বাহ্! পাটের শতরঞ্জি, কাঠের প্লেট-বাটি, বাঁশের মগ-কাপ!
"বাংলাদেশের মানুষের কি পরিবেশ সচেতন হওয়ার দরকার নেই? পরিবেশবান্ধব জিনিস বানিয়ে আমরা বিদেশে পাঠিয়ে দেই। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে এসব জিনিস ব্যবহার করার অভ্যাস তৈরি করিনা। দেশের মানুষকে পরিবেশবান্ধব জীবনধারায় অভ্যস্ত করতেই আমাদের এই আয়োজন," বলছিলেন 'বাহ্' ব্র্যান্ডের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মিরাজুল হক।
যা দেখায় তার চেয়েও বেশি কিছু দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বাহ্। পরিবেশবান্ধব কাঁচামালে নান্দনিক গৃহসামগ্রী তৈরির অনলাইন ব্র্যান্ড এটি। সোনালি আঁশ পাটের তৈরি নানা পণ্যের পাশাপাশি আছে কাঠ, বাঁশ ও ডেনিমের তৈরি ভিন্নধর্মী নানা সামগ্রী। নিজস্ব ডিজাইনে দেশের স্থানীয় শিল্পীদের দিয়ে তৈরি এসব পণ্য প্রগতিশীল ক্রেতাদের হাতে পৌঁছে দিয়ে ক্ষুদ্র কুটির শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বাহ্-এর উদ্যোক্তারা।
২০২০ সালের জুলাই মাসে অনলাইন স্টোর বাহ্-এর যাত্রা শুরু করলেও, দেশে পাটজাত পণ্য নিয়ে কাজের সাথে ২০১৭ সাল থেকেই জড়িত আছেন মিরাজুল হক। ফৌজদরহাট ক্যাডেট কলেজের এই সাবেক ছাত্র নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ পড়া শেষে নানা ইকমার্স সাইটের সাথে যুক্ত ছিলেন। দেশের বাজারে পাটজাত পণ্যের চাহিদা তৈরির জন্য কাজ করেছেন সেসব ক্ষেত্রেও।
'উইমেন্স ইকোনোমিক এমপাউয়ারম্যান্ট থ্রো স্ট্রেটনিং মার্কেট সিস্টেম' এর সাথে কাজ করতে গিয়ে রংপুর, নীলফামারি, সৈয়দপুর, কুড়িগ্রামের কুটির শিল্পীদের সাথে পরিচয় হয় মিরাজুল হকের। তখন থেকেই দেশীয় এই কারিগরদের কাজকে নান্দনিক রূপে সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার চিন্তা শুরু করেন।
বড় বোন আর স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়েই করোনার অবসরে মিরাজুল হক পুরোদমে কাজ শুরু করেন বাহ্ ব্র্যান্ডের। রংপুর, নীলফামারি, সৈয়দপুর, কুড়িগ্রামের কুটির শিল্পীদের কাছ থেকে নিজস্ব ডিজাইনে তৈরি করে আনেন পাটজাত পণ্য। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের কারিগররা তৈরি করেন কাঠ ও বাঁশের নানা সামগ্রী।
বাহ্ এর উল্লেখযোগ্য পণ্য গুলোর মধ্যে আছে পিভিসি দিয়ে তৈরি কোস্টার, ব্যতিক্রমী ডিজাইনের শতরঞ্জি, বোহেমিয়ান প্যাটার্নের ব্যাগ, জুটকটনের তৈরি ল্যাপটপ ব্যাগ, পাটের তৈরি লন্ড্রি ব্যাগ, কাঠের প্লেট-বাটি, বাঁশের মগ-কাপ, ইত্যাদি।
বাহ্-এর পণ্যের ডিজাইনে 'মিনিমালিজম' এর ধারা বজায় রাখার চেষ্টা করেন উদ্যোক্তারা। নান্দনিক সীমিত ডিজাইন যেন সবার নজর কাড়ে সে চেষ্টাই থাকে। পণ্যের কাঁচামাল নির্ধারণে মূল বিবেচনা হিসেবে থাকে এর পরিবেশবান্ধবতা। যেসব কাঁচামাল পরিবেশের ক্ষতি না করে দূষণ কমাতে সাহায্য করে সেসব ব্যবহার করেই তৈরি হয় বাহ্ এর গৃহসামগ্রী।
"আমাদের সব পণ্যের ম্যাটেরিয়াল পরিবেশবান্ধব রাখার চেষ্টা করি। যেমন- বেশীরভাগ পণ্য পাট দিয়ে তৈরি, যা কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে। ডেনিম দিয়ে তৈরি পণ্য অনেক দিন টেকসই হয়। ডেনিমের আপসাইকেল করে নানা পণ্য তৈরি করি যেন পরিবেশের আবর্জনা কিছুটা হলেও কমাতে পারি আমরা," বলেন মিরাজুল হক।
দেশীয় বাজারে 'ক্রিয়েটিভ ইকোনমি' তৈরি করা, নারী ক্ষমতায়নে সহযোগী হওয়া, এবং পরিবেশবান্ধব পণ্য তৈরি করা- এই তিনটি মূলনীতি নিয়ে কাজ করছে বাহ্। মিরাজুল বলেন, "দেশ থেকে শুধু কম মূল্যের শ্রম রপ্তানী না করে আমাদের সৃজনশীলতা কাজে লাগিয়ে কীভাবে অর্থনীতিতে অবদান রাখা যায় সে চিন্তা করি আমরা।"
'বাহ্' নামকরণের পেছনের ঘটনা জানান মিরাজুল হক। "আমাদের বাচ্চা ইলহান যখন ঠিকমতো কথাও বলতে পারত না সেসময় একদিন তাকে এই উদ্যোগের জন্য একটা নাম জিজ্ঞেস করি। আধোআধো বুলিতে সে বলে ওঠে 'বাহ্'! সেখান থেকেই এই নামকরণ।"
"ক্রেতারা পণ্য হাতে পেয়েই যেন বলে ওঠেন 'বাহ্' সে প্রত্যাশা রেখেই কাজ করি আমরা," যোগ করেন তিনি।
শুধু ব্যবসা পরিচালনাই নয়, পাশাপাশি নানা সামাজিক প্রভাবমূলক কাজ করছে বাহ্ এর দল। প্র্যাকটিকাল একশনের সহযোগী হয়ে এ বছরই বাহ্ এর উদ্যোক্তারা রংপুর, সৈয়দপুর, নীলফামারি, কুড়িগ্রাম এলাকার ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশনের ১৫ জন উদ্যোক্তাকে পাটজাত পণ্য তৈরি, কোভিড স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। পরবর্তীতে ছয় মাসব্যাপী তাদের দ্বারা আরো সাড়ে তিন হাজার নারীকে কাজের প্রশিক্ষণ দিয়েছে বাহ্। রংপুর ও সৈয়দপুরে ডিজিটাল প্রযুক্তির সাথে তরুণদের অভ্যস্ত করতে গড়ে তুলছে ডিজিটাল হাব।
পণ্যের ডিজাইন করা, কারিগরদের নির্দেশনা দেওয়া, ফেসবুক পেইজ ও ওয়েবসাইটের জন্য কন্টেন্ট লেখা, ছবি তোলা ইত্যাদি নানা কাজ করেন মিরাজুল হক নিজেই। প্রশিক্ষণ প্রজেক্ট পরিচালনা করা, নানা পরিকল্পনা ও ডিজাইন শেয়ার করে সাহায্য করেন তার পরিবারের সদস্যরা। বর্তমানে বাহ্ এর জন্য ৬০-৭০ জন কর্মী কাজ করছেন।
দেড় বছর আগে অল্প পুঁজি নিয়ে শুরু করা এই উদ্যোগে এখন মাসে কয়েক লাখ টাকার পণ্য তৈরি হয়। মহামারিতে শুরু হওয়া এই উদ্যোগে করোনা বাধা হয়ে না দাঁড়িয়ে বরং ঘরবন্দী এই সময়টা সহায়ক হয়েছে বাহ্ এর জন্য।
"লকডাউনে মানুষ ঘর সাজানোর সামগ্রীর উপর নজর দেওয়ার সময় বেশী পেয়েছে। এতে আমাদের পণ্যগুলো আরো বেশী সবার নজরে পড়েছে," বলেন মিরাজুল।
বাহ্ এর নিজস্ব কোনো আউটলেট এখনো নেই, তবে গুলশানের পেবলস স্টোরে তাদের পণ্য পাওয়া যায়।
কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, পরিবহণ খরচ বৃদ্ধি, নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করার জটিলতা, স্বল্প পুঁজির মতো প্রতিবন্ধকতাগুলোকে পাশ কাটিয়ে আরো বড় পরিসরে কাজ করতে চায় তারা। বর্তমানে তাদের পণ্যগুলো শুধু অভিজাত শ্রেণীর ক্রেতাদের চাহিদাতে থাকলেও দেশীয় পরিবেশবান্ধব পণ্যের প্রতি সব শ্রেণির ক্রেতার চাহিদা সৃষ্টিতে কাজ করতে চায় বাহ্।