দুটি ঈদ উপহার এবং আমাদের পরিবার
আমরা যারা এখন জীবনের মাঝামাঝি সময়ে এসে পৌঁছেছি, তাদের সবার শৈশব-কৈশোর কালের ঈদ উদযাপনের গল্পগুলো মোটামুটি একরকম। সেই ৭০/৮০ এর দশকে আমার পরিচিত পরিজন, বন্ধুবান্ধব সবাই একধরণের পরিবার থেকে এসেছি। আর অন্যটি সেসময় আমরা দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং পরিচিতজনদের আর্থিক অবস্থা বা স্ট্যাটাস নিয়ে একেবারেই সচেতন ছিলাম না। ঈদ ছিল আমাদের কালের সবচেয়ে আনন্দের একটি দিন। ঈদকে কেন্দ্র করে বাসায় নতুন নতুন জিনিস কেনা হতো। টেলিভিশন, ফ্রিজ কিংবা ক্যাসেট প্লেয়ার যে অসম্ভব মহার্ঘ একটা জিনিষ, সেটা এখনকার বাচ্চারা একদম বুঝতেই পারবেনা। সেসময়েরই ব্যাক্তিগত জীবনের দুটি ঈদ গল্প নিয়ে আমার আজকের এই লেখা। লিখতে গিয়ে মনেহল হয়তোবা অনেকের জীবনের সাথেই এই গল্প মিলে যেতে পারে।
আমাদের ফ্রিজটি যেভাবে আলমারি হয়ে গেল---
আমাদের বাসায় খুব সম্ভবত ১৯৭৯/ ১৯৮০ সালের দিকে একটি সেকেন্ড হ্যান্ড ফ্রিজ বা রেফ্রিজারেটর কেনা হল কোরবানির ঈদকে মাথায় রেখে। কারণ ঈদের সামান্য কিছু গরুর মাংস কিছুদিন ডিপে রাখার জন্য পাড়ার এ বাড়ি সে বাড়ি দৌঁড়াতে হতো। তখন হাতেগোনা ২/৪ টি বাসাতে ফ্রিজ ছিল। এই ফ্রিজ কেনা নিয়ে নিয়ে বাসায় উত্তেজনার শেষ ছিলনা । আমাদের মতো মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের জন্য সেসময় একটি ফ্রিজ কেনা ছিল বাড়াবাড়ি, হোক তা পুরানো। আমরা নিশ্চিত যে আব্বার পরিচিত কেউ তাকে কথা দিয়ে ভজিয়ে ফ্রিজটি গছিয়ে দিয়েছিল। কাজটা যার বুদ্ধিতেই হোক না কেন, বাসায় একটি বড়সর ফ্রিজ পেয়ে আমরা দারুণ খুশি হয়েছিলাম। শুধু স্বভাবসুলভ ভঙ্গীতে হৈ চৈ করে উঠলো আম্মা --- "এই লোকটার (মানে আব্বার) খেয়েদেয়ে কাজ নাই। কোথা থেকে একটা ফ্রিজ কিনে আনলো। ঘরে কত কী দরকার, সেদিকে লক্ষ্য নাই আর উনি কিনে আনলো ফ্রিজ।"
আম্মা যাই বলুক, আমরাতো ফ্রিজ চালু হওয়ার আগেই চারিদিকে ফোন করতে শুরু করলাম। এখনকার সময় হলে হয়তো সেলফি তুলতাম। ফোন পেয়ে কিছু কিছু উৎসাহী মানুষ চলেও এল ফ্রিজটি দেখার জন্য। এখনও মনে আছে শুধু ফ্রিজে রাখার জন্যই সাত তাড়াতাড়ি কিছু মিষ্টি আর আইসক্রিম কিনে আনা হল। তখনও আমাদের বাসায় প্রতিদিন বাজার হতো । কিন্তু এটা কেনার পর এখানে রাখার জন্য বাজার একটু বেশি করা শুরু হল। কারণ তা নাহলে ফ্রিজে রাখব কী। আজকালের মত এত খাদ্যসম্ভারতো ছিলনা, সেসময়। 'বাজারপ্রিয় মানুষ' আব্বার খাবার দাবার কেনার পরিমাণ বেড়ে গেল। আম্মা রাগ করলেই আব্বার জবাব ছিল "আরে ফ্রিজটা কী খালি পড়ে থাকবে?"
আজ বলতে লজ্জা নাই যে, আমরা বাসার সবাই ফ্রিজটার সামনে একবার করে ছবিও তুলেছিলাম। এটাও ঠিক যে কী এক অজ্ঞাত কারণে আমাদের ফ্রিজটা ছিল বসবার ঘরে মানে ড্রইং রুমে। আমাদের সরাইখানা টাইপ বাসাটাতে সারাক্ষণ এন্তার লোকজন আসা-যাওয়া করতো। তাদের সামনে দিয়েই আমরা লজ্জাটজ্জা না পেয়েই তরিতরকারি, খাবার-দাবার, পানি, দুধ, ডিম সবকিছু বের করতাম। এখন বুঝি কী কাণ্ডই না করেছিলাম সেই ফ্রিজটাকে নিয়ে।
এরপর বেশ কয়েক বছর কেটে গেল। ফ্রিজটি একসময় নষ্ট হতে শুরু করল। মিস্ত্রী ডেকে মেরামত করানো হয়, আবার নষ্ট হয়, এইভাবেই চলছিল। আমাদের তখন এই অবস্থা ছিলনা যে ঘরের একটি দামি কিছু নষ্ট হলে, সেটা বদলে আরেকটা কিনে আনবো। এইভাবে চলতে চলতে একদিন আমাদের অতি প্রিয় এই ফ্রিজটি পুরাই নষ্ট হয়ে গেল। ফ্রিজটার প্রতি আমাদের ইতোমধ্যেই মায়া পড়ে গিয়েছিল, আর তাই এটি স্থায়ীভাবে নষ্ট হওয়ার পর বেশকিছুদিন শোপিস হিসেবে পড়ে থাকলো। অনেকে এটি বিক্রির কথা তুললেও আব্বার তাতে কোন সায় ছিলনা। বলতো আছে, থাকুক, অসুবিধা কি। বেচলে কয় টাকাই-বা পাওয়া যাবে?
পরিণত হল একধরণের মিটসেফ টাইপ আলমারিতেওখানে ওখানে আমরা বেশ অনায়াসেই বিস্কুটের কৌটা থেকে কাপ, গ্লাস, পান-সুপারি এমনকী দু একটা বাসন-কোসন, জুতা কাপড়ও রাখতে শুরু করলাম। হয়তো আমার ভাই ওর মোজা খুঁজে পাচ্ছেনা। তখন আম্মাকে এও বলতে শুনেছি যে, "দেখতো ফ্রিজের মধ্যে আছে কিনা?" প্রথম যারা এই দৃশ্য দেখতো বা এমনতর কথা শুনতো তারা হাঁ হয়ে গেলেও, ক্রমে সবাই জেনে গিয়েছিল এই ফ্রিজ নামধারী আলমারিটার কথা। কারণ আমাদের ফ্রিজ কাম আলমারিটি তখনও ঐ বসবার ঘরেই ছিল এবং আমরা সবার সামনে এটিকে বহুদিন এভাবেই ব্যবহার করেছি।
এরপর এলোনাইট কোম্পানির টু-ইন-ওয়ান আর 'জাকনদানি' ক্যাসেট ---
আব্বা সন্ধ্যায় যখন বাড়ি ফিরে আসতো, তখন তার হাতে অবধারিতভাবে কিছু না কিছু, বিশেষ করে খাবার দাবার থাকতোই, আর তাই আমরা অপেক্ষায় থাকতাম যে আব্বা কখন ফিরবে হাতে কোনকিছুর প্যাকেট নিয়ে?
তবে বিপদজনক ব্যাপার ছিল এভাবে বাড়ি ফেরার পথে এটা সেটা কিনতে গিয়ে আব্বা প্রায়ই ক্ষতির মুখে পড়তো। যেমন তাকে 'নানা' 'নানা' ডেকে মাছওয়ালারা পঁচা মাছ গছিয়ে দিতো। ৮টি মুরগি কিনলে ভেতরে ২টি মুরগি মরা থাকতো, ৫ কেজি টমেটো আনলে ২ কেজি চোখ বন্ধ করে ফেলে দেয়া যেতো। আব্বা মোটামুটিভাবে এভাবেই 'ফালতু' জিনিস কিনে এনে বাসায় আম্মার হাতে হেনস্তা হতো ।
এরকমই এক সন্ধ্যায় কোন একটা ঈদেও আগে আব্বা বাড়ি ফিরলো কোন খাওয়া দাওয়া নিয়ে নয়, একেবারে আস্ত একটা টু-ইন-ওয়ান হাতে নিয়ে। এসেই ঘোষণা দিল যে এটা আম্মার ঈদের উপহার। আম্মা এতে তার পছন্দের মান্না দে, লতা, আশার গান শুনবে। সময়টা সম্ভবত তখন ৮০/৮১ সাল। আম্মাসহ আমরা বেজায় খুশি, দারুণ উত্তেজনা। কী আনন্দ, সারাদিন পছন্দমত গান শোনা যাবে। রেডিওতে গান শোনার জন্য আর বসে থাকতে হবেনা। তবে আমরা সবাই একটু অবাক ও হতাশ হলাম টু-ইন-ওয়ানটির ব্র্যান্ডের নাম দেখে, নাইট কোম্পানির তৈরি এটি। এরকম একটা ব্র্যান্ডের নাম কখনতো আমরা শুনিনি । সনি, হিটাচি, ফিলিপস থাকতে এটা আবার কী কোম্পানি?
জানতে চাইলাম আব্বা কোথা থেকে কিনেছো এটা? বললো, স্টেডিয়াম থেকে। বললাম কেন এরকম একটা আজব কোম্পানির টু-ইন-ওয়ান কিনে আনলে? আব্বা বলল, "আমিতো কিনি নাই। রিকশায় বসে একজনকে টাকা দিয়েছি, ও কিনে এনে দিয়েছে। কেন কী সমস্যা হইলো তোদের এই কোম্পানির নাম নিয়ে? চেহারাতো বেশ ভাল, সাইজও বড়, গানও বাজতেছে। তাহলে তোদের আপত্তিটা কোথায়?" এত শখের একটা দামি জিনিষ কেউ কি রিকশায় বসে কিনতে পারে? কোন ব্র্যান্ড বিচার বিবেচনায় না এনে নাইট কোম্পানির টু-ইন-ওয়ান ?
তবে 'বাজে ব্র্যান্ড' নিয়ে আব্বার তেমন কোন মাথাব্যথা না থাকলেও এই খবরটা যেন আম্মার কানে না যায়, আব্বা বেশ রাগত্ব স্বরে সেকথা আমাদের জানিয়ে দিলো। আর এরপর ১০/১৫ দিন বাসায় কোন অতিথি এলে আব্বা তাকে প্রায় জোর করে নাইট কোম্পানির টু-ইন-ওয়ান থেকে গান শোনাতো আর এটাতে যে বেশ ভাল গান শোনা যাচ্ছে, সেকথা আদায় করে নিতো। শুধু কি তাই, একফাঁকে সেই অতিথিকে আম্মার কাছেও গিয়ে বলতে হতো যে, বাসায় খুব ভাল একটি গান শোনার যন্ত্র কেনা হয়েছে।
এই বড় আকারের গান শোনার যন্ত্রটি আম্মার নামে কেনা হলেও, আম্মার গান শোনার ফুরসুত কোথায়, সারাদিন ব্যস্ত। অন্যসময় আব্বা বা আমরা দখল করে আছি ক্যাসেট প্লেয়ারটি। বাসার বসবার ঘরেই ঐ ফ্রিজটির পাশেই টু-ইন-ওয়ান টি রাখা হলো। কারণ বাসায় অতিথিদের বাধ্যতামূলকভাবে এই টু-ইন-ওয়ানের গান শোনানো হচ্ছে।
তবে আমাদের জন্য আরো বড় অসুবিধাটা হয়ে দাঁড়াল যে আব্বা সকালে উঠেই তার খুব প্রিয় এ্কটি কাওয়ালির ক্যাসেট যার নাম ছিল 'জাকনদানি' সেটা চালিয়ে দিতো হাই ভলিউমে। আর আমাদের প্রতিদিন সেটা শুনতে শুনতে ঘুম থেকে উঠতে হতো। শুধু তাই নয়, ঐ অদ্ভুত কাওয়ালি শুনতে শুনতে বাসা থেকে বেরও হতে হতো। কোথায় মান্না দে, কই লতা, আশা ? বাসায় চলছে অতিশয় বাজে একটি কাওয়ালি।
সময়ের সাথে সাথে আমরা ঐ নাইট টু-ইন-ওয়ানে গান শুনতে অভ্যস্ত হয়ে উঠলাম । এমনকী আম্মাও এই নাইট টু-ইন-ওয়ানে মাঝেমধ্যে মান্না দে, সতীনাথ আর লতার গান শুনতো। আমরা সবাই সাজগোজ করে এর সামনে দাঁড়িয়ে ছবিও তুলেছি।
৩/৪ বছর পরে একসময় আম্মা সেই নষ্ট ঐতিহাসিক নাইট টু-ইন-ওয়ানটি মাত্র ২০০ টাকায় কাগজওয়ালার কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল বলে শোনা গেছে। সেটা শুনে আব্বার আক্ষেপের কোন অন্ত ছিলনা। প্রায়ই শুনতে হতো এত ভাল জিনিস কীভাবে তোর মা ফেরিওয়ালার কাছে বিক্রি করে দিতে পারলো, তাও আবার ২০০ টাকায়।
লেখক: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
৩০ জুলাই, ২০২০