তরকারির প্রতি আমেরিকানদের ভালোবাসার জন্ম যার হাতে
আমেরিকান রন্ধন শিল্পের জগতে ১৮৯৯ সালের দিকে আবির্ভাব ঘটে বিখ্যাত রাঁধুনি রণজি স্মাইলের। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ডিজিটালাইজেশনের এক শতাব্দি আগেই গণমাধ্যমের ফলাও প্রচারণা পান তিনি।
নিউইয়র্ক থেকে সাউথ ডাকোটা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সকল প্রান্তে তার নামডাক ছড়িয়ে পড়ে।
রণজির বিশেষ কারি বা তরকারি এবং এই রন্ধনপ্রণালী নারীদের মধ্যে বিশেষভাবে জনপ্রিয় ছিল এবং তিনি নিজেও তা জানতেন।
তিনি বলেছিলেন, 'আমেরিকান নারীরা আমার প্রস্তুতকৃত খাবার খেলে কল্পনাতীত সৌন্দর্য পাবেন, দ্যুতিময় চোখের অধিকারী হবেন, গায়ের রঙের শোভাবর্ধন হবে এবং ভারতীয় নারীদের মতো সুন্দর দেহাবয়বের অধিকারী হবেন।'
রণজির স্মাইলি 'আমেরিকার প্রথম ভারতীয় রাঁধুনি', ভারত থেকে আসা 'কিং অব কারি'সহ বেশ কিছু খ্যাতি পান।
১৯ শতকের শেষের দিকেই ভিন্দালুর মতো অনেক ভারতীয় কারিডিশ অ্যাংলো-ভারতীয়দের হাত ধরে ব্রিটেনে জনপ্রিয়তা পায়।
যেভাবে তরকারি গেল পাশ্চাত্যে
১৮১১ সালে সেইক ডিন মাহোমেত লন্ডনে 'হিন্দুস্তান কফি হাউস' প্রতিষ্ঠা করেন। তারপরই ব্রিটেনে এই মিশ্র ভারতীয় রন্ধনপ্রণালী জনপ্রিয় হয়।
একই সময়ে আমেরিকান রান্নার বইগুলোতেও ভারতীয় রন্ধনপ্রণালী প্রকাশিত হওয়া শুরু হয়। এলিজা লেসলির 'ডিরেকশন ফর কুকারি ইন ইটস ভ্যারিয়াস ব্রাঞ্চেস' (১৮৪০) ও 'নিউ কুকারি বুক' (১৮৫৭), অ্যান অ্যালেনের 'দ্য হাউসকিপার অ্যাসিস্ট্যান্ট' (১৮৪৫), ক্যাথেরিন বিচারের 'ডোমেস্টিক রেসিপি বুক' (১৮৪৬) এর মধ্যে অন্যতম।
আমেরিকান বিপ্লবের আগে উপনিবেশবাদীরা বিভিন্ন ধরনের মশলা, যেমন চা, এলাচ, গোলমরিচ, হলুদ, দারুচিনি, জাফরান, রসুন ও আদা ভারত হয়ে ব্রিটেনে নিয়ে যেতেন। ১৮০৯ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ ও চীন থেকে পণ্য আমদানির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম জাহাজঘাট নির্মাণ হয়।
১৮১৩ সালের চার্টার অ্যাক্টের ফলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতীয় পণ্যের একচেটিয়া ব্যবসার সুযোগ হারায়। এরফলে সরাসরি ভারতবর্ষ থেকে পণ্য আমদানির সুযোগ পায় আমেরিকা।
ভারতীয় রন্ধনপ্রণালীর উপকরণ সহজলভ্য হয়ে গেলেও, এ অঞ্চলের রন্ধনশিল্পে পারদর্শিতা ছিল না আমেরিকানদের। ১৮৮০-এর দশকে আমেরিকায় ব্রিটিশ অভিবাসী বা ভারতবর্ষ থেকে ফিরে আসা আমেরিকান নাবিকদের হাত ধরে ভারতীয় রান্নার কিছুটা পরিচিতি পেলেও রন্ধনপ্রণালীর সঠিক উপায় বজায় থাকেনি।
রণজি স্মাইলের হাত ধরেই ভারতীয় রন্ধনপ্রণালী এই অঞ্চলে জনপ্রিয়তা পায়। ১৮৯৬ সালে তিনি লন্ডনের সেসিল হোটেলে কাজ শুরু করেন। সেখান থেকেই মার্কিন এক রেস্টুরেন্ট মালিক রিচার্ড শেরি ১৮৯৯ সালে তাকে নিউইয়র্কে নিয়ে আসেন।
সেসিল হোটেলে রণজির প্রস্তুতকৃত খাবার খাওয়ার পরই শেরি সিদ্ধান্ত নেন, নিউইয়র্কে এই বিদেশি স্বাদ ছড়িয়ে দিতে হবে।
এশিয়ার স্বাদ
নিউইয়র্কে এসে রণজি খুব দ্রুতই শেরিস হোটেলে নিজের আসন পাকাপোক্ত করেন; অন্যান্য রাঁধুনিদের তাকে সমীহ করে চলতে বলা হয়। তার প্রস্তুতকৃত খাদ্য তালিকায় সাধারণত থাকত কালুহ শেরি, মুরগী রান, মাস্কি সিন্ধ, কারি অব চিকেন মাদ্রাজ, বোম্বে ডাক, লেটুস সেইলন-সহ ভারতবর্ষের নানা অঞ্চলের খাবার।
তবে খাবার পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকায় ভারতীয় শরণার্থী নিয়ে আসার কাজও শুরু করেন তিনি। ১৯০১ সালে লন্ডনে দেখা যায় তাকে। তিনি ভারতবর্ষে যাচ্ছিলেন নাকি ভারতীয়দের আমেরিকায় আনার ব্যবস্থা করছিলেন, তা নিয়ে বিতর্কের শুরু হয়।
তিনি মূলত করাচির অধিবাসী ছিলেন। 'বালুচিস্তানের আমিরের চতুর্থ সন্তান', 'রাজা সপ্তম এডওয়ার্ডের বন্ধু'- এ ধরনের ভূয়া পরিচয় দেওয়া শুরু করেন। এসব কথা বলে এবং চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভারতীয়দের আমেরিকায় নিয়ে আসতে থাকেন।
১৮৮৫ সালের কন্ট্রাক্ট ল্যাবর ল' আইনে গ্রেপ্তার হন তিনি। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী শেরিস-কে ২৬ হাজার ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে হয় এবং একইসঙ্গে শেরিসের চাকরি হারান রণজি।
শোনা যায়, পরবর্তীকালে, ১৯১৩ থেকে ১৯২০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে একজন আমেরিকান নারীকে বিয়ে করেন তিনি। স্ত্রীকে নিয়ে তার কিছুদিন পরই আমেরিকা ছেড়ে ভারতবর্ষে ফিরে আসেন।
- সূত্র: স্ক্রল