দৃষ্টিনন্দন বৃক্ষময় ব্যতিক্রমী ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের গল্প
চট্টগ্রাম যেতে হলে ঢাকার দমবন্ধ হয়ে আসা দীর্ঘ যানজট কাটিয়ে চার লেনের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ওঠার পর প্রশস্ত আর মসৃণ সড়ক ধরে আগাতেই দেখা মিলবে এক অনন্য দৃশ্য।
বাংলাদেশে সচরাচর নিখুঁতভাবে নির্মিত রাস্তায় আরামদায়ক ড্রাইভিং অভিজ্ঞতা মিলে না। কিন্তু, এর পাশাপাশি বদলে যাওয়া দৃশ্যপট আপনাকে এতোটাই চমৎকৃত করবে যে কোথায় এসে পড়লেন তা ভেবে দ্বিধায় পড়তে পারেন!
দুই পাশের রাস্তার মাঝে সড়ক বিভাজকে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে দেশীয় সব ফুল গাছ। সারা বছরজুড়ে ফোটা এসব ফুল নিশ্চিতভাবেই যে কাউকে বিমোহিত করবে।
পরবর্তী ১৪৩ কিলোমিটার পথ জুড়ে ভ্রমনে আপনাকে সঙ্গ দিবে ১৪টি ভিন্ন প্রজাতির প্রায় ৫২ হাজার বৃক্ষ। সবগুলো গাছই দেশীয়। বছরের বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন গাছে ফুল আসে। আর তাই যাত্রীরা সারা বছরই মিষ্টি সুবাসের সাথে ভিন্ন রঙ ও বর্ণের ফুলে দৃষ্টিসুখ লাভের সুযোগ পান।
রাধাচূড়া, টগর এবং সোনালুর মতো অপেক্ষাকৃত ছোট গাছগুলো যখন সড়ককে সুশোভিত করে তুলতে ব্যস্ত তখন কদম এবং জারুল গাছের মতো মাঝারি আকৃতির গাছগুলো বিভিন্ন প্রজাতির পাখি আর ছোটখাটো বন্যপ্রাণের আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে।
রাস্তার ধারে ফুল গাছ লাগানোর বিষয়টি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অস্বাভাবিকই ঠেকবে। সড়কে বৃক্ষরোপন এদেশে শোচনীয়, বোকামি এবং নির্বোধের মতো কাজ। গাছের প্রজাতি বা ভিন্নতা নিয়ে এখানে খুব একটা ভাবা হয় না। যারা গাছ লাগায় তারা সাধারণত মেহগনি, বাবলা বা রেইনট্রি গাছ লাগানোকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। এই গাছগুলো পরিণত হলে কেটে ফেলে কাঠ বিক্রি করা সম্ভব। কিন্তু, বাস্তুসংস্থানের ক্ষেত্রে তাদের অবদান খুব সামান্য।
গাছ নিয়ে যাদের আগ্রহ আছে তারা মুহূর্তেই ধরে ফেলবেন যে দেশীয় এই বৃক্ষরোপনের মাধ্যমে কেবল সৌন্দর্যবর্ধন নয়, বরং পরিবেশের সাথে বৃক্ষের সামঞ্জস্যতাও রক্ষা করা হয়েছে।
কিছু গাছ সারা বছর ফুল দিলেও কৃষ্ণচূড়ার মতো গাছগুলো এই মৌসুমে রক্তিম লাল ফুলে সজ্জিত থাকে।
সুতরাং, সড়ক বিভাজকে বিবেচনা ছাড়াই বৃক্ষরোপনের অতীত ইতিহাসকে হিসাবে রাখলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে এই নতুন গাছ নির্বাচনের চিন্তার উদ্ভব কোথায় হলো সেই প্রশ্নও মাথায় আসবে।
কিছুটা অনুসন্ধানের পর সামনে আসে এম এ এন সিদ্দিকের নাম। সড়ক এবং জনপথ অধিদপ্তরের সাবেক এই সচিব দেশের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় মহাসড়কে বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের গাছ রোপনের পরিকল্পনা করেন।
কীভাবে তা সম্ভব হলো সেই গল্প তার নিজের মুখ থেকেই শোনা যাক।
অভিনব এই পরিকল্পনা কীভাবে স্বীকৃতি লাভ করলো সেই গল্পই দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে শুনিয়েছেন এম এ এন সিদ্দিক।
২০১৬ সালে পাঁচ মিটার প্রশস্ত সড়ক বিভাজকসহ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনের হাইওয়েতে উন্নীত করা হয়। ভবিষ্যতে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কথা মাথায় রেখে বিভাজকের পরিকল্পনা করা হয়।
কিন্তু, কিছু বুঝে উঠার আগেই দখলকারীরা বিভাজকের দখল নিয়ে নেয়। কিছুদিনের মধ্যে আরেকটি সমস্যার উদ্ভব হয়। বিপরীত দিক থেকে আসার গাড়ির হেডলাইটের আলোয় রাতে গাড়ি চালানো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
সিদ্দিক স্থায়ী সমাধানের সন্ধানে বহু চিন্তা করলেন। অবশেষে তার মনে এক চমৎকার পরিকল্পনা খেলে উঠে।
"উন্নত দেশে ফুল গাছ লাগিয়ে সড়ক বিভাজকের সৌন্দর্য্য বাড়ানো হয়। প্রাকৃতিক এই দৃশ্য যাত্রীদের মাঝেও ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করে," বলেন সিদ্দিক।
"এরপর আমি মহাসড়কজুড়ে ফুল গাছ লাগানোর সিদ্ধান্ত নিলাম," পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করে বললেন ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন সিদ্দিক।
গাছ নির্বাচন
কিন্তু, সরকারি প্রকল্পের ক্ষেত্রে আপনি নার্সারিতে গিয়ে পছন্দ অনুযায়ী গাছ কিনে রোপন করতে পারবেন না। সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তরের অধীনে আরবরিকালচার বিভাগ রাস্তার ধারে এবং মহাসড়কে ক্ষয়রোধে বিভিন্ন বৃক্ষরোপনের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।
হয়তো তারা সাহায্য করতে পারবে। "আমাদের জন্য একটি গবেষণা জরিপ পরিচালনা এবং বিভাজকে রোপনের উপযোগী ফুল গাছ নির্বাচনের কথা তাদের জানালাম," বলেন সিদ্দিক। তারা বিষয়টি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পাশাপাশি অন্যান্য কৃষি দপ্তরের সাথেও পরামর্শ করে।
"অবশেষে, তারা কাঞ্চন, সোনালু, কদম ও পলাশসহ ২৫টি ফুলের গাছের তালিকা তৈরি করে," বলেন তিনি।
বহু পর্যালোচনার পর গাছগুলো বাছাই করা হয়। গাছগুলোর প্রকৃতি বিচার করে তাদের নির্বাচন করা হয়েছিল। বেড়ে উঠতে কতদিন সময় প্রয়োজন, কী ধরনের যত্ন নিতে হবে, ফুলের মৌসুম কবে, প্রাপ্ত বয়স্ক অবস্থায় শাখা-প্রশাখা কত দীর্ঘ হবে, গাছের ছায়া কতদূর বিস্তৃত হবে এবং তাদের উচ্চতা কতদূর পর্যন্ত হবে ইত্যাদি বিভিন্ন প্রশ্ন সামনে রেখের দীর্ঘ আলোচনার পর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
কিন্তু এরপরই এক অপ্রত্যাশিত বাধা এসে উপস্থিত হয়।
প্রকল্পটির মূল প্রস্তাবনায় বৃক্ষ রোপনের বিষয়ে কোনো কিছু উল্লেখ করা হয়নি। পাশাপাশি গাছের জন্য ছিল না কোনো অর্থ বরাদ্দ।
সিদ্দিক এবার উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেন। সরকারের কাছে অর্থ বরাদ্দ পেতে তাকে একটি বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা দাঁড় করাতে হয়।
প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ
সিদ্দিক এবং অন্যান্য কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎলাভের মাধ্যমে বিভাজকে ফুল গাছ রোপনের প্রস্তাবনা তুলে ধরার সুযোগ পেলেন। তিনি সংক্ষেপে পুরো বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নিকট ব্যখ্যা করেন।
"ফুল ফোটার পর গাছগুলো দেখতে কেমন হবে তা দেখানোর পাশাপাশি আমরা তাকে গাছের বেড়ে ওঠার বিভিন্ন ধাপ প্রদর্শন করলাম। নির্বাচিত ২৫টি ফুল গাছের ছবি আমি তাকে দেখালাম," বলেন সিদ্দিক।
"প্রধানমন্ত্রীই আমাদের পরবর্তী ধারণাটি দিলেন। তিনি আমাদের এমন ভাবে গাছ রোপন করতে যেন সারাবছরই কোনো না কোনো ফুল ফুটে," বলেন সিদ্দিক।
"মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কয়েকটি গাছের নাম যুক্ত করার পাশাপাশি কিছু গাছ বাদ দেন। পরবর্তীতে, ১৪টি গাছের তালিকা প্রস্তুত করা হয়," বলেন সিদ্দিক।
প্রাতিষ্ঠানিক অনুমোদন পেতে একনেকের কাছে প্রকল্প প্রস্তাবনা পাঠানো হয়।
ফুলের গাছ লাগানোর সময় জোনভিত্তিক ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী।
সেই অনুযায়ী, নির্ধারিত জোন কেন্দ্র করে গাছগুলো লাগানো হয় যেন যাত্রীরা ভ্রমণের সময় সৌন্দর্য্য থেকে বঞ্চিত না হয়।
"প্রতি চার থেকে পাঁচ কিলোমিটারে আমরা প্রতি এক ধরনের বৃক্ষ রোপনের সিদ্ধান্ত নেই যাতে করে যাত্রীরা পুরো ভ্রমণকালেই তা উপভোগ করতে পারে," বলেন সিদ্দিক।
"মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের কুর্চি ফুল যুক্ত করার পরামর্শ দেন। তখন তা আমাদের কাছে ছিল না। কিন্তু, যে কয়টি সম্ভব হয়েছে, আমরা সে কয়টি গাছ সংগ্রহ করি," বলেন তিনি।
কুর্চি গাছ দেশে প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছিল বলেও তিনি উল্লেখ করেন। বিভাজকে গাছগুলো লাগানোর পর সেখানে ফুল ফুটে। বর্তমানে দেশে অসংখ্য কুর্চি গাছ আছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
স্বপ্ন যেভাবে সত্যি হলো
পাঁচজন ঠিকাদার মহাসড়কের পাঁচটি অংশে গাছ লাগান।
গাছগুলো রোপনের শর্তসমূহ সহজ ছিল না। শর্তানুযায়ী, ঠিকাদারদের এক বছরের মধ্যে সবগুলো গাছ রোপন করার পাশাপাশি দুই বছর ধরে সেগুলোর যত্ন নিতে হবে।
পাশাপাশি, "এই সময়কালের ভেতর কোনো গাছ মারা গেলে, গাছ ঠিকভাবে বেড়ে না উঠলে বা ঝড়ে কোনো গাছ পড়ে গেলে তার পরিবর্তে নতুন গাছ রোপন করতে হবে," জানান এম এ এন সিদ্দিক।
৫২ হাজার গাছের মধ্যে আছে হৈমন্তী বা কুর্চি, রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া, টগর, কাঞ্চন, সোনালু, কদম, পলাশ, জারুল এবং করবী। সবথেকে বেশি রোপন করা হয়েছে ছয় হাজার ৯৬০টি সোনালু গাছ। অন্যদিকে, সবথেকে কম আছে বকুল গাছ। মহাসড়কে বকুল গাছের সংখ্যা দুই হাজার ২৯০টি।
দুই বছর ধরে ঠিকাদাররা গাছের দেখাশোনা করার পর বর্তমানে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের আঞ্চলিক কার্যালয়গুলো গাছের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছে।
স্থানীয়দের মনোভাবেও পরিবর্তন লক্ষ্য করার কথা জানান সিদ্দিক।
স্থানীয় বাসিন্দারা এসব ফুল তুলেন না। হাইওয়ে দিয়ে যাতায়াতকারীরাও এই উদ্যোগের প্রশংসা করেন। মানুষ এখন বিলুপ্তের পথে থাকা বহু বৃক্ষ রোপন করছে।
"হাইওয়ে দিয়ে যখন যাতায়াত করি তখন আমার ভীষণ আনন্দ লাগে। আমাদের অনেক কর্মকর্তাই প্রকল্পটির জন্য আমাকে স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন। তারা বলেন, বিষয়টি আমার মস্তিষ্কপ্রসূত এবং এর সফলতাও আমার জন্যই সম্ভব হয়েছে। সত্যিই আমার খুব ভালো লাগে," বলেন সিদ্দিক।
প্রকৃতিপ্রেমীরা যা বলছেন
প্রকৃতিপ্রেমী মোকারাম হোসাইনের মতে মহাসড়কে ফুলের গাছ রোপনের উদ্যোগ গ্রহণ সন্দেহাতীতভাবেই ইতিবাচক।
"কিন্তু, তাদের আরও পরিকল্পিতভাবে গাছগুলো রোপন করা উচিত ছিল," পর্যবেক্ষণ অনুসারে বলেন মোকারাম। "গাছগুলো নির্বাচনের আগে তারা উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিলে ভালো হত," বলেন তিনি।
তিনি বলেন, কাঞ্চনের মতো কিছু গাছ আছে যা সড়কে ছড়িয়ে পড়ছে।
এছাড়া, তারা কাঠগোলাপের মতো গাছ রোপন করতে পারত বলেও মন্তব্য করেন তিনি। ধীরগতিতে বেড়ে ওঠা কাঠগোলাপ সারাবছর ফুল দেয়।
তবে, সিদ্দিক জানান তারা সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের আরবরিকালচার বিভাগের পরামর্শ অনুসারেই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।
"আরবরিকালচারের কর্মীরা কৃষি বিষয়ে অভিজ্ঞ," বলেন মোকারাম।
"একজন কৃষিবিদ এবং এবকজন উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞের মতামত এক হবে না। উদ্ভিদবিদদের কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণ করা হলে তা আরও কার্যকরী হত," বলেন তিনি।
মহাসড়কে গাছের রক্ষণাবেক্ষণ
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের কুমিল্লা এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলের কার্যালয় ১৯২ কিলোমিটার চার লেনের মহাসড়কের ফুল গাছগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে।
সাধারণত, আঞ্চলিক অফিস দুটো তৃতীয় পক্ষকে নিয়োগের মাধ্যমে গাছগুলো দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করে থাকে। মাঝেমধ্যে, দিনমজুরদের সাহায্যে গাছে পানি দেওয়া এবং পাতা ও গাছের ধুলোবালি অপসারণ করা হয়।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এবং কুমিল্লা আঞ্চলিক অফিসের প্রধান শওকত আলী জানান, জাতীয় মহাসড়কে বৃক্ষ রক্ষণাবেক্ষণ করা একটি বিশাল দায়িত্ব। এর আগে ঠিকাদার থাকলেও ছয় মাস আগে সেই চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যায় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
চট্টগ্রাম আঞ্চলিক অফিসের প্রধান এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রকৌশলীও একই কথা জানান। তৃতীয় পক্ষের ঠিকাদারের সাথে কয়েক মাস আগে চুক্তি শেষ হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে দিনমজুরদের কাজে লাগানোর মাধ্যমে গাছগুলোর দেখাশোনা করা হয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।