দিক চেনায় ভূ-চুম্বক ব্যবহার করতে পারে কুকুর
সম্প্রতি দক্ষিণ-পূর্ব ফ্রান্সে আল্পসের কাছে ছুটি কাটাতে গিয়ে নিজেদের পোষা কুকুর, পাবলোকে হারিয়ে ফেলে এক ফরাসি পরিবার। খোঁজাখুজির পর তাকে না পেয়ে অবশেষে বাড়িতে ফিরে আসেন তারা।
কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে কয়েকদিন পর বাড়িতে এসে হাজির হয় পাবলো।
ফরাসি আল্পসের স্যাভয় থেকে ফ্রান্সের দক্ষিণ পাশের শহর নিমে এসে হাজির হয়েছে এই দুই বছর বয়সী কুকুর। মাঝখানে ৩৫০ কিলোমিটারেরও বেশি দুর্গম পথ পাড়ি দিয়েছে নিজে দিক চিনে চিনে।
পূর্ব প্রশিক্ষণ ও কোনো দিক-নির্দেশনা ছাড়াই কীভাবে এই যাত্রা করতে সক্ষম হলো পাবলো?
আমাদের বিশ্বস্ত বন্ধু
কুকুরের দিক চেনার বা নেভিগেশন দক্ষতার উপর অনেক বছর ধরেই নির্ভর করে আসছে মানুষ। উদাহরণস্বরূপ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে কুকুরকে বার্তাবাহক হিসেবে ব্যবহার করেছে ইউরোপীয় সেনাবাহিনী। বিপজ্জনক জায়গায় সামরিক নির্দেশনা এবং চিঠি নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে কুকুর।
কিন্তু কুকুরের নেভিগেশন দক্ষতা এতো ভালো কেন, সে বিষয়ে গবেষণা হয়েছে অল্পই। কুকুরের চেয়ে স্থান পরিবর্তন করা পাখি ও সরীসৃপদের নিয়ে অনেক বেশি গবেষণা হয়েছে।
চেক ইউনিভার্সিটি অব লাইফ সায়েন্সের প্রাণীবিজ্ঞানী হাইনেক বুর্দা বলেন, "কুকুরের দিক নির্ধারণ ক্ষমতা নিয়ে আমাদের জ্ঞান মূলত কল্পিত।"
বুর্দা বলেন, আমরা অতীতে ভাবতাম গন্ধ শুঁকে শুঁকেই কুকুর সবসময় তাদের পথ খুঁজে পায়। কিন্তু সে ধারণা এখন পরিবর্তন হতে শুরু করেছে।
বুর্দা এবং তার দল এক গবেষণায় দেখিয়েছে দিক-নির্দেশনার জন্য পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র ব্যবহার করতে পারে কুকুর।
একটি লুকোনো জিপিএস?
২০১৩ সালের কথা। একদিন বুর্দা হুট করে খেয়াল করলেন কুকুরেরা মূত্র বা মলত্যাগের সময় নিজেদের উত্তর-দক্ষিণমুখী করে নেয়।
এরপর গবেষণা চালিয়ে বুর্দার দল সম্ভাব্য যে ব্যাখ্যা দাঁড় করায়, সেটি হচ্ছে- পৃথিবীর চুম্বকক্ষেত্র অনুভব করতে পারে কুকুর। এই অনুভব ক্ষমতাকে বলা হয়, ম্যাগনেটোরিসেপশন। অভ্যন্তরীণ কম্পাস হিসেবে কাজ করে এটি।
অভ্যন্তরীণ এই কম্পাস ব্যবহার করে কুকুর তার পথ চিনে চিনে আসতে পারে কি না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল না এই গবেষণা দল।
সাত বছর পর তারা প্রথম প্রমাণ পায় যে আসলেই কুকুর তা পারে।
শিকারি কুকুর অন্য কোনো প্রাণীর সঙ্গে বাহাস করার পর কীভাবে পথ চিনে তাদের মনিবের কাছে ফিরে আসে, তার উপর গবেষণা চালিয়েছিল বুর্দার দল।
তারা অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন কুকুরগুলো আগের পথে না যেয়ে নতুন কোনো পথে ফিরে আসছে। অভ্যন্তরীণ কম্পাস ব্যবহার করে কার্যকর একটি পথ বাছাই করতে পারে তারা, যেটি দিয়ে আগের চেয়েও কম সময়ে আসা সম্ভব।
যেকোনো জায়গা থেকে বাড়ি খুঁজে পাওয়া
এই অভ্যন্তরীণ কম্পাস ব্যবহার করেই সম্ভবত নিজের জীবন বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিল আইরিশ কুকুর, জিগি।
জ্যাক রাসেল টেরিয়র প্রজাতির এই কুকুর কয়েক বছর আগে হারিয়ে গিয়েছিল হঠাৎ। তারপর রাতের বেলায় বাড়ি ফিরতে গিয়ে ঘন জঙ্গল পেরিয়ে এক রাস্তার সামনে এসে একটি গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা খায় সে। এই দুর্ঘটনায় তার পিছনের দুই পা প্রায় অকেজো হয়ে গেলেও খোঁড়াতে খোঁড়াতে সে রাতেই বাড়ি পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিল জিগি।
তার মনিব, টম প্রেন্ডারজেস্ট বলেন, "এই অবস্থাতেও যে সে বাড়িতে ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছে, এটা দেখে সত্যিই অবাক হয়েছি আমি। কিন্তু আমি এটাও জানতাম তার নেভিগেশন দক্ষতা বেশ ভালো। যেকোনো জায়গা থেকেই সে খুঁজে খুঁজে বাড়িতে ফিরতে পারবে, এই বিশ্বাস আছে আমার।"
জিগি যদি পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রকে ব্যবহার করে বাড়িতে ফেরার রাস্তা খুঁজে পেয়ে থাকে, তাহলে সে নিশ্চয়ই একমাত্র কুকুর না যার এই ক্ষমতা আছে।
অন্য কুকুরদেরও একইরকম ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই অভ্যন্তরীণ কম্পাস এখনো বলতে গেলে একটি বৈজ্ঞানিক রহস্য।
সমুদ্রে নেভিগেশন
বিজ্ঞানের জানামতে, নেভিগেশনে সবচেয়ে দক্ষ প্রাণীগুলোর একটি হচ্ছে স্যামন মাছ।
মিঠা পানির নদীতে ডিম ফোটানোর পর উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের দিকে মহাকাব্যিক এক যাত্রা শুরু করে স্যামন মাছেরা। এই যাত্রা কয়েক বছর ধরে চলতে পারে, যাত্রাপথ হতে পারে ৯ হাজার কিলোমিটারের চেয়েও বেশি।
স্যামনের সাইনাসে এক ধরণের চুম্বকীয় খনিজ পদার্থ খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তাই তারা ভাবছেন, স্যামনের নাকেই এক ধরণের কম্পাস রয়েছে।
'নেচারস কম্পাস' নামক এক বইয়ে লেখক জেমস এবং ক্যারল গ্রান্ট গুল্ড বলেন, সাঁতার কাটার সময় স্যামন চারপাশ থেকে সংগৃহীত অন্যান্য তথ্যের সঙ্গে তাদের অভ্যন্তরীণ কম্পাসের তথ্য যুক্ত করে পথ চলে। চারপাশ থেকে সংগৃহীত তথ্যের মধ্যে থাকতে পারে প্রাকৃতিক আলো, অথবা তারার আলো।
সমস্ত ইন্দ্রিয় ব্যবহার করে পথচলা
কুকুরের নেভিগেশন দক্ষতা স্যামনের মতো এত অত্যাধুনিক না হলেও, তারা অনেকাংশেই একইরকম সূত্র বা ইঙ্গিত ব্যবহার করে। শোনা, দেখা ও গন্ধ পাওয়া সবকিছুকে সূত্র হিসেবে ব্যবহার করে কুকুর।
নটিংহ্যাম ট্রেন্ট ইউনিভার্সিটির এনিম্যাল সায়েন্সের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক জ্যাকলিন বয়েড বলেন, "তারা (কুকুর) কোনো একক ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে না। বরং প্রচুর ইন্দ্রিয় প্রলুব্ধ এবং অভিজ্ঞতা থেকে আসা জ্ঞান ব্যবহার করে তারা।"
স্বল্প দূরত্বের জন্য কুকুর কোনো ল্যান্ডমার্ক বা নির্দেশক কল্পনা করে এবং সে উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, এই পদ্ধতি ব্যবহার করেই জিগি তার বাড়ি খুঁজে পেয়েছিল। দূর থেকে সম্ভবত সে তার বাড়ির লাইট দেখতে পেয়েছিল এবং লাইটের উদ্দেশ্যেই যাত্রা শুরু করেছিল।
তবে দীর্ঘ ভ্রমণের জন্য আরও বিস্তৃত পদ্ধতি ব্যবহার করে এই প্রাণীরা।
কুকুরের মতো স্যামনের ঘ্রাণশক্তিও প্রখর। হাজার হাজার লিটার সমুদ্রের পানির মধ্যেও তারা যেখানে জন্মেছিল সেখান থেকে আসা এক ফোঁটা পানি পেলেও তারা সেটা শনাক্ত করতে পারে। এবং যে স্রোত ধরে এই এক ফোঁটা পানি সমুদ্রে এসেছে, সেই স্রোতকেও অনুসরণ করতে পারে তারা।
এদিকে কুকুর সাধারণত তাদের মনিব এবং আশেপাশের লোকজনের ঘ্রাণের প্রতি বিশেষভাবে সংবেদনশীল।
বয়েড বলেন, "কুকুর এবং মানুষের মধ্যে অবশ্যই একটি খুব শক্তিশালী বিবর্তনমূলক বন্ধন রয়েছে।"
অনেক কিছুর গন্ধের মধ্যেও তারা তাদের মনিবের ঘ্রাণ সনাক্ত করতে পারে।
"কুকুরেরা বাতাসে নাক রেখে যেকোনো গন্ধের উৎস খুঁজে বের করতে পারে," যোগ করেন বয়েড।
কুকুরের নেভিগেশন দক্ষতার মূল রহস্য সবে অনুসন্ধান ও উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন বিজ্ঞানীরা। হারিয়ে যাওয়া কুকুরের পথ চিনে বাড়ি ফেরার প্রতিটি আকর্ষণীয় গল্পের মাধ্যমে আমরা এই চারপেয়ে বন্ধুদের সম্পর্কে একটু একটু করে জানতে সক্ষম হচ্ছি।
- সূত্র: ডয়েচে ভেলে