বিমূর্ত ধারার চিত্রকর্মকে যেভাবে অনুপ্রাণিত করেছে আরবি হরফ
কয়েক বছর ধরে আন্তর্জাতিক শিল্প-প্রেক্ষাপটে আরব্যের প্রভাব দিন দিন বাড়ছে। নিলাম ঘর ও অবকাঠামোর জাদুঘরে এগুলোর শৈলী পাচ্ছে বিশেষ সমাদর। কিন্তু এর নিজস্ব বৃহত্তর সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের শিল্প এখনো এইসব নতুন কৌতূহলের যথাযোগ্য অংশীদার হতে পারেনি; অন্তত যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে নয়।
এরইমধ্যে নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির গ্রে আর্ট গ্যালারিতে ১৪ জানুয়ারি থেকে চলছে "টেকিং শেপ: অ্যাবস্ট্রাকশন ফ্রম দ্য আরব ওয়ার্ল্ড, ১৯৫০'স-১৯৮০'স" শিরোনামে এক চিত্রপ্রদর্শনী। চলবে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত। খবর দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের।
ঔপনিবেশিকতা থেকে উত্তরণ ও জাতি গঠনের সেই আলোড়িত দশকগুলোকে ফোকাস করা হয়েছে এই প্রদর্শনীতে জায়গা পাওয়া ছবিগুলোতে। আলজেরিয়া থেকে শুরু করে ইরাক পর্যন্ত বিভিন্ন আরব দেশের আরব, বর্বর, ইহুদি ও অন্যান্য গোত্রের চিত্রশিল্পীদের প্রায় ৯০টি প্রিন্ট ও পেইন্টিং সংগ্রহ করে এখানে হাজির করছেন গ্রে আর্ট গ্যালারির কিউরেটর লিন গামপার্ট এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের বার্জিল আর্ট ফাউন্ডেশনের কিউরেটর সুহেলা তাকেস।
এই চিত্রশিল্পীদের অধিকাংশেরই ছিল ইউরোপিয়ান কিংবা আমেরিকান শিক্ষা। এর পাশাপাশি অপরিচিত স্যান্ডি প্যালেট ও কিছু অপ্রত্যাশিত ডিটেইলও ছবিগুলোতে খুঁজে পাওয়া যায়। এগুলোর ধরনের সঙ্গে অ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিজম ধারার শিল্পকর্মের প্রভাব, ওই ধারার আমেরিকান-জার্মান চিত্রশিল্পী জোসেফ অ্যালবার্সের লুসিড কালারের এক ধরনের মিল পাওয়া গেছে।
তবে এক জায়গায় এগুলোর সঙ্গে ইউরোপিয়ান শিল্পীদের কাজের অমিল রয়েছে। আরব শিল্পীরা ভিজুয়াল আর্টে এক প্রাচীন ঐতিহ্যের বর্ণমালাও জুড়ে দিয়েছেন।
সিরিয়াতে জন্ম নেওয়া, ওয়াশিংটনের করকরান স্কুল অব দ্য আর্টস অ্যান্ড ডিজাইনের সাবেক শিক্ষার্থী মাদিহা ওমরের কথাই ধরা যাক। আরবি হরফগুলোকে ধর্মনিরপেক্ষতার একটি বাহন, নিজের মতো ওয়েস্টার্ন পেইন্টিং করার একটি অবলম্বন হিসেবে ব্যবহার করেছেন এই শিল্পী।
১৯৭৮ সালে জলরঙে আঁকা শিরোনামহীন এক ছবিতে উজ্জ্বল নীল ও লাল রঙের খেলায় তিনি বিমূর্ত ধারার সঙ্গে প্রাচীন মেসোপটেমীয় অর্ধচন্দ্ররেখা ফুটিয়ে তুলেছেন। কাগজের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত এই অর্ধচন্দ্ররেখাগুলো এমন ন্যারেটিভ মোশনে আঁকা হয়েছে, দেখে লেখালেখির কথাও মনে আসবে দর্শকের।
তবে মিসরীয় শিল্পী ওমর আল-নাগদির ছবিতে হরফগুলো, বিশেষ করে 'আলিফ' হরফটির ব্যবহার এমন দারুণ এক ভার্টিক্যাল স্ট্রোকে আঁকা হয়েছে, যেটি একইসঙ্গে ধর্মীয় মহিমাও প্রকাশ করে।
জর্ডিয়ান প্রিন্সেস ওয়াজদান আলির ১৯৭৭ সালে আঁকা এক তৈলচিত্রে ধবধবে সাদা ক্যানভাসে লাল, নীল, কমলা ও কালো রঙের রেখায় ফুটে ওঠা আরেকটি দারুণ চিত্রকর্ম জায়গা পেয়েছে প্রদর্শনীটিতে।
অন্যদিকে, শুধু আরবি হরফ নয়, উত্তর আফ্রিকান তিফিনাগ অক্ষর দিয়েও ক্যানভাস ভরে তুলেছেন মরোক্কান দুই চিত্রশিল্পী আহমেদ সেরকাই ও জিলালি গারবাই। সেরকাইয়ের 'আলিয়া' ও 'লা মিররস রুজেস' ছবি দুটি মোটা কালো কিংবা রক্তিভ রেখায় এমন একটি জটিল ক্রিসক্রস প্যাটার্নকে বিভক্ত করে দিয়েছে, যে রেখাটিকে দেখতে অনেকটাই বর্বর জাতির পতাকার ওপর থাকা তিফিনাগ অক্ষর 'ইয়াজ'-এর মতো দেখায়।
আবার, ১৯৬৯ সালে আঁকা 'কম্পোজিশন' ছবিটিতে গারবাই গাঢ় কালো ফাঁস ও বাঁককে আলাদা করতে গিয়ে, ডিমের মতো দেখতে হলুদ ও সাদার একটি অমিশ্রিত রঙের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন। সব মিলিয়ে এখানে এমন এক দ্ব্যর্থকতা তৈরি হয়েছে, দ্বিধা জাগে- এটি কোনো হরফ নাকি ড্রয়িং? এটি কি আলঙ্কারিক নাকি বিমূর্ত ধারার ছবি? লাল রঙের এই বিস্ফোরণ আনন্দ বোঝাচ্ছে, নাকি বেদনা? তবে কোনো না কোনোভাবে ছবিকে পাথরের মতোই নিরেট করে তুলতে পেরেছেন গারবাই।