নৃশংস অলিম্পিক!
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2021/08/02/screenshot.png)
৩ জুলাই ১৯৩৬। মাত্র এক মাস পরই শুরু হবে বার্লিন অলিম্পিক—পরে যা 'নাৎসি অলিম্পিক' নামে পরিচিতি পায়। ইউরোপগামী জাহাজে চেপে বসলেন একদল আমেরিকান অ্যাথলেট।
মার্কিন অ্যাথলেটদের দলে ছিলেন হার্লেমের কৃষ্ণাঙ্গ স্প্রিন্টার, ম্যানহাটনের ইহুদি জিমন্যাস্ট এবং পিটসবার্গের দোআঁশলা বক্সার। তাদের কোচ আব্রাহাম আলফ্রেড 'চিক' চাকিন—একজন অভিবাসী। রাশিয়া থেকে পালিয়ে আমেরিকায় ঠাঁই নিয়েছিল তার পরিবার। রেসলিং থেকে অবসর নেওয়া চাকিন ফিরে এসেছেন অ্যাথলেটদের প্রশিক্ষণ দিতে।
এই অ্যাথলেটদের গন্তব্য কিন্তু জার্মানির অফিসিয়াল অলিম্পিক নয়। তারা যাবেন 'পপুলার অলিম্পিক'-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। 'সর্বকালের সেরা ফ্যাসিবাদবিরোধী অনুষ্ঠান' আয়োজনের প্রত্যয়ে আয়োজিত হতে যাচ্ছিল এই পপুলার অলিম্পিক।
১৯৩৬-এর বার্লিন অলিম্পিক অবিস্মরণীয় হয়ে আছে কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান স্প্রিন্টার জেসি ওয়েন্সের কল্যাণে। সেই অলিম্পিকে তিনি সবচেয়ে বেশি স্বর্ণপদক জিতে নিয়ে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিলেন উগ্র নাৎসি আদর্শের অহংকারকে। এদিকে পপুলার অলিম্পিকের অ্যাথলেটরা ভেবেছিলেন তাদের আয়োজন ফ্যাসিবাদ-বিরোধী আন্দোলনের শক্তি বিশ্ববাসীকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে।
কিন্তু এই ক্রীড়াবিদরা অচিরেই উপলব্ধি করেন, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এই লড়াই তারা যতটা ভেবেছিলেন তার চেয়ে অনেক বেশি নির্মম ও নৃশংস হতে যাচ্ছে।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2021/08/02/1.png)
পপুলার অলিম্পিক উদ্বোধন হওয়ার কথা ছিল ১৯৩৬-এর ১৯ জুলাই। জার্মানিতে অনুষ্ঠিতব্য আনুষ্ঠানিক অলিম্পিক বর্জনের ডাক দিয়ে এই বিকল্প অলিম্পিকের আয়োজন করা হয়েছিল। অলিম্পিকের ইতিহাসে এরকম বয়কটের ঘটনা এটাই প্রথম।
অবশ্য বৈশ্বিক কোনো ঘটনার কারণে অলিম্পিক স্থগিত হয়ে যাওয়ার ঘটনা আগেও ঘটেছে। ১৯১৬ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে অলিম্পিক স্থগিত হয়ে যায়। তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এবং ২০২০-এর কোভিড মহামারির সময়ও অলিম্পিক স্থগিত হয়।
যা-ই হোক, ১৯৩৬ সালে জার্মানিতে যা হচ্ছিল, সেদিক থেকে বিশ্ববাসী আর চোখ ফিরিয়ে রাখতে পারল না। হিটলার তখন ভার্সাই চুক্তি লঙ্ঘন করে রাইনল্যান্ডে ফের সেনাবাহিনী নামিয়েছেন। ইহুদি, রোমা, বামপন্থী, সমকামী এবং প্রতিবন্ধীদের ধরে ধরে বন্দিশিবিরে পাঠাচ্ছেন।
এত কিছুর পরও অলিম্পিক বর্জনের আহ্বান সফল হলো না। ফলে ১৯৩৬-এর এপ্রিলে প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্য ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স ফর দ্য রেসপেক্ট অফ দি অলিম্পিক আইডিয়াল-এ একটি বিকল্প প্রস্তাব রাখা হয়।
বামপন্থী, উদারপন্থী, কমিউনিস্ট ও সমাজতন্ত্রীদের নিয়ে গঠিত বৃহত্তর জোট একটি বিকল্প অলিম্পিকের আয়োজন করা হবে। বার্সেলোনার কাতালান সরকার এ গেমসের আয়োজক হবার প্রস্তাব রাখে। প্রায় ২০ হাজার ফ্যাসিবাদ-বিরোধী অ্যাথলেট ও ক্রীড়ানুরাগী এই গেমসে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
অলিম্পিকের বিকল্প অনুষ্ঠান আয়োজনের ধারণাটি নতুন নয়। অভিজাততন্ত্রের প্রতি আনুষ্ঠানিক অলিম্পিকের পক্ষপাতের প্রতিবাদে ১৯২১ সাল থেকে প্রতি চার বছর পরপর ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কার্স অলিম্পিয়াড অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। এছাড়াও ১৯৩২ সাল থেকে শুরু হওয়া ম্যাকাবিয়াহ গেমস আজও চলছে। তবে ম্যাকাবিয়াহ গেমস মূলত ইহুদি ও ইসরায়েলি অ্যাথলেটদের জন্য আয়োজন করা হয়।
সিদ্ধান্ত হয়েছিল পপুলার অলিম্পিক হবে একেবারেই অন্যরকম। বিশেষ করে বার্লিনের আনুষ্ঠানিক গেমসের চেয়ে আলাদা তো হবেই।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রথমে স্টেডিয়ামে প্রবেশ করবে ইউরোপ থেকে নির্বাসিত ইহুদি ও উত্তর আফ্রিকার উপবিনেশ-অধ্যুষিত অ্যাথলেটরা। তাদের হাতে যেমন রাষ্ট্রবিহীন জাতির পতাকা যেমন থাকবে, তেমনি থাকবে রাষ্ট্রভুক্ত জাতির পতাকাও। তারা স্টেডিয়ামে প্রবেশের মুহূর্তে কাতালান কবির লেখা ও নির্বাসিত জার্মান ইহুদির সুর করা গান গাওয়া হবে।
২১টি জাতির লোক উপস্থিত থাকবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। গেমসের প্রথম খেলা হবে ১০×১০০ মিটার রিলে। ১০ জন অ্যাথলেট দৌড়াবেন সেই রেসে। মাত্র একজন ব্যক্তির মেধার বদলে কর্মজীবী শ্রেণির মিলিত পরিশ্রমকে বেশি মর্যাদা দেওয়ার জন্য ১০ জন দৌড়াবেন।
সিদ্ধান্ত হয়েছিল, নারীরাও অংশ নেবেন পপুলার অলিম্পিকে। এবং বার্লিনের আনুষ্ঠানিক অলিম্পিকের চেয়ে বেশি ইভেন্টে নিজেদের দক্ষতা দেখানোর সুযোগ পাবেন নারীরা।
মাত্র তিন মাসের পরিকল্পনায় আয়োজন করা পপুলার অলিম্পিকে আনুষ্ঠানিক অলিম্পিকের মতো বিলাস-ব্যসন সরবরাহ করা সম্ভব ছিল না। বার্লিন অলিম্পিকে অংশ নেওয়া অ্যাথলেটদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল সদ্য নির্মিত অলিম্পিক ভিলেজে। অলিম্পিক শেষ হওয়ার পর এখানে জার্মান সেনাবাহিনীর কন্ডর লিজনের থাকার ব্যবস্থা হয়। এ বাহিনী গুয়ের্নিকার বাস্ক শহরে বোমা ফেলে শত শত বেসামরিক মানুষকে হত্যা করে।
বার্সেলোনায় অ্যাথলেটদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল স্থানীয় বাসিন্দাদের বাড়িতে, হোস্টেলে এবং হোটেল অলিম্পিকে। গেমস শুরু হওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগেও কাতালান কর্তৃপক্ষ হন্যে হয়ে অ্যাথলেটদের জন্য থাকার জায়গা খুঁজছিল।
প্রথমে পপুলার অলিম্পিকের স্থায়িত্বকাল ঠিক করা হয়েছিল ৪ দিন। পরে তা বাড়িয়ে এক সপ্তাহ করা হয়। ফলে ৪ দিনের বিজ্ঞাপন দিয়ে সাঁটানো সমস্ত পোস্টার আবার ঠিকঠাক করতে হয়।
মার্কিন দল বার্সেলোনায় পৌঁছায় ১৫ জুলাই। আসার আগেই তারা গুজব শুনেছিলেন স্পেনে অস্থিরতা চলছে—অচিরেই অভ্যুত্থান হবে দেশটিতে। তবে মার্কিন দলের একমাত্র নারী সদস্য স্প্রিন্টার ডট টাকার পরে সে সময়ের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে বলেন, 'আমরা ভয় পাইনি।'
মার্কিন অ্যাথলেটদের বার্সেলোনার বার ও নাইটক্লাব থেকে দূরে রাখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন চাকিন। বৃথা সেই চেষ্টা। তবে গেমস শুরু হওয়ার আগের রাতে তারা একটু আগেভাগেই শুতে যান।
বিছানায় যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর কামানের গর্জন, হাজার হাজার মেশিনগান ও রাইফেলের গুলির শব্দ এবং সৈন্যদের পায়ের আওয়াজে তাদের ঘুম ভেঙে যায়। হোটেলের জানালা দিয়ে অ্যাথলেটরা দেখতে পান স্থানীয় নারী-পুরুষ বালির বস্তার ভেতরে খোয়া ভরে ব্যারিকেড বানাচ্ছেন। খানিক বাদেই স্প্যানিশ সেনাবাহিনী প্রবেশ করে শহরে। উদ্দেশ্য কাতালান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা।
ব্যারিকেড তৈরি করা বেসামরিক নাগরিকরা সেনাবাহিনীকে বাধা দেয়। পরে এক সাক্ষাৎকারে অ্যাথলেট পেটন বলেন, 'সমাজবাদী, কমিউনিস্ট ও ইউনিয়নিস্টরা ফ্যাসিবাদকে উৎখাত করার জন্য এক হয়েছিল। মহিলারা ব্যারিকেড গড়ে তোলে। কিছু কিছু মহিলা তো ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াইরত শ্রমিকদের দলকে নেতৃত্ব পর্যন্ত দিয়েছিল।'
এই নারীদের অনেকেই ফেমিনিস্ট স্পোর্টস ক্লাবের উদ্যোক্তা ছিলেন। এ ক্লাব কাতালান তরুণীদের পুরুষদের সমকক্ষ হিসেবে প্রতিযোগিতা করতে, লড়াইয়ে নামতে আহ্বান জানিয়েছিল।
কাতালানদের এই লড়াই তরুণ আমেরিকান অ্যাথলেটদের ওপর বিশাল প্রভাব ফেলে। গোলাগুলি বন্ধ হওয়ার সঙ্গে দলের বাকিদের নিয়ে বাইরে ছুটে যান পিটসবার্গের জাতীয় বক্সিং চ্যাম্পিয়ন চার্লি বার্লি। বেলচা কুড়িয়ে নিয়ে আবার ব্যারিকেড ঠিকঠাক করার কাজে লেগে পড়েন তারা।
তাদের সঙ্গে যোগ দেন নির্বাসিত জার্মান ও ইতালিয়ান অ্যাথলেটরা। তারা জানতেন, তাদের দেশে ফেরার একমাত্র উপায় হচ্ছে ফ্যাসিবাদকে উৎখাত করা। প্রথমে স্পেন থেকে, তারপর বার্লিন ও রোম থেকে। অস্ত্রাগার থেকে লুট করা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে স্প্যানিশ সেনাবাহিনীকে রুখে দেওয়ার জন্য গোটা শহরে টহল দিতে থাকে কাতালান শ্রমিকরা।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আপাত জয় পায় কাতালানের ফ্যাসিবাদ-বিরোধীরা। বাতিল হয়ে যায় পপুলার অলিম্পিক। শুরু হয় স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ।
লড়াই শেষ হওয়ার পর অ্যাথলেটদের দলগুলো রাস্তায় নেমে পড়ে। সবার মুখে বামদের গান—'দি ইন্টারন্যাশনেল'। একজন ফরাসি অ্যাথলেট মারা যান সেই লড়াইয়ে। অলিম্পিক দেখতে আসা ১৫ হাজার মানুষ হতাহত হন। ওই সপ্তাহের শেষ দিকে অনেক অ্যাথলেট বার্সেলোনা ছাড়েন। আয়োজকরা তাদের বলেন, স্পেনে তারা যা দেখেছেন, সে খবর যেন গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে দেন।
বার্সেলোনায় দেখে আসা নৃশংসতা চাকিনকে তাড়িয়ে বেড়াত। বেশিদিন আমেরিকায় বসে থাকতে পারেননি তিনি। পরের বছরই স্ত্রী জেনি বারম্যান চাকিনকে নিয়ে ফিরে যান স্পেনে। যুদ্ধে বাস্তুচ্যুত হওয়া শিশুদের জন্য আর্ট থেরাপি প্রোগ্রাম চালু করেন। যুদ্ধেও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন চাকিন। ম্যাকেঞ্জি-পাপিনিউ ব্যাটালিয়নে কোয়ার্টারমাস্টারের কাজ করেন তিনি।
১৯৩৮ সালে জাতীয়তাবাদীদের হাতে ধরা পড়েন চাকিন। জাতীয়তাবাদীরা তাকে হত্যা করে।
পপুলার অলিম্পিকে অংশ নিতে যাওয়া ২০০ অ্যাথলেট স্পেনে রিপাবলিকানদের হয়ে যুদ্ধ করেছেন। তাদের বেশিরভাগই যুদ্ধে প্রাণ হারান।
১৯৩৬-এ যেসব ফ্যাসিবাদ-বিরোধী অ্যাথলেট বার্সেলোনায় পপুলার অলিম্পিকে অংশ নিতে গিয়েছিলেন, সত্যিকার জীবন-মৃত্যুর খেলায় নেমেছিলেন তারা।
সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক