দৌড়: মানবদেহের এক সম্মিলিত কার্যক্রম
এই যে আমরা আজ এত স্বাচ্ছন্দ্যে জোরে ছুটতে পারি, এরজন্য অবশ্যই বিবর্তন প্রক্রিয়াকে ধন্যবাদ জানানো দরকার। পনিটেইল করে চুল বাঁধা কাউকে একবার শুধু দৌড়াতে দেখুন। বাতাসের বেগে উড়ন্ত চুল ডানে-বায়ে ক্রমাগত কেমন অসীম চিহ্ন তৈরি করে! দৌঁড়ানোর সময় যে গতি উৎপন্ন হয়, তারসঙ্গে তাল মেলাতেই চুলের এই হাল।
এখন একবার ভাবুন, দৌড়ের সময় আপনার মাথা কীভাবে স্থির থাকে? জড়তা সত্ত্বেও শরীরের ঊর্ধাঙ্গ কীভাবে সামলে নেয়? এমনকি চোখের দৃষ্টিই-বা আমরা কীভাবে সামনে বরাবর স্থির রাখি?
বিবর্তনের ফলে ক্রমবিকাশ না ঘটলে ছোটার সময় আমাদের মাথার অবস্থাও পনিটেইলের মতোই হতো বলে দাবি করছে নতুন এক গবেষণা। হাঁটার সময় আমাদের শরীর যেভাবে কাজ করে, তার থেকে এই পদ্ধতি ভিন্ন। গবেষণাটির তথ্য অনুযায়ী মানুষের কাঁধ এবং হাতের কয়েকটি পেশির এক বিরল সমন্বয়ের ফলেই দৌড়ানোর সময় মাথা স্থির থাকে এবং মানুষ সামনের দিকে বরাবর গিয়ে যেতে পারে।
গবেষণাটি গতির সঙ্গে আমাদের শরীরের ওপরের অংশের তাল মেলানো সম্পর্কিত পুরোনো এক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। দৌড়ানোর সময় প্রতি পদক্ষেপে অজ্ঞাতসারেই আমাদের হাত কেন সামনে এবং পিছনে সঞ্চালিত হয়, সেই প্রশ্নেরও উত্তর দেবে এই গবেষণা। এমনকি নতুন এই প্রতিবেদন অনুসারে, সেই আদিমকালে মানুষের দৌড়ানোর অভ্যাস আমাদের শরীরকে এমন আকৃতি ও গঠন দিয়েছে, যা আমাদের বর্তমান জীবনযাপনের ধরন নির্মাণেও রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
মানুষের জন্মই হয়েছে ছুটে বেড়াতে- এই ধারণার ওপর নির্ভর করে বহু গবেষণা, সাহিত্য, বই ও বিতর্ক জন্ম নিয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। এরমধ্যে রয়েছে সাংবাদিক ক্রিস্টোফার ম্যাকডোগালের ২০০৯ সালের বেস্টসেলার বই 'বর্ন টু রান'। ফসিল গবেষণার মাধ্যমে আদিম মানুষের বহু দূর পর্যন্ত দৌড়ানোর সুবিধার্থে পায়ের অস্থির বিশেষ বিবর্তনসহ অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের ক্রমবিকাশ সংক্রান্ত ধারণা পাওয়া যায়। এই ধারণার ওপর ভিত্তি করেই বইটি লেখা। এখানে বলা হয়েছে, কীভাবে আদিম মানুষকে শিকার কিংবা ভাগ্যান্বেষণের জন্য ছুটে বেড়াতে হতো। আর সেখান থেকেই প্রাকৃতিক নির্বাচনের কারণে দৌড়ে দক্ষ মানুষেরা প্রভাব বিস্তার করে টিকে থাকতে পেরেছিল।
গবেষণার অধিকাংশ তথ্যই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান ইভল্যুশনারি এনাটমি বিষয়ের অধ্যাপক এবং 'এক্সারসাইজড' বইটির লেখক ড্যানিয়েল লিবারম্যানের গবেষণাগার ও মস্তিষ্কপ্রসূত। লিবারম্যানের বইটিতে শরীরচর্চা ও বিবর্তনের সম্পর্ক অনুসন্ধান করা হয়েছে। প্রথম দিকে লিবারম্যান ও অন্যান্য বিজ্ঞানীর মনোযোগ দৌড়ানোর সময় পা ও শরীরের নিচের অংশে ছিল। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়ার ক্ষেত্রে পদযুগলকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হতো।
তবে লিবারম্যান মানুষের ঊর্ধাঙ্গ, বিশেষত মাথার বিষয়েও আগ্রহী ছিলেন। নিজে ম্যারাথন দৌড়বিদ হওয়ায় তিনি জানতেন, সফলভাবে দৌড়ানোর জন্য মাথা স্থির রাখা কতটা কঠিন। দৌড়ানোর জন্য শরীরকে সম্মুখদিকে পরিচালিত করতে হয়। এ সময় যে জোরের মাধ্যমে শরীরকে সামনে পরিচালিত করা হয়, তাতে মাথার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সেই পনিটেইলের মতো হওয়ার কথা।
তবে আমরা আমাদের মস্তিষ্ককে কীভাবে স্থির রাখি, তা পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। কুকুর ও ঘোড়ার মতো দৌড়াতে সক্ষম সকল প্রজাতির প্রাণির (কারসোরিয়াল) নিউকাল লিগামেন্ট বেশ উন্নত। এই লিগামেন্ট খুলির সঙ্গে ঘাড়ের সংযোগ স্থাপন করে। অন্যদিকে, এপ বা শূকরের মতো যেসব প্রাণি প্রাকৃতিকভাবে দৌড়াতে পারে না, তাদের লিগামেন্টটি এতো উন্নত নয়।
তরুণ বয়সে ড. লিবারম্যান শূকরকে ট্রেডমিলে উঠিয়ে তাদের দৌড়াতে প্রলুদ্ধ করতেন। প্রাণিগুলোকে দৌড়াতে বাধ্য করা হলে তাদের মাথা সজোরে দোল ও ঝাঁকুনি খেত। এখান থেকেই লিবারম্যান ও তার সহযোগীরা ধারণা করেন, ওদের নিউকাল লিগামেন্ট নেই।
তবে মানুষের জন্যও শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করা সহজ বিষয় নয়। আর তাই দৌড়ানোর এক পর্যায়ে ভারসাম্য ঠিক রাখতে অজান্তেই আমাদের হাত সামনে পিছে দুলতে থাকে। লিবারম্যান ধারণা করেন, হাতের এই সঞ্চালন মস্তিষ্কের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। আর তা-ই যদি হয়, তাহলে হাতের কনুই থেকে কবজি পর্যন্ত অংশের সঙ্গে অবশ্যই আমাদের কাঁধের পেশির সংযোগ রয়েছে। যদিও এই পেশিগুলো সরাসরি যুক্ত নয়; তাদের মাঝে অবশ্যই সম্পৃক্ততা থাকার কথা। দৌড়ানোর সময় গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মস্তিষ্ককে স্থির রাখতে হলে হাত ও মাথাকে অবশ্যই একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
তবে কীভাবে এই সূত্র প্রমাণ করবেন, সে সম্পর্কে লিবারম্যান স্থির হতে পারছিলেন না। এ সময় তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন হার্ভার্ডের সহকর্মী এন্ড্রু ইগিয়ান। তিনি লিবারম্যানকে মাথা ও হাতে ভার বৃদ্ধির পরামর্শ দেন এবং পেশির কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে বলেন। এন্ড্রু বলেন, এর মাধ্যমেই বলা যাবে- মাথাকে স্থির রাখতে হাতের কারসাজি আছে কি না।
গত মাসে আমেরিকান জার্নাল অব ফিজিকাল এনথ্রোপলজিতে প্রকাশিত নতুন এই গবেষণার জন্য লিবারম্যান, ইগিয়ান ও তাদের সহকর্মীরা মিলিতভাবে ১৩ জন নারী-পুরুষ স্বেচ্ছাসেবকের ওপর পরীক্ষা চালান। অংশগ্রহণকারীদের শরীরের উপরের অংশে পেশির কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে সেন্সর স্থাপন করা হয়। এরপর প্রথমে তাদের ট্রেডমিলে হাঁটার এবং পরে দৌড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। পুরো কার্যক্রম গবেষকেরা মোশন ক্যাপচার বা গতিধারক প্রযুক্তির মাধ্যমে চিত্র ধারণ করেন।
এরপর অংশগ্রহণকারীদের হাতে ভারি কিছু দিয়ে তাদের পুনরায় দৌড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। শেষ ধাপে ভারি একটি মুখোশ পরে স্বেচ্ছাসেবকরা দৌড়ান। প্রতি সেশনে অংশগ্রহণকারীদের পেশি কার্যক্রম তুলনা করা হয়।
দেখা যায়, স্বেচ্ছাসেবকরা হাঁটার সময় তেমন কিছু ঘটেনি। কনুই থেকে কবজি পর্যন্ত হাতের পেশির সঙ্গে কাঁধের পেশির কোনো সমন্বয় ছিল না। কিন্তু তারা যখনই দৌড়ানো শুরু করেন, এই দুই পেশি একতালে একইসঙ্গে কাজ করা শুরু করে।
ভার নিয়ে দৌড়ানোর সময় অংশগ্রহণকারীরা যখন আরও অধিক বল প্রয়োগ করেন, তখন সেই বলের সঙ্গে সামঞ্জস্যতা রেখে মিলিত তাল আরও বাড়তে থাকে।
তবে কীভাবে এই পৃথক পেশিগুলো একসঙ্গে কাজ করল, সে সম্পর্কে গবেষণাটি কিছু বলতে পারেনি। এমনকি বিবর্তনের কোন পর্যায়ে এগুলো একসঙ্গে কাজ করা শুরু করল, সে সম্পর্কেও গবেষণাটিতে আলোকপাত করা হয়নি। হতে পারে মানব প্রজাতির শুরু থেকেই এগুলো সম্মিলিতভাবে কাজ করে এই প্রজাতিকে দিয়েছে ভিন্নতা। তবে তার মানে এই নয়, জন্মগতভাবেই মানুষ দৌড়ানোর বিষয়ে বিজ্ঞ। বরং অনেক মানুষই দৌড়ঝাঁপ তেমন পছন্দ করেন না।
তবে গবেষণাটি আমাদের শরীর সম্পর্কে এমন অনেক নতুন তথ্য দিয়েছে, যা আগে জানতাম না। দৌড়ের ওপর জোর দিয়ে ড. লিবারম্যান বলেন, দৌড়ানোর সক্ষমতা মানবজাতিকে স্বাতন্ত্র এনে দিয়েছে। 'আদিমকালে মানুষকে যদি দৌড়াতে না হতো, তাহলে আজ আমাদের দেহের পেশিগুলো একসঙ্গে কাজ করতে শিখত না,' বলেন তিনি।
- সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস