাকা দেশও:
পৃথিবীজুড়ে যখন টিকার ডোজ নিয়ে হাহাকার, তখনই গণ-টিকাদান শুরু করে ইসরায়েল। মধ্য মার্চ নাগাদ প্রায় ৫০ শতাংশ ইসরায়েলিকে সম্পূর্ণরুপে বা দুই ডোজ টিকা দেওয়া সম্পন্ন হয়।
ফলে মে নাগাদ বিশ্বের সবচেয়ে কম সংক্রমণ হার দেখা যায় ইহুদিবাদী রাষ্ট্রটিতে। এক মাস পর মহামারি পরিস্থিতির উন্নতির কারণে জনজীবনে আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া শুরু করে সরকার।
কিন্তু তখনই ডেল্টা ভেরিয়েন্টের উদয় হয়। ৭ জুলাই প্রথম ডেল্টা সংক্রমণ শনাক্ত হলেও, পরবর্তী এক মাসে কয়েক হাজার ব্যক্তি আক্রান্ত হয়।
চলতি সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ইসরায়েলে দৈনিক ১০ হাজার নতুন সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। জনসংখ্যার মাথাপিছু হারে যা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি।
সংক্রমণের নাটকীয় বৃদ্ধির জন্য মারাত্মক প্রথমে ডেল্টা ভেরিয়েন্টকেই দায়ী করা হচ্ছিল, কিন্তু তখনই এমন এক গবেষণার তথ্য জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের বিস্মিত করে।
টিকাপ্রাপ্ত জনসংখ্যার ওপর পরিচালিত ওই গবেষণায় ইসরায়েলি বিজ্ঞানীরা দেখেন, এসব ব্যক্তির গুরুতর অসুস্থতার ঝুঁকি কম হলেও, সময়ের সাথে সাথে টিকা প্রদত্ত রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হচ্ছে।
যেমন যারা গত জানুয়ারিতে দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন এখন তাদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি, যারা দুই মাস পর নিয়েছেন তাদের থেকে ১.৭ গুণ বেশি।
অ্যালটম্যান বলেন, "এর মানেই টিকা অকার্যকর তা নয়, বরং টিকাহার বেশি এমন জনগোষ্ঠীর মৃত্যুহার কম হয়। কিন্তু, অভিযোজনশীল রোগের বিরুদ্ধে লড়াই চাইয়ে যাওয়ার গুরুত্ব এখানে উঠে এসেছে।"
বৈশ্বিকভাবে এখন হানা দিয়েছে করোনাভাইরাসের চতুর্থ ঢেউ। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোয়, স্কটল্যান্ড, জাপান ও ফিলিপাইনে রেকর্ড সংখ্যায় সংক্রমণ ধরা পড়েছে। ইউরোপের কিছু দেশেও বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। এমন বাস্তবতায়, ক্ষয়শীল রোগ প্রতিরোধ- পুরো বিশ্বের জন্যেই সার্বজনীন সমস্যায় রূপ নিচ্ছে।
তাই বিশ্বব্যাপী বুস্টার ডোজ দেওয়ার কর্মসূচিও নতুন মাত্রা পাচ্ছে। ইসরাইয়েলে গত জুলাইয়ের শেষে ৬০ বছরের বেশি বয়স্কদের তৃতীয় ডোজ টিকাদানের অনুমোদন দেওয়া হয়। বয়োবৃদ্ধদের পর এখন অন্যান্য বয়সীদেরও দেওয়া হচ্ছে। ৫০ বছরের বেশি বয়সীদের তৃতীয় ডোজদানের ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাজ্য ও সিঙ্গাপুর।
গত ১৩ আগস্টের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রেও সংক্রমণের বেশি ঝুঁকিতে থাকা লাখ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে। চীন, রাশিয়া ও ইতালির মতো দেশও তাদের বুস্টার টিকাদানের কার্যক্রম গতিশীল করেছে।
- সূত্র: বিবিসি