চীনা নারীদের গোপন ভাষা
বেলেপাথরের পাহাড়, নদী অববাহিকা, ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন ধানক্ষেতের মিশেলে এক অনন্য সুন্দর লীলাভূমি চীনের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের হুনান প্রদেশ। এই অঞ্চলের ৮০ শতাংশের বেশি অঞ্চল পাহাড়ি; গ্রামগুলোর উন্নয়নও হয়েছে ধীরে ধীরে। এখানেই পৃথিবীর শুধু নারীদের তৈরি এবং শুধু নারীদের ব্যবহার্য লিখন পদ্ধতি 'নিউশু'র উৎপত্তি।
নিউশুর আভিধানিক অর্থ 'নারীদের হস্তলিপি'। হুনান প্রদেশের জিয়াংইয়ং অঞ্চলের হান, ইয়াও এবং মিয়াও জাতির নারীরা এই ভাষা প্রথম ব্যবহার শুরু করেন। তৎকালীন নারীরা সুবিধাবঞ্চিত থাকায় নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্যই মূলত এই ভাষার উৎপত্তি।
অনেক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সং রাজবংশের সময়কাল (৯৬০- ১২৭৯) কিংবা ৩০০০ বছর পূর্বের শাং সাম্রাজ্যের সময়ে এই ভাষার উৎপত্তি।
সামন্ততান্ত্রিক সমাজে কৃষিজীবী পরিবারের মায়েদের মাধ্যমে এই হস্তলিপি বংশানুক্রমে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ব্যবহার করে। সে সময় নারীদের শিক্ষার সুযোগ ছিল না; সব ধরনের সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত জীবন কাটাতেন তারা। এই ভাষা আয়ত্ব করার জন্য হস্তলিপি দেখে দেখেই তারা অনুশীলন করতেন।
কালের পরিক্রমায় নিউশুর মাধ্যমে নারীদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, যা এখনো চলমান।
হাজার বছর ধরে
হাজার বছর ধরে জিয়াংইয়াং অঞ্চলের বাইরে এই ভাষা অপরিচিত ছিল। ১৯৮০-এর দশকে বহির্বিশ্বের মানুষ প্রথম এই ভাষার ব্যাপারে জানতে পারে।
এই ভাষা ব্যবহারকারী সর্বশেষ পরিচিত স্থানীয় নারীর মৃত্যুর ১৬ বছর পর বর্তমানে এটি আবারও জনসম্মুখে এসেছে। শিয়াও নদী পরিবেষ্টিত পুওয়েই গ্রামে আবারও ভাষাটির চর্চা শুরু হয়েছে।
গ্রামটির বাসিন্দা শিন হুর মতে, এক সময় পুওয়েই গ্রামের আশেপাশের চারটি শহরে ও ১৮টি গ্রামে ব্যাপকভাবে ভাষাটির প্রচলন ছিল।
১৯৮০র দশকে বিশেষজ্ঞরা ২০০ বাসিন্দার গ্রাম পুওয়েইতে তিনজন নিউশু লেখকের সন্ধান পাবার পর গ্রামটি নিউশু গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। ২০০৬ সালে স্টেট কাউন্সিল অব চায়না কর্তৃক হস্তলিপিটি ন্যাশনাল ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ তালিকায় স্থান পায়। তার এক বছর পরই গ্রামটিতে জাদুঘর খোলা হয়। সেখানে শিন হু ভাষাটিতে দক্ষ আরও ৭ জনের সঙ্গে কাজ শুরু করেন।
হস্তলিপির চিহ্ন
হস্তলিপির প্রতিটি চিহ্ন একটি অক্ষর নির্দেশ করে। বাঁশের সূঁচালো কাঠি দিয়ে লেখা হয় অক্ষরগুলো। জিয়াংইয়াং অঞ্চলের চারটি উপভাষার সংমিশ্রণ দেখা যায় এই হস্তলিপিতে।
নারীদের পারিবারিক ও সামাজিক বঞ্চনার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার উপায় হিসেবে কাজ করে এই হস্তলিপি। এর মাধ্যমেই নারীরা আশেপাশের গ্রামের নারীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতেন; নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতেন।
রুমাল, মাথার স্কার্ফ, হাতপাখা, তুলার বেল্টসহ বিভিন্ন ব্যবহার্য জিনিসে এই লিপির মাধ্যমে নিজেদের অনুভূতি আদান-প্রদান করতেন তারা। এই হস্তলিপি শুধু লেখার জন্য ব্যবহৃত হলেও অনেকেই সামাজিক অনুষ্ঠানে এর ব্যবহার করে গান গাইতেন, কবিতা পড়তেন। অনেক বয়স্ক নারী আত্মজীবনীমূলক গানের মাধ্যমে অন্য নারীদের তার জীবনের দুঃখ দুর্দশার কথা জানাতেন, নানা উপদেশ দিতেন।
প্রতিবাদের ভাষা
বর্তমানে নিউশুকে তৎকালীন অক্ষরজ্ঞানহীন নারীদের যোগাযোগের মাধ্যম মনে করা হলেও, তৎকালীন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা দ্বন্দ্বের সংকেত হিসেবেই গড়ে উঠেছিল এই হস্তলিপি। তৎকালীন চীনা সমাজে নারীদের ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখ দুর্দশার কথা বলা, জীবনের প্রতিকূলতা নিয়ে আলোচনা করা নিষিদ্ধ ছিল। পুরুষশাসিত সমাজে নিউশু নারীদের এই অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়ে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দেয়।
যেসব নারীর মধ্যে এই বন্ধন গড়ে উঠত, তারা পরস্পরকে 'প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বোন' মনে করতেন। সাধারণত পারিবারিক সম্পর্কবিহীন তিন-চার নারী নিজেদের মধ্যে নিউশু লিপিতে লেখা চিঠির আদান-প্রদানের মাধ্যমে দলীয় বন্ধুত্ব স্থাপন করতেন। পুরুষের অধীনস্ত এবং নিজের জীবনের সকল সিদ্ধান্ত পুরুষের কর্তৃত্বে থাকার দুর্বিষহ জীবনে নারীরা নিজেদের মধ্যকার বন্ধুত্বে কিছুটা স্বস্তি খুঁজে নিতেন।
ভাষার প্রতিনিধি
২০০০ সালে পুওয়েইতে নিউশু বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। শিন তার মা ও বোনের পথ ধরেই সেখানে পড়াশোনা করেন এবং বর্তমানে ওই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। জাদুঘরে দর্শনার্থীদের ভ্রমণের সময় ভাষার ইতিহাসের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন শিন। বর্তমানে বলা চলে নিউশু লিপির প্রতিনিধিত্বকারী হয়ে উঠেছেন তিনি।
শিন বলেন, 'এই ভাষার কিছু উত্তরাধিকারী ছোটবেলায় দাদী-নানীর কাছ থেকে ভাষাটি শিখেছেন। আমাদের মধ্যকার সবচেয়ে বয়স্ক জনের বয়স আশির ঊর্ধ্বে। একটি ব্যতিক্রমী সংস্কৃতি হওয়ায় মানুষ ভাষাটি পছন্দ করে এবং বুঝতে ও শিখতে চায়।'
চীনের এই দূরবর্তী নির্জন অঞ্চলেই কেন এই ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশ, এ প্রসঙ্গে নিউইয়র্কের স্কিডমোর কলেজের অধ্যাপক ক্যাথি সিলবার জানান, এরসঙ্গে চীনের দক্ষিণাঞ্চলে বিদ্যমান বিভিন্ন বিষয়, হান জাতিভুক্ত নয়- এমন জনগোষ্ঠীর চীনা সংস্কৃতিতে অন্তর্ভুক্তিকরণ, মূল ভূখণ্ড থেকে দূরত্ব ইত্যাদি জড়িত।
ক্যাথি সিলবার ১৯৮৬ সালে নিউশু লিপির ব্যাপারে জানার পরই এ নিয়ে কাজ শুরু করেন। ১৯৮৮-৮৯ সালের মধ্যবর্তী কিছু সময় তিনি এই ভাষার শেষ লেখকদের একজন, য়ি নিয়ানহুয়ার সংস্পর্শে থেকে তার লেখা অনুবাদ করেন।
বিপ্লবের রোষানল
বর্তমানে নিউশু ভাষার ব্যাপারে যা কিছু জানা যায়, তার বেশিরভাগই গবেষক ঝু শুওই'র কল্যাণে। তিনি ১৯৫০ সালে এই লিপির ব্যাপারে জানার পর ১৯৫৪ সালে জিয়াংইয়াং কালচারাল ব্যুরোর অধীনে এ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তবে ১৯৬৯-এর দশকে মাও সেতুংয়ের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়ে তার কাজ বাধাগ্রস্ত হয়।
২০০৪ সালে 'চায়না ডেইলি'তে তার উদ্ধৃতি দিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়: 'ভাষাটি নিয়ে গবেষণার কারণে আমাকে ডানপন্থি খেতাব দেওয়া হয়। তারা আমার সকল গবেষণাপত্র পুড়িয়ে ফেলেছিল। আমাকে শ্রমশিবিরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত ২১ বছর আমি বন্দি ছিলাম।'
চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অংশ হিসেবে তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক নেতারা দেশটির পূর্বের ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা করেন এবং নিউশু লিপি ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৫০-এর দশকে নারীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদান কার্যক্রম বিস্তৃত হওয়ার পর ভাষাটির ব্যবহারও কমে আসতে থাকে।
ঝু শুওই মুক্তি পাওয়ার পর পুনরায় ভাষাটির অনুবাদের কাজ চালিয়ে যান। ২০০৩ সালে তিনি প্রথম নিউশু লিপির অভিধান প্রকাশ করেন। এখন পর্যন্ত তিনিই নারীদের এই গোপন ভাষা রপ্তকারী একমাত্র পুরুষ।
নিউশু জাদুঘরে
শিয়াও নদীর তীরের নিউশু জাদুঘরে বর্তমানে একটি শ্রেণিকক্ষ ও প্রদর্শনী হলঘর রয়েছে। ভিডিও, চিত্রকর্মের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে। শ্রেণিকক্ষে সূচিকর্ম ও ক্যালিগ্রাফি শিক্ষাদানের মাধ্যমে এই সাংস্কৃতিক সংযোগের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
জাদুঘরটিতে প্রতি বছর নিউশু ভাষার গান ও কবিতা নিয়ে বার্ষিক উৎসবের আয়োজন করা হয়। প্রতি বছর গ্রীষ্মে বিনামূল্যে নিউশু প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলে। ভাষাটির উত্তরাধিকারীরা পালাক্রমে এর ইতিহাস বর্ণনা ও ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনের মাধ্যমে এই প্রশিক্ষণ দেন। তবে শিন হু জানান, ভাষাটি আয়ত্ব করা বেশ কঠিন।
'প্রথমত, এই লিপির অক্ষর ও লিখন পদ্ধতি চীনা ভাষার অক্ষর থেকে অনেকটাই ভিন্ন। আরেকটি কঠিন ব্যাপার হলো, ভাষাটির উচ্চারণ। স্থানীয় ভাষায় কথা বলতে না জানলে নিউশুর ভাষায় পড়া কিংবা গান গাওয়া কঠিন,' জানান তিনি।
ভাষা বহমান
সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় এই ভাষা সম্পর্কিত বেশিরভাগ জিনিস নষ্ট করে ফেলায়, বর্তমানে এর শিল্পকলা দুর্লভ। তবে বর্তমানে চলচ্চিত্র, সঙ্গীত ও সাহিত্যে এর ব্যবহার বাড়ছে। জিয়াংইয়াংয়ের তরুণীরাও জাদুঘরে ভাষাটি শেখা শুরু করেছেন। এ বছর ২০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন। মহামারির কারণে শিন সহ বাকিরা উইচ্যাটের মাধ্যমেই অনলাইন ক্লাস নিচ্ছেন।
এই ভাষার বিশেষজ্ঞ লাইমিং ঝাও সম্প্রতি বেইজিংয়ের ছিংহুয়া ইউনিভার্সিটিতে এ বিষয়ের একটি কোর্সে পাঠদান করেন। তিনি বলেন, 'ইয়াং হুয়ানইর মৃত্যুর পর থেকে ভাষাটি নতুন এক যুগে প্রবেশ করেছে। বংশানুক্রমে শেখার যুগ চলে গিয়ে স্বেচ্ছায় পড়াশোনার যুগে প্রবেশ করেছে এটি। এর অনেকটাই ব্যবসা ও পর্যটনের সঙ্গে জড়িত। ভাষাটি সংরক্ষণের ও উত্তরাধিকার সূত্রে ছড়িয়ে পড়ার এটিও একটি পদ্ধতি।'
লাইমিং বিশ্বাস করেন, বর্তমানে নিউশু নারীদের সৌন্দর্য, শক্তি ও ক্ষমতায়নের প্রতীক।
'শিক্ষার সুযোগ না থাকা নিম্নবিত্ত নারীদের সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ হিসেবে নিউশু লিপির যাত্রা শেষ হয়েছে। বর্তমানে নিউশু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অসাধারণ এক লিপিবিদ্যা, যা নারীদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও সাহসের প্রতীক,' বলেন তিনি।
- সূত্র: বিবিসি