খাবারের জন্য ঘরে না ফেরা পুলিশের পাশে তিন বন্ধু
রাত সাড়ে ৯টা। লকডাউনের কারণে স্বাভাবিক দিনের ব্যস্ততম সড়কটিতে এরই মধ্যে বিরাজ করছে শুনশান নীরবতা। রাস্তায় মানুষতো দূরের কথা, কোনও প্রাণীও নেই। গা ছমছমে এই পরিবেশের মধ্যেই দায়িত্ব পালন করছেন কয়েকজন পুলিশ সদস্য। রাজশাহী নগরীর প্রবেশপথ কাশিয়াডাঙার রোববার রাতের চিত্র এটি।
একটি গাড়ির হেডলাইট ক্রমেই দৃশ্যমান হতে থাকে। কাশিয়াডাঙার ওই চেকপোস্টের দিকে কিছুক্ষণের মধ্যে এগিয়ে আসে একটি প্রাইভেটকার। কতজন ডিউটি করছেন জানতে চেয়ে ১১টি খাবারের প্যাকেট তাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে গাড়িটি চলে যায়। তবে গাড়িতে পুলিশ বা সরকারি কোনো লোক ছিলনা। তিন বন্ধু নিজস্ব উদ্যোগে গত এক সপ্তাহ ধরে রাতে ডিউটিরত পুলিশ সদস্যদের কাছে এভাবেই খাবার পোঁছে দিচ্ছেন।
ওইদিন সেখানে ডিউটিতে ছিলেন এএসআই আতাউর রহমান। তিনি বলেন, রাত সাড়ে ৯টার দিকে একটি প্রাইভেটকারে তিনজন মানুষ এসেছে জিজ্ঞেস করেন, আপনারা কতজন আছেন। তারপর প্রত্যকের জন্য একটা করে খাবারের প্যাকেট দেন। পরে শুনলাম, গত কয়েকদিন ধরেই নাকি তারা এভাবে পুলিশদের খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন।
আতাউর বলেন, কাশিয়াডাঙা চেকপোস্টে শিফট অনুযায়ী ডিউটি পালন করতে হয়। আমরা দুপুর ২টা থেকে রাত ১১ টা পর্যন্ত ডিউটি করি। তারপর আরেকটা টিম আসে। আমরা এমনিতে ইফতারের সময় বাসা থেকে খাবার আনি। অন্য সময়ে দোকানপাট খোলা থাকতো। তখন ইফতারের পরও আমরা রাতে অন্য খাবার খেতে পারতাম। এখন লকডাউনের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে আমাদের কষ্টই হতো। তবে সে কষ্ট এখন কমেছে। ওই তিনজন আমাদের খাবার দিয়ে যাচ্ছেন।
ওইদিন রাতে নগরীর টহল পুলিশের দায়িত্বে ছিলেন বোসপাড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এস আই মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, টহল পুলিশকে রাত ৮টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত টানা ডিউটি করতে হয়। রোববার রাতে আমরা পাঁচজন ডিউটিতে ছিলাম। তখন ওই তিন জন মানুষ এসে আমাদের খাবার দিয়ে গেছেন।
করোনাকালের দুঃসময়ে রাতে খাবার হোটেল সব বন্ধ থাকে। রাতে রাজশাহী নগরীর নিরাপত্তা রক্ষায় দায়িত্ব পালনরত পুলিশ সদস্যদের খাওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না। বাসা থেকে রাতে খেয়ে ডিউটিতে যারা যোগ দেন তারা সকাল হওয়ার আগ পর্যন্ত আর বাসায় ফিরতে পারেন না।
যে তিনজন এই উদ্যোগ নিয়েছেন তারা হলেন, রাজশাহী নগরীর পদ্মা আবাসিক এলাকার হাসিবুল আলম শাওন, ষষ্ঠীতলা এলাকার কামাল হোসেন এবং টিকাপাড়া এলাকার রাসেল। তারা সবাই রাজশাহী কলেজের এইচএসসি ৯৪ সালের ব্যাচের ছাত্র। তাদের 'আরসি-৯৪' নামের একটি সংগঠনও রয়েছে।
তিনজনের মধ্যে হাসিবুল আলম শাওন ব্যবসা করেন। কামাল হোসেন একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন। আর রাসেল কবির রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষক।
হাসিবুল আলম শাওন বলেন, আমরা গত ২ এপ্রিল থেকে আমাদের 'আরসি-৯৪' সংগঠনের ব্যানারে রাজশাহী নগরীর দরিদ্র শ্রমজীবী ও নিম্নবিত্ত ১০০০ পরিবারের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেছি। গত এক সপ্তাহ ধরে আমরা তিন বন্ধু মিলে পুলিশ সদস্যদের মাঝে রাতে খাবার পৌঁছে দিচ্ছি। আমরা পুরো রমজানজুড়েই এ কাজটি করতে চাই।
তিনি বলেন, এখন করোনাকালের দুঃসময়ের কারণে রাতে সব হোটেল রেস্তোরাঁ বন্ধ থাকে। রাত ৮টায় পুলিশের ডিউটি শুরু হলেও তারা সকাল ১০টার আগে বাড়ি যেতে পারে না। দীর্ঘ সময় তাদের খেয়ে না খেয়ে কাটাতে হয়। বিষয়টা খুবই কষ্টের। তাই চেকপোষ্ট ও টহলরত পুলিশের জন্য আমরা রাতে খাবার পৌঁছে দিই। চেষ্টা করি সর্বোচ্চ পরিমাণ প্রোটিন রাখতে। খাবারের তালিকায় থাকে, পানি, পাস্তরিত প্যাকেটজাত দুধ, ডিম, কলা, রুটি ও বিস্কুট।
আরেক তরুণ কামাল হোসেন বলেন, আমরা প্রথমত রাত সাড়ে ৮টার দিকে গাড়িতে খাবার ভর্তি করে তিন বন্ধু বের হয়ে যাই। প্রথমে যাই নগরীর কাশিয়াডাঙ্গা চেকপোস্টে, সেখানে ১২/১৪ জন পুলিশ সদস্য থাকেন। তাদের খাবার দিয়ে যাই নওদাপাড়া মোড় চেকপোস্টে। সেখানে খাবার পৌঁছে দিয়ে যাই কাটাখালী চেকপোস্টে। তারপর আসি তালাইমারী মোড় চেকপোস্টে। এরপর আমরা নগরীর মধ্যে টহলরত পুলিশ সদস্যদের মাঝে খাবারগুলো পৌঁছে দিই।
তিনি বলেন, এছাড়া চার থানার টহল পুলিশ ইনচার্জের নাম্বার আমাদের কাছে আছে। ফোন করে খোঁজ নিয়ে তাদেও কাছেও খাবার পৌঁছে দিই। এছাড়া নগরীর লক্ষ্মীপুর পুলিশ বক্সেও খাবার দেই।
নগরীর বোয়ালিয়া থানার ওসি নিবারণ চন্দ্র বর্মণ বলেন, রোববার রাতে বের হয়ে আমাদের করোনাকালীন দুর্যোগে নিয়োজিত বিশেষ মোবাইল টিমের ইনচার্জকে ফোন দিয়ে সেখানে গিয়ে দেখি, তিন যুবক খাবারের প্যাকেট নিয়ে এসেছেন। পরে তারা আমাদের টহলরত পুলিশ সদস্যদের হাতে খাবারগুলো তুলে দেন।
রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার গোলাম রুহুল কুদ্দুস বলেন, চেকপোস্টের পুলিশরা রাতে টানা ৯ ঘণ্টা ডিউটি করে। আর থানার টহল পুলিশদের রাতে টানা ১২ ঘণ্টা ডিউটি করতে হয়। এই সময়ের মধ্যে স্পট থেকে সরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, আগে দোকানপাট খোলা থাকতো, ফলে রাতে তারা খাবার খাওয়ার সুযোগ পেত। এখন পরিস্থিতি এমন যে একটা চায়ের স্টলও খুলতে দিইনা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আমরাই তা করেছি। ফলে কষ্টটা পুলিশকেই বেশি ভোগ করতে হয়।