টিকাবিরোধীদের কুখ্যাত দাঙ্গাটি হয়েছিল মন্ট্রিলে
১৮৮৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। কানাডার কুইবেক প্রদেশের রাজধানী মন্ট্রিল। বাধ্যতামূলক টিকাগ্রহণ কর্মসূচির প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছে দুই হাজারের বেশি ক্ষুব্ধ মানুষ। তাদের কণ্ঠে একটাই দাবি—'টিকাদানকারীদের হত্যা করো'।
গুটিবসন্ত মহামারি ঠেকানোর জন্য মন্ট্রিল কর্তৃপক্ষ নগরবাসীর জন্য টিকাগ্রহণ বাধ্যতামূলক করেছিল। তার প্রতিবাদেই ১৮৮৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে রাস্তায় নেমে আসে এই সংক্ষুব্ধ জনতা।
বিক্ষোভকারীরা মন্ট্রিলের ফ্রেঞ্চ-কানাডিয়ান এলাকার বাসিন্দা। ইংরেজ-অধ্যুষিত সরকারকে এই এলাকার বাসিন্দারা এক বিন্দুও বিশ্বাস করত না।
মন্ট্রিলে গুটিবসন্ত মহামারির রূপ নেয় ১৮৮৫ সালের গোড়ার দিকে। রোগটা ছড়ায় গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রেলওয়ের এক কন্ডাক্টরের মাধ্যমে।
গুটিবসন্ত মহামারি সে সময় পরিচিতি পেয়েছিল 'লাল মড়ক' নামে। মহামারি ঠেকাবার জন্য মন্ট্রিল কর্তৃপক্ষ স্বেচ্ছাসেবামূলক টিকাদান কর্মসূচি হাতে নেয়। কিন্তু ফ্রেঞ্চ কানাডিয়ান বাসিন্দারা এ কর্মসূচির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করে।
গুটিবসন্তের চিকিৎসার জন্য টিকা দেওয়া তখন কোনো নতুন ঘটনা না হলেও অনেকেরই আশঙ্কা ছিল যে, টিকা দিলে কোনো বিপদ হতে পারে। তাছাড়া রোগটি যে কতটা ছোঁয়াচে, অনেকে আবার তা-ই বুঝত না। এছাড়াও শহরে গুজব ওঠে যে, টিকাদাতারা ঘরে ঢুকে হাত-পা বেঁধে শিশুদের টিকা দেবে।
শহরজুড়ে টিকাবিরোধী পুস্তিকা ছড়িয়ে পড়ে। কিছু ধর্মীয় গোষ্ঠী গুটিবসন্তকে পবিত্র রোগ বলে দাবি করতে থাকে। করোনা মহামারিতেও কিছু খ্রিষ্টান গোষ্ঠীকে এ ধরনের প্রচারণা চালাতে দেখা গেছে।
এদিকে মন্ট্রিলে গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়ে দুই হাজারের বেশি মানুষ মারা যাওয়ার পর শহরের স্বাস্থ্য বোর্ড টিকাগ্রহণ বাধ্যতামূলক করার পদক্ষেপ নেয়। সিদ্ধান্ত হয়, কেউ টিকা না নিলে তাকে জরিমানা করা হবে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও মানুষের অমূলক টিকাভীতি দূর করতে পারেনি স্বাস্থ্য বোর্ড।
সেপ্টেম্বরের ২৮ তারিখ বিকাল থেকে বিক্ষুব্ধ জনতা জমায়েত শুরু করে। সিটি কাউন্সিলের তিনজন ফ্রেঞ্চ-কানাডিয়ান সদস্য শহর পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। টিকা নেওয়ার পক্ষে যারা কথা বলবে, তাদেরকে গুলি করারও হুমকি দেয় তারা।
সন্ধ্যা সাতটার দিকে একদল বিক্ষুব্ধ জনতা স্বাস্থ্য বিভাগের একটি শাখায় হামলা চালায়। গোটা ভবনে ভাঙচুর চালায় তারা। আরও মানুষ যোগ দিলে দলটি সিটি হলের দিকে রওনা দেয়। সেখানে কয়েকজন পুলিশ কর্তব্যরত ছিল, কিন্তু টিকাবিরোধী জনতা তাদের ভেড়ার মতো তাড়িয়ে দেয়।
সিটি হলেও ভাঙচুর চালায় দলটি। এরপর দাঙ্গাবাজ মানুষ ছোটে কেন্দ্রীয় পুলিশ স্টেশনে। নির্বিচারে রিভলভারের গুলি চালানো হয় পুলিশ সদস্যদের লক্ষ্য করে। পুলিশও ফাঁকা গুলি ছোড়ে, কিন্তু উন্মত্ত জনতা বিন্দুমাত্র ঘাবড়ায়নি।
মন্ট্রিলের মেয়র তখন অসুস্থ হয়ে বাড়িতে পড়ে আছেন। বিক্ষোভের খবর পেয়ে পুলিশপ্রধানকে নিয়ে স্বাস্থ্য কার্যালয়ের উদ্দেশে রওনা হন তিনি। গিয়ে দেখেন কার্যালয়টিতে আবার হামলা করেছে টিকাবিরোধী জনতা। পুলিশপ্রধান তাদের থামানোর চেষ্টা করলে উল্টো তার ওপরই চড়াও হয় উন্মত্ত জনতা। অবশেষে বাড়তি পুলিশ এসে এই দাঙ্গাবাজ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে।
রাত একটার দিকে শহর শান্ত হয়।
বিক্ষুব্ধ ফ্রেঞ্চ-কানাডিয়ানরা ঘোষণা দিয়েছিল, টিকা নেওয়ার চেয়ে মৃত্যুই তাদের কাছে বেশি শ্রেয়। 'ইংরেজ কুকুরদের' কাছে কক্ষনো হার মানবে না বলেও ঘোষণা দেয় তারা।
শহরে শান্তি ফেরানোর জন্য পরদিন রাতে সেনাবাহিনী নামান মেয়র। সেদিনের দাঙ্গায় দুজন বিক্ষোভকারী নিহত হন, প্রভূত সম্পদ নষ্ট হয়।
সূত্র: দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট