গবেষণা খাতে ব্যাপক ক্ষতির পূর্বাভাসে শঙ্কিত আফগান বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদেরা
১৫ই আগস্ট সকালে ভূতাত্ত্বিক হামিদুল্লাহ ওয়াইজি কাবুলের খনি ও পেট্রোলিয়াম মন্ত্রণালয়ে চাকরি প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন। সাক্ষাৎকারের মাঝখানে তাকে জানানো হয়, তালেবানরা শহরে প্রবেশ করেছে এবং তাকে তৎক্ষণাৎ মন্ত্রণালয় থেকে বের হয়ে যেতে হবে। পরদিন সকালে রাস্তায় সশস্ত্র জঙ্গিদের দেখতে পান তিনি।
এর কিছুদিন আগেই মন্ত্রণালয়ের খনি অনুসন্ধান প্রকল্পের মহাপরিচালক নিযুক্ত হওয়া কাবুল পলিটেকনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষক রাজধানীকে এত দ্রুত তালেবানের দখলে চলে যেতে দেখে বেশ অবাকই হয়েছিলেন। কাবুল পতনের পর থেকেই একরকম নির্লিপ্ত জীবনযাপন করছেন ওয়াইজি। নিরাপত্তার ভয়ে বাড়িতে বসেই দিন কাটাচ্ছেন এই গবেষক।
কাবুলজুড়ে বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারি অফিস এখনো বন্ধ আছে। তালেবান বলেছে, তারা চায় সব ধরনের অফিসই সচল থাকুক। কিন্তু, এসব অফিস কীভাবে সচল থাকবে, সেটি এখনও স্পষ্ট নয়।
ওয়াইজি বলেন, "আমাদের ভবিষ্যৎ খুবই অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে।"
মৌলবাদী গোষ্ঠীটি যখন সর্বশেষ ১৯৯৬-২০০১ সালে আফগানিস্তান শাসন করেছিল, তখন এ অঞ্চলে ইসলামী শরিয়া আইনের একটি রক্ষণশীল সংস্করণের নিষ্ঠুর প্রয়োগ দেখেছিল গোটা বিশ্ব। নারী অধিকার থেকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সবকিছুই দমন করেছিল উগ্রবাদী সংগঠনটি।
তবে ২০০১ সালে তালেবানরা উৎখাত হওয়ার পর আন্তর্জাতিক তহবিলে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল আফগানিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
এখন আবারো নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে ভয়ে আছেন আফগান শিক্ষাবিদরা। তারা এটা ভেবেও উদ্বিগ্ন যে, অর্থ এবং ব্যক্তি-স্বাধীনতা ছাড়া সব রকমের গবেষণা বন্ধ হয়ে যাবে এবং শিক্ষিত লোকজন সবাই পালিয়ে যাবে। আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে জড়িত থাকার জন্য, অধ্যয়নের ক্ষেত্রের জন্য, জাতিগত বৈষম্য এবং আরও নানা কারণে নির্যাতিত হতে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে।
মুছে যেতে পারে দুই দশকের অর্জন:
কাবুলের কাতেব বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানী আতাউল্লাহ আহমদী বলেন, "গত ২০ বছরে আমরা যা কিছু অর্জন করেছি, তার সবই এখন বড়সড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।"
আফগানিস্তান সরকারের কোটি কোটি ডলারের বৈদেশিক তহবিল ইতোমধ্যে আটকে দিয়েছে মার্কিন সরকার ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল। এই তহবিল কবে ছাড়া পাবে এবং তহবিলের অর্থ বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণায় কতটুকু যাবে, সেটা এখনো অনিশ্চিত। অনেক শিক্ষাবিদই জানিয়েছেন, তারা আর বেতন পাচ্ছেন না।
২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার পর মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট আফগানিস্তান দখল করে নেয়, এবং তালেবান সরকারকে উৎখাত করে। ২০০৪ সালে আমেরিকা সমর্থিত একটি নতুন নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব নেয় আফগানিস্তানের।
কাবুলের আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অফ আফগানিস্তানের (এইউএএফ) সাবেক সভাপতি, কেনেথ হল্যান্ড জানান, ২০০৬ সালে যখন তিনি প্রথম আফগানিস্তানে আসেন, তখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোন গবেষণাই হচ্ছিল না।
তবে ২০০৪ সাল থেকে বিশ্বব্যাংক, ইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো শিক্ষাদান, অনুষদদের প্রশিক্ষণ এবং গবেষণার জন্য শত শত কোটি ডলার অর্থ সহায়তা দিয়েছে আফগানিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে।
২০১০ সালের পর থেকে দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটিতে প্রায় তিন ডজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত বা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এবং এর পাশাপাশি স্থাপন করা হয় আরও দশটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।
হল্যান্ড জানান, আন্তর্জাতিক দাতাদের অর্থায়নে ও উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হয় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালিত হয় শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি'র উপর নির্ভর করেই। তবে এইউএএফ মূলত মার্কিন অর্থায়নেই পরিচালিত হয়।
শিক্ষা ও গবেষণা খাতে আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিসমাপ্তি?
২০০১ সালে আফগানিস্তানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল মাত্র আট হাজার। ২০১৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল এক লাখ ৭০ হাজারে, যার মধ্যে এক-চতুর্থাংশ ছিল নারী শিক্ষার্থী।
আন্তর্জাতিক জার্নালগুলোয় আফগানিস্তানের উপস্থিতি কম থাকলেও স্কোপাস ডেটাবেসে যেখানে ২০১১ সালেও আফগানদের মাত্র ৭১টি গবেষণা ছাপানো হয়েছিল, ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ২৮৫টিতে।
কিন্তু তালেবানের অধীনে উচ্চশিক্ষা, বিজ্ঞান এবং গবেষণায় আবার স্থবিরতা চলে আসবে বলেই ভয় পাচ্ছেন সবাই।
জিএফজেড জার্মান রিসার্চ সেন্টার ফর জিওসাইন্সের বিজ্ঞানী নজিবুল্লাহ কাকর বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই "বাইরের বিজ্ঞানীরা আফগানিস্তানকে একটি ব্ল্যাকহোল বলে মনে করতেন"।
উচ্চশিক্ষার জন্য বাইরে গিয়েও দেশ গড়তে আবার আফগানিস্তানে ফিরে আসা দেশপ্রেমিকদের একজন কাকর। ২০১৪ সালে মাটির নিচের ভূতাত্ত্বিক প্লেটগুলো অধ্যয়নের জন্য আফগানিস্তানের প্রথম সিসমিক নেটওয়ার্ক ইন্সটল করতে সাহায্য করেছিলেন তিনি। ২০১৯ সাল পর্যন্ত এই কাজ চালিয়ে যান তিনি। যুদ্ধের জন্য প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাতায়াত করা কঠিন হয়ে পড়লে কাজ ছাড়তে বাধ্য হন এই বিজ্ঞানী।
তিনি এবং তার দল প্রাকৃতিক দুর্যোগের ব্যাপারে মানুষকে সতর্ক করতে আফগানিস্তানে একটি ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু কাবুল পতনের পর থেকে এই দলের সবাই এখন আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন।
কাকার আরও বলেন, গত কয়েক দিন ধরে দুশ্চিন্তায় ঘুমোতে পারছেন না তিনি। সহকর্মীদের দেশ থেকে বের করে আনতে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন বলেও জানান এই বিজ্ঞানী।
হুমকির মুখে শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানীরা:
কাকারের সহকর্মীদের মতো আরও হাজার হাজার আফগান গবেষক বর্তমানে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় চাইছেন।
হুমকিতে থাকা শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানীদের নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে দিতে সাহায্য করা মার্কিন প্রতিষ্ঠান স্কলারস অ্যাট রিস্ক (এসএআর)-এর পরিচালক রোজ অ্যান্ডারসন জানান, শুধুমাত্র আগস্ট মাসেই আফগানিস্তান থেকে ৫০০টিরও বেশি আবেদন পত্র জমা পড়েছে এসএআরে।
শরিয়া আইনের ব্যাখ্যার সাথে বিরোধ করলে সাজার মুখোমুখি হতে পারেন বলে ভয় পাচ্ছেন অনেক আইনবিদ। আবার নারী অধিকার কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার জন্য তালেবানের লক্ষ্যবস্তু হতে পারেন বলে ভয় পাচ্ছেন অনেক নারী। মহিলাদের শিক্ষাদান বা তত্ত্বাবধানের জন্য শাস্তি পেতে পারেন, এনিয়ে ভয় পাচ্ছেন অনেক পুরুষ। এছাড়া, যারা বিদেশে পড়াশুনা করেছেন, বা যাদের কোনোরকম আন্তর্জাতিক সংযোগ আছে তারাও তালেবানের লক্ষ্যবস্তু হতে পারেন বলে ভয় পাচ্ছেন।
বিশ্বব্যাপী ১৬৪টি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে আফগান শিক্ষাবিদদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য সম্মত হয়েছে বলে জানান অ্যান্ডারসন। তিনি আরও জানান, তার প্রতিষ্ঠান এসএআর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় বিভিন্ন সরকারের কাছে দ্রুত ভিসা দেওয়ার এবং উদ্ধার ফ্লাইট অব্যাহত রাখার জন্য আবেদন জানিয়েছে।
কিন্তু, দূতাবাস বন্ধ থাকায় ও কাবুল বিমানবন্দরে নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকায় লোকজনকে বের করে আনা কঠিন হয়ে পড়েছে। যে কারণে অনেকেই ঝুঁকি নিয়ে আফগানিস্তানে বাস করছে।
এই পরিস্থিতিতে এইউএওএফের গবেষকরা বিশেষভাবে দুর্বল বলে দাবি করেন হল্যান্ড। বিশ্ববিদ্যালয়টি এর আগেও জঙ্গি হামলার শিকার হয়েছিল। ২০১৬ সালের সেই হামলায় অনুষদ সদস্য, কর্মচারী এবং শিক্ষার্থীসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ১৩ জন নিহত হন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬০ জন অ-আফগান কর্মচারীকে সরিয়ে নেওয়া হলেও ৪০০ জন স্থানীয় কর্মচারীর মধ্যে মাত্র ২০ জন দেশ ছাড়তে পেরেছেন এরমধ্যে। হল্যান্ড বলেন, এদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০০ জন শিক্ষার্থী এবং এক হাজারেরও বেশি এলামনাই তালেবানের লক্ষবস্তু হতে পারে।
সাহায্যের জন্য প্রার্থনা:
আফগান বিজ্ঞানীরা দেশে গবেষণার ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তিত। তালেবানরা যে গবেষণাকে অগ্রাধিকার দিবে না সেটা বলেই দেওয়া যায়। আর আন্তর্জাতিক মহলের আর্থিক সহায়তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও চলতে পারবে না বলে মনে করছেন অনেকে।
আফগানিস্তান সায়েন্স একাডেমির সদস্য ও কাবুল-ভিত্তিক এক বিজ্ঞানী নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, হাজারো আফগানীর মতো তৃতীয়বারের মতো তিনি এবং তার পরিবার তাদের সবকিছু হারাতে যাচ্ছেন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের আক্রমণের পূর্বে, ৭০'র দশকের অস্থিরতার সময় প্রথমবার দেশ ছেড়েছিলেন তিনি। ৯০'র দশকে প্রথমবারের মতো তালেবান ক্ষমতা দখল করলে আবার দেশ ছাড়েন। বর্তমানে আবারও দেশের বাইরে আশ্রয়ের খোঁজ করছেন তিনি ও তার পরিবার।
"একজন মানুষের জন্য এভাবে জীবনযাপন করাটা খুব কঠিন। আপনি যুদ্ধের মাঝে জন্মেছেন, যুদ্ধের মাঝে বড় হয়েছেন এবং এখন যুদ্ধের মাঝেই মারা যাবেন," বলেন তিনি।
স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী অনেকেই ইতিমধ্যে পালিয়ে গেছেন। তিনি বলেন, "আফগানিস্তানের ভবিষ্যতের জন্য একটি বড় বিপর্যয় এটি। দেশে কোন শিক্ষিত লোকই থাকবে না।"
কাবুল-ভিত্তিক এই বিজ্ঞানী আরও বলেন, তাদের একাডেমিতে প্রায় ২০০ জন পণ্ডিত ও ১৬০ জন অন্যান্য কর্মচারী কর্মরত ছিলেন, যাদের জন্য বার্ষিক বাজেট ছিল ৩০ কোটি আফগানী (প্রায় ৩০ কোটি টাকা)। কিন্তু তালেবানরা তাদের ভীত শক্ত করার পর গত দুই মাসে কোনো বেতনই পাননি এখানকার সিংহভাগ কর্মচারী।
আহমদী বলেন, "পুরো সিস্টেমই প্রায় অচল হয়ে পড়েছে।"
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আফগানিস্তানের নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দিবে কিনা এবং গবেষণা খাতে তহবিল প্রদান অব্যাহত রাখবে কিনা- তা এখনো স্পষ্ট নয়। গবেষকরা আশা করছেন, তারা পরিত্যক্ত হবেন না।
"আমরা আমাদের সমস্ত অর্থ, শক্তি এবং সময় ব্যয় করেছি আফগানিস্তানে নিজেদের এবং আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যতকে উজ্জ্বল করার জন্য। কিন্তু এ ধরনের (তহবিল) প্রত্যাহারের মাধ্যমে তারা আমাদের সমস্ত জীবন, আমাদের সব আশা এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে ধ্বংস করে দিয়েছে," বলেন স্থানীয় এক প্রভাষক।
- সূত্র: নেচার ডটকম