ভবিষ্যতে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদিত হবে পরীক্ষাগারে!
দুধ বা দুগ্ধজাত পণ্য তারা খেতে চান না,তাদের জন্য একটানা কয়েক দশক বিকল্প হিসেবে ছিল কেবল সয়া মিল্ক। পাশ্চাত্যে 'ভেগানিজম' ক্রমশ মূলধারায় যুক্ত হতে থাকায় আলমন্ড মিল্ক, কোকোনাট মিল্ক কিংবা ওট মিল্কের মতো বিকল্প পণ্য সুলভ হয়ে উঠছে আজকাল। ভেগানরাও নিজেদের পছন্দমত খাদ্যপণ্য বেছে নেবার সুযোগ পাচ্ছেন।
সুইডেনের একদল গবেষক আবার 'পটেটো মিল্ক' ও নিয়ে এসেছিলেন। স্থায়িত্বের জন্য প্রশংসিত হলেও আলুতে বিদ্যমান কার্বোহাইড্রেটের জন্য এই দুধ ততটা জনপ্রিয় হতে পারে নি।
বিজ্ঞানীদের মতে, সব দিক বিবেচনায় এখন 'হোলি গ্রেইল' হতে পারে ল্যাবে উৎপাদিত দুধ।
সিলিকন ভ্যালি থেকে শুরু করে সিঙ্গাপুরের বিপুল সংখ্যক স্টার্ট-আপ কোম্পানি এই কৃত্রিম গরুর দুধ তৈরীর প্রতিযোগিতায় সামিল হয়ে গেছে।
কৃত্রিমভাবে দই (ক্যাসিন) এবং হোয়ে প্রোটিন উৎপন্নের মাধ্যমে মূলত এই দুধ তৈরী করা হবে। বিপুল পরিমাণে এর বাজারজাতকরণ সম্ভব হবে বলে ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো দিন গুনতে শুরু করেছে।
পরীক্ষাগারের এই দুধের তাপমাত্রা থাকবে বিশেষ নিয়ন্ত্রণে; এতে ভেগান চীজের নিখুঁত বয়নপ্রণালী বজায় রাখা হবে।
এই খাতে বড় সম্ভাবনা দেখছেন ব্যবসায়ীরা। প্রক্রিয়াজাত বা প্যাকেজড ফুডগুলোর মধ্যে বিকল্প দুগ্ধজাত পণ্যের বাজার দ্রুত বর্ধনশীল হয়ে উঠেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ইউরোপের পশ্চিমাংশেই এর প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ২.৫ বিলিয়ন ইউরো। যুক্তরাজ্যে গত ৫ বছরে বিকল্প দুগ্ধজাত পণ্যের বাজার বৃদ্ধি পেয়েছে ৬৯ শতাংশ; শুধু নন-সয়াবেসড মিল্কের বাজার প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১২৯ শতাংশে।
তবে পরীক্ষাগারে অবিকল গরুর দুধের অনুকরণে ক্যাসিন প্রোটিন তৈরী করাকে 'জৈব প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ' হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন সুইডেনের মালমো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মেরিট কার্ডেনাস। তার মতে, এই পুরো প্রক্রিয়ার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতাও এটি।
এক্ষেত্রে সাধারণত অণুজীবগুলোকে একটি জেনেটিক কোড প্রদান করা হয় যা গাঁজন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রকৃত দুগ্ধ প্রোটিন তৈরি করতে সক্ষম করে- কিন্তু বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বৃহৎ পরিসরে এই প্রক্রিয়া পরিচালনা অত্যন্ত কঠিন।
সিলিকন ভ্যালি ভিত্তিক স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান 'পারফেক্ট ডে' একমাত্র কোম্পানি যারা ফারমেন্টেশন-ভিত্তিক প্রোটিন পণ্য বাজারে এনেছে; এটি গরুর দুধ থেকে প্রথম হোয়ে প্রোটিন তৈরি করে এবং এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৫ হাজার দোকানে তাদের উৎপন্ন দুগ্ধপণ্যের বিকিকিনি চলে।
'পারফেক্ট ডে'র প্রধান নির্বাহী এবং সহ-প্রতিষ্ঠাতা রায়ান পান্ডিয়া বলেন, "দুধের কোন উপাদানের জন্য এটি অনন্য সেটি আমাদের খুঁজে বের করা দরকার ছিল। সে আকাঙ্ক্ষা থেকেই আমাদের এই প্রতিষ্ঠানের জন্ম"।
তিনি এবং তার সহকর্মীরা বুঝতে পারেন যে, দুধের প্রোটিন, হোয়ে আর ক্যাসিনই রয়েছে রহস্যের মূলে।
"এই জটিল অণুগুলোর যে কাঠামো রয়েছে তা দুধের অনন্য স্বাদ এবং টেক্সচার সরবরাহ করার জন্য একদম পারফেক্ট। ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিম উপায়ে উৎপাদিত দুগ্ধপণ্যে প্রকৃত দুধের স্বাদ অক্ষুণ্ণ রাখতে চাইলে এসব উপাদানের দ্রাব্যতা, ঘনীভূত হবার ক্ষমতা, পানি সংবহনশীলতা, ফোমিং, তাপ স্থিতিশীলতা এবং অম্লতা প্রভৃতির সঠিক প্রয়োগ কৌশল ব্যবহার করতে হবে", জানান রায়ান।
সমস্যা হলো, এত সমস্ত প্রক্রিয়া আর নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে যে পণ্য কনজিউমারদের হাতে তুলে দেয়া হবে তার দামও বেড়ে যাবে পাল্লা দিয়ে। 'পারফেক্ট ডে' ব্র্যান্ডের কথাই ধরুন, তাদের মাত্র ৫৫০ মিলির আইসক্রিমের দাম ৮ ইউরো!
'নিউ কালচার' নামক আরেকটি স্টার্টআপ, বর্তমানে গাঁজানো বা ফার্মেন্টেড প্রোটিন-ভিত্তিক দুধ ব্যবহার করে পিজ্জার জন্য উপযোগী মোজারেলা চীজ তৈরী করছে। এর চীফ এক্সিকিউটিভ ইনজা র্যাডম্যান বলেন, তাদের কোম্পানিটি গত দুই বছরে প্রযুক্তিগত দিক থেকে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে, তবে ধীর ট্রায়াল প্রক্রিয়ার কারণে বাণিজ্যিক উৎপাদন স্তরে এটি একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে।
ইনজা বলেন, "৩০ বছরেরও বেশি সময়ব্যাপী মানুষ নির্ভুলভাবে ফার্মেন্টেশন প্রক্রিয়া পরিচালনা করা সত্ত্বেও, এটি সবসময় এমন সব প্রোটিন তৈরীতেই ব্যবহৃত হয়ে এসেছে যা চূড়ান্ত প্রয়োগে স্বল্প মাত্রায় ব্যবহৃত হয়"।
"শুধুমাত্র গত পাঁচ থেকে দশ বছরে এই প্রযুক্তিকে খাদ্য প্রোটিন উৎপাদনে আরও প্রসারিত করার জন্য কাজ শুরু হয়েছে"।
ভবিষ্যতে প্রযুক্তির বিকাশ এবং শিল্প খামারের ওপর থেকে সরকারের বিভিন্ন ভর্তুকি হ্রাস পেলে এসব পণ্য সাশ্রয়ী হয়ে উঠবে বলে তিনি মনে করেন।
এদিকে ইউরোমনিটরের মারিয়া মাসকারাক মনে করেন, নেসলে এবং ড্যানোনের মতো বড় ভোক্তা সংস্থাগুলো অন্তর্ভুক্ত হয়ে এলে এই প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে, পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকেও এই শিল্পে বিনিয়োগ করতে হবে।
- সূত্র- দ্য গার্ডিয়ান