রেস্টুরেন্ট বলতে চু চিং চাও, শাহবাগ হোটেল আর ইন্টারকন্টিনেন্টাল…
আমাদের কাছে সামাজিকতা বড় ছিল। তাই কারও বাসায় খেতে যাওয়াই ছিল আমাদের বিনোদন। কারও বাসায় একটু ভালো রান্না হয়েছে তো আমাদের ডাক পড়ে যেত খেতে যাওয়ার জন্য। এমনকি দেখা যেত আমার মা-ও একদিন ভালো রান্না করেছেন তো সবাইকে বলা হতো বাসায় এসে খেয়ে যাওয়ার জন্য। এ ছাড়া বাসায় ভালো রান্না হলেই এর-ওর বাসায় খাবার দিয়ে আসার চল ছিল। টিকাটুলির আমাদের দিনগুলোই ছিল এমন। আমাদের মধ্যে রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়ার বিষয়টা একদমই ছিল না।
বাইরের খাবার খাওয়ার প্রবণতা পুরান ঢাকার মানুষের মধ্যে বেশি ছিল। তাদের জিজ্ঞেস করলে দেখা যাবে, সকালে নাশতা করেছেন বাকরখানি, কাবাব, নিমকি দিয়ে। কিংবা নাশতা করে এসেছেন পাড়ার কোনো হোটেল থেকে। রেস্টুরেন্টের চল কিন্তু এখানে কিছুটা হলেও ছিল। তবে এগুলোকে রেস্টুরেন্ট না বলে হোটেল বললেই মানায় বেশি। এখনকার যে রেস্টুরেন্ট কালচার, তার সঙ্গে এগুলো আসলে যায় না। আর তাদের এ বাইরের খাবারের প্রতি আসক্তি অনেকটা কলকাতার মানুষের মতো। তাদের ভাষা, খাবারের ধরন অনেকটা কাছাকাছি। তাই কলকাতার মতো পুরান ঢাকায় অলিগলিতে হোটেল ছিল প্রচুর। কিন্তু বর্তমান ঢাকার মতো রেস্টুরেন্ট কালচার তখনো গড়ে ওঠেনি।
ঢাকায় রেস্টুরেন্ট কালচার মূলত গড়ে ওঠে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে। তার আগপর্যন্ত আমাদের আশেপাশে আত্মীয়স্বজনের বাসাই ছিল আড্ডা ও সামাজিকতার প্রধান উৎস। এমনকি তৎকালীন জিন্নাহ অ্যাভিনিউ, যা বর্তমানে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ নামে পরিচিত, সেখানে ট্রপিকেল ক্লিনিকে যেতাম আইয়ুব আলী নামের এক ডাক্তারের কাছে। তিনি আমাদের পারিবারিক ডাক্তার ছিলেন। আমাদের সামাজিকতা এমন ছিল যে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে তার সঙ্গে আড্ডা দিতে বসে যাওয়া হতো। তো সে সময় বয়সে ছোট ছিলাম, ডাক্তার আমাকে লজেন্স-চকলেট এসব খেতে দিত।
পরে ওই জায়গাতেই একটি রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছিল, যার নাম ছিল 'রেক্স'। সে সময়ের কবি-সাহিত্যিকদের খুব পছন্দের জায়গা ছিল এটি। তারা প্রায়ই সেখানে আড্ডা দিতে যেতেন। রেক্স মূলত ছিল একটি বেকারি রেস্তোরাঁ। সেখানে একটি রুটি পাওয়া যেত, যা খুবই সুস্বাদু ছিল। আমাদের বাসায় প্রায়ই সেই রুটি কিনে এনে খাওয়া হতো।
তবে একদম পুরোদস্তুর রেস্টুরেন্টের স্বাদ পেয়েছিলাম গুলিস্তানে। সে সময় গুলিস্তানে একটি চায়নিজ রেস্টুরেন্ট চালু হয়েছিল গুলিস্তান সিনেমার ভবনে। রেস্টুরেন্টের নাম ছিল 'চু চিং চাও'। রেস্টুরেন্টটির মালিক ছিলেন পাকিস্তানি গুলিস্তান সিনেমার লিও লোহানীরা। এখানেই আমার প্রথম রেস্টুরেন্টে খাওয়া। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন লোক আমাদের জন্য দরজা খুলে দিয়েছিলেন। ভেতরে বসার জন্য সুন্দর ব্যবস্থা ছিল। পরিবেশ একদম নীরব, পরিবার নিয়ে খেতে যাওয়ার মতো সুন্দর পরিবেশই ছিল। এখানেই প্রথম আমরা মা-বাবার সঙ্গে পরিবার নিয়ে রেস্টুরেন্টে খেতে যাই। সেখানে আমরা চায়নিজ খাবার হিসেবে চিকেন কর্ন স্যুপ, ফ্রায়েড রাইস, সুইট অ্যান্ড সাওয়ার চিকেন এসব খেতাম। আর যেহেতু আমরা ভাইবোনরা ছোট ছিলাম, খাওয়া শেষে সবাই আইসক্রিম খেতাম।
আমার বাবা খুব বেশি রেস্টুরেন্টে খেতে যেতে পছন্দ করতেন না। তিনি ছাত্রজীবন কাটিয়েছেন কলকাতায়। তাই বড় রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াদাওয়া তার হয়ে ওঠেনি। তবে বন্ধুবান্ধব নিয়ে কফি-টোস্ট এসব খেতে যেতেন। সেখানে সাঙ্গু ভ্যালি নামে এক রেস্টুরেন্টে খেতেন আমারা বাবা। মাত্র আট আনায় খাওয়া যেত সেখানে। সেখানের পাউরুটিকেই টোস্ট বানিয়ে অর্ধেকের এক পাশে গোলমরিচ ও আরেক পাশে চিনি দিয়ে বিক্রি করা হতো। এটাকেই আমার বাবার এক রুমমেট আবু সাঈদ খুব ভালো বলতেন। তিনি গর্ব করে বলতেন, 'তোমরাও এমন খাবার খাওনি, এগুলো এত ভালো।' তো আমাদের রেস্টেুরেন্টে গিয়ে খাবার খাওয়ার ধরন ছিল এ রকমই।
এমনকি আমার বন্ধুদের বাবারাও রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াটা খুবই অপছন্দ করতেন। তা ছাড়া সে সময় রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াটাও ভালো চোখে দেখা হতো না। তাই এসব রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়া খুবই কম হয়েছে।
গুলিস্তানের 'চু চিং চাও'-এর পর ধানমন্ডিতে আরেকটি চায়নিজ রেস্টুরেন্ট হয়েছিল, সেটির নাম ভুলে গেছি। চু চিং চাওয়ের মালিক এ দেশের হলেও সেই রেস্টুরেন্টের মালিক ছিল চীনারাই। এ চীনারা আমাদের দেশে এসে বিভিন্ন ব্যবসা করলেও তারা রেস্টুরেন্ট ব্যবসা খুব একটা করেনি। ওই রেস্টুরেন্টের পাশাপাশি তারা সেখানে একটি লন্ড্রিও খুলেছিল। সেখানেও প্রায়ই খেতে যেতাম।
চীনারা আমাদের দেশে বহু আগে এলেও তারা রেস্টুরেন্ট ব্যবসা করেনি; কারণ, এখানে পঞ্চাশের দশকে রেস্টুরেন্টের চল খুব একটা ছিল না। বাংলাদেশে রেস্টুরেন্টের চল শুরু হয় ষাটের দশকের অনেক পরে। সেসব রেস্টুরেন্ট এখন আর নেই। সেই চু চিং চাও অনেক আগে বন্ধ হয়ে গেছে।
ষাটের দশকের পরে আরও একটি রেস্টুরেন্ট হয়েছিল—'শাহবাগ হোটেল'। সে সময় সেটি খুব নাম করেছিল। আমি নিজে সেখানে যাইনি। কিন্তু আমার বাবা যেতেন। আমার বাবা ব্যাংকার ছিলেন। সেখানে তাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদি হতো। ওখানে বিভিন্ন ব্যাঙ্কুয়েট হল ছিল। এখন যেটি পিজি হাসপাতাল, তখন সেটি শাহবাগ হোটেল ছিল। এখানে তখন বিয়েশাদিরও আয়োজন হতো। এটি তখন ঢাকার একমাত্র বড় হোটেল ছিল। বাবার প্রায়ই সেখানে দাওয়াত থাকত। এখনো মনে আছে, বাবা সেখানে কী পোশাক পরে যেতেন। তিনি সাদা কোট, কালো প্যান্ট এবং গলায় বো-টাই পরে সেখানে দাওয়াত খেতে যেতেন।
ষাটের দশকে এসে ঢাকায় একটু একটু করে নাগরিক সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠছিল। ১৯৬৬ সালের দিকে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হলে শাহবাগ হোটেল একটু চাপের মধ্যে পড়ে যায়। আর শাহবাগ হোটেলের মালিক পাকিস্তানি ছিল; যার কারণে একাত্তরে যুদ্ধের পর পাকিস্তানিরা চলে যায় এবং হোটেলটি বিক্রি করে দিয়ে যায়। সেই থেকে শাহবাগ হোটেল আর দাঁড়াতে পারেনি। এখন তো সেটি হাসপাতালই হয়ে গেছে।
আমরা প্রথম হোটেলে যাওয়া শুরু করেছি স্বাধীনতাযুদ্ধের পরে। এর আগে সত্তরের দিকে একবার শুধু কাজে ইন্টারকন্টিনেন্টালে গিয়েছি। এরপরে ১৯৭৬-৭৭-এর দিকে আমার এক বন্ধু দেশের বাইরে চলে যাবে, তখন আমাদের ইন্টারকন্টিনেন্টালে নিয়ে গিয়েছিল খাওয়াতে।
এখন মানুষের যেমন জীবনযাত্রা, এগুলো মূলত স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের জীবনযাত্রা। এমন জীবনযাত্রা এর আগে এমন ছিল না। আমার ভাইদের জীবনযাত্রা এমন ছিল না। আমার মনে আছে, ১৯৬০-৬১ সালের দিকে এক ঈদের আগের দিন রাতে পাঞ্জাবির জন্য কান্নাকাটি করছিলাম। তো চাঁদরাতের দিন বাবা আমাদের জিপ গাড়িতে করে পুরান ঢাকার চকবাজারে নিয়ে গিয়েছিলেন পাঞ্জাবি কিনে দিতে। এখনকার মতো তখনো চাঁদরাতে পুরান ঢাকা পুরো সরগম ছিল। সে সময় আর. পি. সাহার (রণদাপ্রসাদ সাহা) মতো বড় ব্যবসায়ীরা-সমাজসেবকও চাঁদরাতে কেনাকাটা করতে যেতেন। আমার মনে আছে, সেদিন ঈদের উপহার হিসেবে আর পি সাহা তার মেয়েকে স্বর্ণের অলংকার কিনে দিয়েছিলেন।
রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়ার চল শুরু হয় স্বাধীনতার পর। শাহবাগে তখন সাকুরা নামে আরেকটি রেস্টুরেন্ট হয়েছিল। বর্তমানে একে মানুষ মদের দোকান হিসেবে চেনে বেশি। তখন এটি চায়নিজ রেস্টুরেন্ট ছিল। তবে তখন মদ হয়তো বিক্রি হতো, কিন্তু তার আলাদা ব্যবস্থা ছিল।
ফেরি করে হট পেটিস বিক্রির খুব চল ছিল বেশ ঢাকায়। আমার মনে আছে, স্টেডিয়াম মার্কেটের ওখানে ফ্লেভার নামে একটি বেকারির দোকানে যেতাম। সেখানকার হট পেটিস খুব ভালো ছিল। আর পাউরুটিও আমরা কিনে খেতাম। আমাদের সময় পাউরুটি খাওয়ার চলটা খুব বেড়ে গিয়েছিল।
স্বাধীনতা পরপর দেশে খুব রিলিফ আসত। কারণ, এর আগে বেশির ভাগ খাবার আসত পকিস্তান থেকে এবং দেশের কারখানার মালিকও ছিল বেশির ভাগ পাকিস্তানিরা। ফলে তারা চলে যাওয়ায় স্বাধীনতার পরের দুই বছর খাবারের খুব অভাব ছিল। কিচ্ছু পাওয়া যেত না। সে সময় প্রতিদিনই রিলিফের খাবার পাওয়া যেত। সে সময় স্টুডেন্টদের জন্য পাওয়া যেত মাছ আর ডিম। মাছগুলো তখন টিনের কৌটায় আসত।
১৯৭২ সালের দিকে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হই, তখন শিঙাড়া-সমুচার সঙ্গে পরিচিত হই। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় একমাত্র মুখরোচক খাবার ছিল শিঙাড়া। সে সময় আমরা বিশ্ববিদ্যালয়েই সেন্ট্রাল লাইব্রেরির কাছে শরীফ মিয়ার ক্যানটিন থেকে শিঙাড়া কিনে খেতাম। এ ছাড়া তার দোকানে আট আনায় এক প্লেট তেহারিও পাওয়া যেত, সেগুলোই খেতাম। সে সময় আমার দৈনিক বাজেট ছিল পাঁচ টাকা। এ পাঁচ টাকার মধ্যে সিগারেটের প্যাকেট ছিল দেড় টাকা। তো দেখা যেত, এ দেড় টাকায় চা আর ১০টা সিগারেট হয়ে যেত। সাথে শিঙাড়া খেলে দুই টাকায় সব মিলিয়ে তিন টাকায় এসব খাওয়া যেত। আর তখন বাসা দিলু রোডে। ক্লান্ত লাগলে ইন্টারকন্টিনেন্টাল পর্যন্ত হেঁটে আসতাম, তারপর দেড় টাকায় রিকশায় করে বাসায় চলে আসতাম।
তবে এমন কম টাকায় খুব বেশি দিন চলা যায়নি। দুই বছর পর জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকে, তখন টুকটাক আমরাও কাজ শুরু করি, তো হাতখরচের টাকাও বাড়তে থাকে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশেই বিভিন্ন ছাপরা হোটেল ছিল, সেখানেই অনায়াসে ভাত-তরকারি খাওয়া হয়ে যেত। তখন মাত্র আড়াই টাকায় একটা তরকারি, তরকারির ঝোল দিয়ে ভরপুর খাওয়া যেত।
যখন চাকরিবাকরি শুরু করি, তখন ঢাকা কলেজের এখানে চিটাগং রেস্টুরেন্ট নামে একটা হোটেল ছিল। বেশ সস্তায়ই খাবারদাবার পাওয়া যেত। মাত্র তিন টাকা খরচ করেই মাছ-মাংস দিয়ে ভাত খেয়ে ফেলা যেত। আবার এখানে খুব দামি খাবারও ছিল। সে সময় এটি বেশ বিখ্যাতও ছিল। বিশেষ করে পাঙাশ মাছের মাথা খেতে অনেকেই বিভিন্ন জায়গা থেকে এ হোটেলে আসত। এ নামে আরেকটা হোটেল ছিল সেগুন বাগিচাতে, এখনও আছে। চিটাগাং হোটেল।
এখন সময় খুব এগিয়ে গেছে। এখন মাত্র পাঁচ টাকায় দিন পার করে দেওয়ার চিন্তা করাই যায় না। আর সেই চু চিং চাওয়ে তিন-চার পদ খেয়ে চায়নিজ খাবারের স্বাদ নিতাম, এখন চাইনিজ রেস্টুরেন্টের আদলও বদলে গেছে। এক লোক আমাকে সেদিন এক চায়নিজ রেস্টুরেন্টে খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিল। সে-ই প্রায় সাত-আট পদ এনে আমার সামনে হাজির করেছিল।
আগে আমাদের কাছে সামাজিকতাটাই বড় ছিল। তাই রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়া আমার কমই হয়েছে। তারপরও যেসব জায়গায় খেয়েছি, সেগুলো এখনো স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে আছে।