বাড়ির আঙিনায় ‘মিনি সুন্দরবন’
চট্টগ্রাম নগরের শত বছরের পুরানো এক বাড়ির উঠান জুড়ে সুন্দরী, গড়ান, কেওড়া, গোলপাতা, টাইগার ফার্নসহ বিভিন্ন ম্যানগ্রোভ প্রজাতির গাছগাছালির সমাহার। গাছের ফাঁকে ফাঁকে প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে তোলা মৌচাকগুলোতে মৌমাছিরা মধু সংগ্রহে ব্যস্ত।
ছোট্ট ওই উঠানের এ দৃশ্য দেখে মনে হতে পারে, এটাই সুন্দরবন। খানিক পরেই হয়তো কোনো মৌয়াল আসবেন মধু সংগ্রহে!
চট্টগ্রাম নগরের ঐতিহাসিক জয়পাহাড়ে নিজ বাড়ির আঙিনার ৫০০ বর্গফুট জায়গায় সুন্দরবনের ১০ প্রজাতির গাছ নিয়ে এই 'মিনি ম্যানগ্রোভ বন'টি গড়ে তুলেছেন গবেষক সৈয়দ মোহাম্মদ মাইনুল আনোয়ার। তিন বছরের প্রচেষ্টায় সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলের নোনা পানিতে জন্ম নেওয়া এসব গাছ সংরক্ষণে তিনি তৈরি করেছেন বিশেষ মাটি ও প্রাকৃতিক পরিবেশ। সেখানেই বেড়ে উঠছে সুন্দরী, গড়ান, হারগোজা, কালিলতা ও গোলপাতা গাছ।
নগরীর এক খণ্ড জায়গায় লাভজনক ভবন নির্মাণ না করে তিনি এরকম একটি ম্যানগ্রোভ বন তৈরি করেছেন প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসার কারণে।
আজ (২৬ জুলাই) বিশ্ব ম্যানগ্রোভ দিবস। এই উপলক্ষে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড প্রতিনিধি তার বনটি দেখতে যান।
গবেষক সৈয়দ মোহাম্মদ মাইনুল আনোয়ার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমি মূলত মধু গবেষক। এ কারণে নিয়মিতই আমাকে সুন্দরবন যেতে হয়। কিন্তু সুন্দরবনে যেসব গাছে মৌমাছি বাসা বাঁধে, সেগুলো বাংলাদেশের অন্য এলাকায় হয় না। তাই তিন বছর আগে আমি সুন্দরবন থেকে কিছু উদ্ভিদের চারা ও বীজ এনে আমার উঠানে রোপন করি।'
'এসব গাছ যেহেতু নোনা মাটি ও পানিতে জন্মায়, তাই সমুদ্র উপকূল থেকে লবণাক্ত মাটি ও পানি সংগ্রহ করে গাছগুলোতে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি এবং পরিচর্যা করেছি। আজ তিন বছরের মাথায় প্রায় সবগুলো গাছই টিকে গেছে এবং সুন্দরী গাছটি ১৫ ফুটের মতো লম্বা হয়েছে। এ বছরই প্রথম সুন্দরবনে থেকে আনা কালিলতা নামে একটি গাছে ফুল ধরেছে,' যোগ করেন গবেষক মাইনুল আনোয়ার।
মিনি সুন্দরবনে দৃষ্টি কাড়ছে মৌবন
নিজ আঙিনায় গড়ে তোলা ছোট্ট ম্যানগ্রোভ বনকে পূর্ণতা দিতে বাগানের মাঝে ছোট্ট পরিসরে মৌবনও তৈরি করেছেন মাইনুল আনোয়ার। হাতে বানানো ও প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠা ৮টি মৌচাকে পাঁচ ধরনের মৌমাছির লালন-পালন করছেন তিনি।
মাইনুল আনোয়ার বলেন, 'ম্যানগ্রোভ বনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো মৌমাছি ও মৌয়াল। আমার মিনি সুন্দরবনে তাই কয়েক প্রজাতির মৌমাছি চাষ করছি। নিজস্ব পরিবেশের গাছ-গাছড়া পেয়ে মৌমাছিগুলোও বেশ ভালোভাবেই আছে এখানে।'
তিনি জানান, কৃত্রিম এই ম্যানগ্রোভ বনে বিভিন্ন প্রজাতির মৌমাছি রয়েছে। এগুলো নিজেরাই এই ছোট বনে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে।
ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের জাদুঘর
গবেষক সৈয়দ মোহাম্মদ মাইনুল আনোয়ার শুধু উঠানে ম্যানগ্রোভ বন বা 'মিনি সুন্দরবন' করেই ক্ষান্ত হননি, পাশেই তার ছোট্ট গবেষণাগারে হারবেরিয়াম করা হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির ম্যানগ্রোভ গাছের।
গবেষণাগারের দেওয়ালে সারি সারি কাঠের তাকে থরে থরে সাজানো শক্ত সুইডিস বোর্ড পেপার। সেখানে আঠা দিয়ে লাগিয়ে রাখা হয়েছে বিশেষ চাপে শুকানো সম্পূর্ণ উদ্ভিদ কিংবা ফুল-ফলসহ উদ্ভিদের কিছু অংশ। উদ্ভিদ প্রজাতিটির যাবতীয় তথ্যাদিও একটি ছোট্ট কাগজে লিপিবদ্ধ করে আঠা দিয়ে এঁটে দেওয়া হয়েছে একই শিটে। আর এভাবেই সংরক্ষণ করা হয়েছে সুন্দর বনের প্রায় ২০ প্রজাতির উদ্ভিদের নমুনা।
পাশাপাশি, সুন্দরবনে পাওয়া যায় এমন অন্তত ৭০ ধরনের মধু রেখেছেন তিনি এ সংগ্রহশালায়।
গবেষক মাইনুল আনোয়ার বলেন, 'চট্টগ্রাম উপকূলীয় এলাকা হলেও এখানে উপকূল ও ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ নিয়ে কোনো সংগ্রহশালা নেই। আমাদের শিক্ষার্থী ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন এ বিষয়ে জানতে পারে, সে উদ্দেশে আমি সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলের নোনা পানিতে জন্মায়- এমনসব গাছে হারবেরিয়াম করার চেষ্টা করছি।'
তিনি জানান, ইতোমধ্যে তার এই উদ্যোগের কথা জানতে পেরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানি বিভাগ তাদের ক্যাম্পাসে 'ম্যানগ্রোভ বন' তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি প্রফেসর ড. হারুনর রশিদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বেশ কয়েক বছর আগে আমরা কিছু সুন্দরী গাছের চারা আমাদের ক্যাম্পাসে লাগিয়েছিলাম। কিন্তু সেগুলো সেভাবে বিকশিত হয়নি। মাইনুল আনোয়ার যেহেতু তার আঙিনায় এটা পেরেছেন, এর অর্থ হলো তিনি গাছের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে সমর্থ হয়েছেন। আমরা ইতোমধ্যেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তিনি আমাদের ক্যাম্পাসে এমন একটি ম্যানগ্রোভ কর্নার গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন।'