বিশ্বের কাছে ভ্যাকসিন নিয়ে অভূতপূর্ব অভিনন্দন আশা করেছিল রাশিয়া
রাষ্ট্রীয়ভাবে তুমুল আয়োজনের মধ্য দিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির ভি. পুতিন এবং তার প্রশাসনের অন্য কর্মকর্তারা স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ভ্যাকসিনের অনুমোদন ঘোষণা করেছিলেন। একইসঙ্গে, পৃথিবীর প্রথম অনুমোদিত ভ্যাকসিন- স্পুতনিক-ভি'র একশ' কোটি ডোজ উৎপাদনের ঘোষণাও দেন তারা। নতুন করোনাভাইরাস সৃষ্ট চভয়াবহ মহামারির অবসান করতে এসব পদক্ষেপ ঘোষণা করে দেশটির সরকার।
এর মধ্যে দিয়ে বিশ্বের কাছে নিজের যোগ্য মর্যাদা ও ক্রমবর্ধমান গুরুত্বের স্বীকৃতি আশা করেছিল দেশটি। কিন্তু, কার্যত দেখা যাচ্ছে; বিশ্বকে রক্ষা করার প্রচেষ্টা হিসেবে রুশ ভ্যাকসিন আগমন নিয়ে উচ্ছসিত হওয়ার বিপরীতে, বরং তা নিয়ে সংশয়বাদীদের দলই ভারি হচ্ছে। একের পর এক দেশের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ এবং বিজ্ঞানী মহলের উদ্বেগের প্রেক্ষিতে; রুশ কর্তৃপক্ষ এখন বাধ্য হচ্ছেন প্রতিষেধকটির সুরক্ষা নিয়ে আত্মরক্ষামূলক বক্তব্য দিতে।
বাগযুদ্ধের পূর্বাপর:
সম্প্রতি রাজধানী মস্কোতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে রুশ স্বাস্থ্যমন্ত্রী মিখাইল মুরাশকো বলেন, ''রাশিয়ার (ভ্যাকসিন) পণ্য কিছু কিছু যোগ্যতার বিচারে অনেক বেশি প্রতিযোগী হওয়ার বিষয়টি অনুধাবন করেই আমাদের বিদেশি কিছু কলিগ এটার ব্যাপারে ভিত্তিহীন মতামত প্রকাশ করেছেন।''
রুশ মন্ত্রী যেসব মতামতের প্রতিক্রিয়ায় একথা বলেন, তার অধিকাংশেই স্পুতনিক-ভি সর্বশেষ স্তরে অধিক সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবীর দেহে প্রয়োগ না করেই অনুমোদন দেওয়ার সমালোচনা করা হয়। তৃতীয় স্তরের পরীক্ষা না চালানোয় এর পূর্ণ সক্ষমতা আর সম্ভাব্য নেতিবাচক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়েই উদ্বেগ প্রকাশ করেন, নানা দেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা।
তারা বলেছেন, প্রার্থী ভ্যাকসিনের সর্বশেষ এ পরীক্ষার মাধ্যমেই তার প্রকৃত উন্নয়ন করা সম্ভব হয়। রাশিয়া তা না করেই অনুমোদন দেওয়ায় স্পুতনিক-ভি বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যের জন্য আশীর্বাদ নয়, বরং হুমকিরূপে দেখা দেবে। তাছাড়া, রাশিয়া ভ্যাকসিন আনার চাইতে পশ্চিমা দুনিয়ার সঙ্গে বৈজ্ঞানিক যোগ্যতা প্রচারণার লড়াইয়েই জয়ী হওয়ার লক্ষ্য নিয়েছিল- বলে অভিযোগ করেন তারা।
''মানুষকে ক্ষতির মুখে ফেলা বা তাদের এমন কিছু দেওয়া যা ফলদায়ক নয়; এমন প্রতিষেধক সবার আগে বাজারে আনার ইচ্ছে থাকলে; অনেক আগেই আমরা তা করতে পারতাম। এমনকি আগামী সপ্তাহেই এমন একটি ভ্যাকসিন আমরা অনুমোদন দেওয়ার ক্ষমতা রাখি। কিন্তু, সেটা কি সঠিক পদক্ষেপ হবে?" রুশ ভ্যাকসিন প্রসঙ্গে প্রশ্ন রাখেন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডক্টর অ্যান্থনি ফসি।
এর পাল্টা জবাব দেন, স্পুতনিক-ভি ভ্যাকসিন গবেষণায় অর্থায়নকারী রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ তহবিলের মুখ্য নির্বাহী কিরিল দিমিত্রিয়েভ।
তিনি বলেন, ''পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ, সবচেয়ে বেশি পরীক্ষিত এবং ফলদায়ক ভ্যাকসিন আমরা তৈরি করতে পেরেছি- এব্যাপারে আমরা শতভাগ নিশ্চিত। আমাদের প্রতিযোগীরা বিষয়টি অনুধাবন করেই ভ্যাকসিন বাজারে রাশিয়ার আধিপত্য নিয়ে ভয় পাচ্ছে।''
রুশ কর্মকর্তাদের ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগীতার ইঙ্গিত বাস্তবতা বিবর্জিত নয়। বিশ্বের প্রধান প্রধান সব পরাশক্তিই এখন লিপ্ত ভ্যাকসিন উৎপাদনের প্রচেষ্টায়। যাতে সাফল্য আসলে এবং তা নিজেদের দেশ ও বিশ্ববাজারে সাধারণ মানুষের মাঝে আস্থা অর্জন করলে- নিঃসন্দেহে তাদের ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি বহুগুণে বাড়বে। সঙ্গে বাড়তি সম্মান আর অর্থনৈতিক সুবিধা তো আছেই।
এ লক্ষ্য অর্জনেই 'অপারেশন ওয়ার্প স্পিড' শীর্ষক এক কর্মসূচির আওতায় নানা কোম্পানির প্রার্থী ভ্যাকসিনের গবেষণায় শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। পিছিয়ে নেই জার্মানি, যুক্তরাজ্য বা চীনের মতো দেশ।
উদ্বেগের গ্রহণযোগ্যতা যেখানে:
রাশিয়ার ভ্যাকসিন প্রসঙ্গ দিলে- বর্তমানে অনুমোদন পাওয়ার আগে তৃতীয় স্তরে পরীক্ষা চলছে আরো ৮টি প্রার্থী ভ্যাকসিনের। সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা জেগেছে; মার্কিন ফার্মা- মডের্না ইঙ্কের একটি, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা ফার্মার যৌথ গবেষণাধীন একটি এবং চীনের কিছু প্রার্থী ভ্যাকসিন পরীক্ষা ঘিরে।
অনুমোদনের আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত নিয়ম অনুসারে একটি প্রার্থী ভ্যাকসিনকে তিন স্তরের সুরক্ষা এবং কার্যকারিতা প্রমাণের সম্মুখীন হতে হয়। প্রথম দুই স্তরে স্বল্প সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবীর দেহে তা প্রয়োগ করা হয়। ভ্যাকসিনের ফর্মূলা মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে উদ্দীপ্ত করছে নাকি তা ক্ষতির কারণ- তা জানা যায় এদুটি পরীক্ষা থেকে।
কিন্তু, শেষ স্তরটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ পর্যায়ে এসে দশ সহস্রাধিক মানুষের দেহে প্রার্থী ভ্যাকসিনের প্রয়োগ করা হয়। ক্ষতিকর কোনো দিক থাকলে- সেটা এই স্তরে এসেই প্রমাণিত হয়। গবেষণায় জড়িত বিজ্ঞানীরা বলছেন, একটি ত্রুটিপূর্ণ ভ্যাকসিন নেওয়ার ফলে জীবাণুর সংক্রমণ প্রতিরোধের বদলে উল্টো দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরো দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। ফলে গ্রহণকারী আক্রান্ত হতে পারেন আরো মারাত্মক কোভিড-১৯ জনিত অসুস্থতায়।
অথচ রাশিয়া চলতি মাসেই তাদের শেষ স্তরের পরীক্ষা শুরু করার পরই তড়িঘড়ি করে ভ্যাকসিন অনুমোদন দেয়। আর এ যুক্তিতেই প্রক্রিয়াটি সঙ্গতকারণেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বিশেষ করে, দেশটি তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পূর্বাপর স্তর নিয়েই যথাযথ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করেনি। তাই সন্দেহের বীজ মহীরুহে রূপ নেওয়াটাও অমূলক নয়।
রাশিয়ার ভ্যাকসিনে বিনিয়োগকারী সংস্থার প্রধান- দিমিত্রিয়েভ বলেছেন যে, ইবোলার ভ্যাকসিন তৈরিতে যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছিল- তা দিয়ে কোভিড ভ্যাকসিন তৈরি করার কারণেই রুশ বিজ্ঞানীরা এর ফলদায়ক প্রভাব নিয়ে দারুণ আত্মবিশ্বাসী।
তিনি এও জানান, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসেই দেশটির বিজ্ঞানীরা করোনাগোত্রের আরেক ভাইরাস মার্সের বিরুদ্ধে একটি ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালাচ্ছিলেন। একারণেই নতুন করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন সবার আগে তৈরি করা সম্ভব হয়েছে।
তবে পূর্বের ভ্যাকসিন গবেষণার তথ্যগুলো এতদিন বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের অজানা ছিল। রাশিয়া কেন জনকল্যাণমূলক প্রতিষেধক গবেষণার তথ্য গোপন করেছিল- সেটাও পরিষ্কার জানে না কেউ। ধোঁয়াশা তাই কিরিল দিমিত্রিয়েভের ব্যাখ্যা নিয়েও কম নয়। তাছাড়া, কোনো রকমে পরীক্ষিত ভ্যাকসিনের চালান রপ্তানিতে রাশিয়ার সাম্প্রতিক পদক্ষেপও তাদের উদ্বিগ্ন করে।
রাশিয়ার তুলনায় বৈজ্ঞানিক সক্ষমতা বহুগুণে কম এমন ২০টি দেশের সঙ্গে ভ্যাকসিনটি যৌথ উৎপাদনের আলোচনা চলছে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে; ব্রাজিল, কিউবা এবং ফিলিপাইনের মতো কিছু দেশ। এসব দেশের অনেকেই জানিয়েছে, তারা এর সুরক্ষা পরীক্ষায় নিজ দেশে তৃতীয় স্তরের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ চালাবে রাশিয়ার সহযোগীতায়। কিন্তু, বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিতে পিছিয়ে থাকায় তারা প্রকৃত ঝুঁকি কতটুকু নিরূপণ করতে সক্ষম হবে- তা নিয়ে আশঙ্কা থেকেই যায়।
পৃথিবীর শীর্ষ জনস্বাস্থ্য সংস্থাগুলোর শঙ্কার এটাও অন্যতম এক কারণ।
স্পুতনিক-ভি নিতে আগ্রহী নন রাশিয়ার সিংহভাগ চিকিৎসক:
রাশিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, সবার আগে দেশটির স্বাস্থ্য সেবা কর্মী এবং শিক্ষকদের মধ্যে প্রতিষেধকটি প্রয়োগ করা হবে। সবাইকে আশ্বস্ত করতে, রুশ প্রেসিডেন্ট জানান, তার এক কন্যাকেও নাকি এর এক ডোজ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, তাতে অস্বস্তি কাটেনি অনেকেরই। সন্দিহানদের তালিকায় প্রথমেই আছেন রুশ চিকিৎসকরা। অধিকাংশই স্বেচ্ছায় ভ্যাকসিনের ডোজ নেওয়ার ব্যাপারে অসম্মতি প্রকাশ করেছেন।
এমনকি ভ্যাকসিন অনুমোদনের প্রক্রিয়া যখন চলমান ছিল- ঠিক তখনই আকস্মিকভাবে পদত্যাগ করেন রাশিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মূল্যবোধ সম্পর্কিত কমিটির চেয়ারম্যান ডা. অ্যালেক্সান্ডার চুচালিন। ধারণা করা হচ্ছে, দ্রুত অনুমোদন প্রক্রিয়ায় তার সম্মতি না থাকার কারণেই তাকে চাপের মুখে পদত্যাগ করতে হয়েছে। এব্যাপারে জানতে তার সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করে মার্কিন দৈনিক- দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস। তিনি অবশ্য এব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।
শুধু তাই নয়, সাম্প্রতিক এক অনলাইন জরিপে অংশ নেওয়া রাশিয়ার চিকিৎসকদের মধ্যে মাত্র ২৪ শতাংশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত ভ্যাকসিনটি নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
এর বাইরে চিকিৎসক এবং শিক্ষকদের চারটি পেশাজীবী জোট- তাদের সদস্যদের যেন ভ্যাকসিনটি নিতে বাধ্য না করা হয়- সে অনুরোধ করেছে সরকারের কাছে।
রাশিয়ার বিরোধী দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত একটি চিকিৎসক জোট- ডক্টরস এলায়েন্সের পরিচালক আনাসতাশিয়া ভাসিলিয়েভ বলে, দেশের সম্মান বাড়ানো আর অর্থনীতিকে পুনরায় সচল করার 'রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত' হিসেবে ভ্যাকসিনটি পূর্ণতা পাওয়ার আগেই অনুমোদন দিয়েছে ক্রেমলিন।
তিনি বলেন, '' চিকিৎসকরা নির্বোধ নন। একটি অপরীক্ষিত ওষুধের কতটুকু ঝুঁকি তারা সেটা ভালো করেই জানেন।
- সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস