ভাগ্য গণকের সৌভাগ্য
জানুয়ারির এক সকালে মোহাম্মদ শাহজালাল গুলিস্তানে এসেছেন জ্যোতিষের সন্ধানে। ৩০ বছর বয়সী মানুষটি ঢাকায় নতুন। উদ্দেশ্য- কর্মসংস্থান খুঁজে পাওয়া। ভবিষ্যতে কপালে কী আছে তা জানতে উৎসুক শাহজালাল।
এদিকে টিয়া পাখি নিয়ে বসে আছেন এক গণক। মাত্র ১০ টাকা দিলেই জানা যাবে ভাগ্য। কৌতুহলী শাহজালাল সেদিকেই পা বাড়ালেন।
গণক মনসুর আলী তার খাঁচা থেকে পাখিটিকে বের করে সাজানো খামের সামনে ধরলেন। দায়সারাভাবে ঠোঁট দিয়ে একটি খাম বেছে নিলো টিয়া। এবার খামের ভেতরে থাকা কাগজটি বের করে পড়ে শোনালেন মনসুর। তবে তিনি যা পড়লেন, সেটা ধর্মগ্রন্থের বাণী। বিশেষায়িত কোনো বক্তব্য তাতে নেই। এ ধরনের উক্তি সাধারণত সবার ক্ষেত্রেই খাটে।
চিঠির কথায় কিন্তু শাহজালালের মন ভরল না। এবার তিনি হাতের রেখা থেকে ভাগ্য জানতে চান। ৫৮ বছর বয়সী মনসুর আলী জানালেন, হাতের রেখা থেকে ভাগ্য জানতে হলে দিতে হবে আরও ৫০ টাকা। শাহজালাল অবশ্য তাতেও রাজি।
এবার হস্তরেখা থেকে ভাগ্য জানার পালা। 'জীবনে অনেক সংগ্রাম করেছেন। অনেক কিছু করার পরিকল্পনা করেন, কিন্তু অধিকাংশই আর বাস্তবায়ন করতে পারেন না। কেউ আপনাকে সাহায্য করে না; সবাইকে ভালোবাসলেও বিনিময়ে ভালোবাসা পান না। এখন আপনি এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন,' এক টানে বলে গেলেন মনসুর আলী।
অবশ্য সমাধানের উপায়ও বাতলে দিলেন। 'এই দুরাবস্থা থেকে মুক্তি চাইলে নিতে হবে রত্নপাথর,' বললেন মনসুর আলী।
গণকের ভাগ্যে নেই সৌভাগ্য
মনসুরের মতো গণকদের সংখ্যা ঢাকায় শ'খানেকের কম হবে না। একে তো সিউডোসায়েন্স, তার ওপর লোকে ভাগ্য গণনা নিয়ে হাসি-ঠাট্টাও কম করে না। তারপরও হস্তরেখা বিশারদ, জ্যোতিষী, চেহারা গণক, টিয়া পাখি দিয়ে ভাগ্য গণনাকারি- এই মানুষদের গ্রাহকসংখ্যা নিতান্ত কম নয়। মনসুরের মতো অনেকে হয়তো ফুটপাতে বসেন। তবে এই গণকদের অনেকেই এত বিখ্যাত, তারা রীতিমতো চেম্বার খুলে জ্যোতিষ চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন। ভাগ্য জানতে চাইলে নগরীর বহুতল শপিং কমপ্লেক্সের ওপর তালায় এসব জ্যোতিষীর চেম্বারে গিয়ে ধর্ণা দিতে হবে। খ্যাতমান এই জ্যোতিষীদের গ্রাহক তালিকায় আছে সাধারণ রিকশাচালক থেকে শুরু করে নামিদামি ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদের নাম।
মনসুর প্রতি সকালে নারায়ণগঞ্জ থেকে বাসে করে ঢাকায় আসেন। বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মতিউর রহমান পার্কের পাশে ফুটপাতে ঝোলা খুলে বসেন। জায়গাটি গুলিস্তান পার্ক নামেই পরিচিত।
তিনি এক সারিতে ৩০টি খাম সাজান। বিভিন্ন খামে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের উক্তি, ভবিষ্যদ্বাণী ইত্যাদি লেখা আছে। টিয়া পাখিকে কোনো একটি বেছে নিতে বললে পাখিটি তা বেছে নেয়।
মনসুর প্রায় ৩০ বছর ধরে এই পেশায় আছেন। তিনি বলেন, 'অধিকাংশ মানুষ ভাগ্য গণনা করায়, কারণ এর মূল্য মাত্র ১০ টাকা।" তিনি ভবিষ্যৎবাণী করে দৈনিক ৫০০ টাকার মতো আয় করেন।
মনসুরের জন্ম এক দরিদ্র পরিবারে। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। পরবর্তীকালে তিনি এক অটোমোবাইল ব্যাটারি চার্জের দোকানে চাকরি নেন। এরপর কয়েকবার পেশা পরিবর্তন করেন।
আশির দশকে একদিন তার দূর সম্পর্কের এক গণক চাচা তাদের বাড়িতে খাম ও টিয়া পাখি রেখে যান। এরপর তিনি সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় সেইসব খাম আর পাখি নিয়ে বসেন।
'আমি জানতাম না কীভাবে হাতের রেখা পড়তে হয়। টিয়া পাখি খাম বেছে তুলত আর আমি সেগুলো পড়তাম,' বলেন মনসুর। তিনি আরও জানান, তখন ভাগ্য পড়তে মাত্র ৫০ পয়সা থেকে ১ টাকা করে নিতেন। 'কিছুদিন পর আমি জ্যোতিষ শাস্ত্র আর হস্তরেখার ওপর একটি বই কিনে হাত দেখা শিখি।'
'টিয়া পাখি নির্বিচারে খাম বেছে নেয়। আমরা শুধু মানুষকে আকৃষ্ট করতে টিয়া পাখি নিয়ে বসি। পাখিকে সেভাবেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এর চেয়ে বেশি কিছু সে জানে না,' স্বীকার করেন মনসুর। তিনি আরও জানান, দুই বছর আগে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে পাখিটি কিনেছেন।
মনসুর বলেন, 'মানুষ টিয়া পাখির কাছ থেকে নিজেদের ভাগ্য জেনে আনন্দ পায়। এখান থেকে তারা ধনি-গরিব কিছুই হবে না।'
টিয়া পাখিটিকে আপেল, কলা আর চাল খাওয়াতে মনসুরের প্রতিদিন বিশ টাকা করে খরচ হয়। তার আগের টিয়া পাখিটি মারা যাবার পর তিনি প্রায় দু'মাস বেকার ছিলেন। এরপর অনেক অনুসন্ধানের পর এই পাখি খুঁজে পান।
'তরুণরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে জিজ্ঞেস করে, তারা তাদের পছন্দের মানুষকে বিয়ে করতে পারবে কি না; আবার অনেক সময় তাদের মনের মানুষের নামও জিজ্ঞেস করে। আমি সেটা কীভাবে বলব? আমাকে তখন অনুমান করে কিছু বলতে হয়,' বলেন মনসুর।
ওপরতলার ভাগ্যবান জ্যোতিষী
লিটন দেওয়ান চিশতী ঢাকার এক খ্যাতমান জ্যোতিষী। বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সের ওপরতলায় 'শেষ দর্শন আজমেরী জেমস হাউজ' নামে তার দুই কক্ষের চেম্বার। লিটনের অধিকাংশ গ্রাহকই উচ্চবিত্ত। পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে তার বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়। বিজ্ঞাপনের দাবি অনুসারে, তিনি মানুষের চেহারা দেখেই তাদের অতীত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান বলে দিতে পারেন।
'আমার বাবা ছিলেন পীর। আমি পূর্বপুরুষদের সুবাদেই ভাগ্য গণনা করতে পারি। আমি যেটা করেছি তা হলো, বিষয়টিকে ডিজিটাল পরিসরে নিয়ে এসেছি,' চেম্বারে বসেই বলেন লিটন।
লিটনের মতে, ঢাকা শহরে আরও অন্তত ২৫ জন খ্যাতমান জ্যোতিষী আছেন। তারা প্রায় প্রত্যেকেই বিভিন্ন শপিং মলের ওপরে চেম্বার করেছেন।
মানুষের চেহারা দেখে ভাগ্য বলার সত্যতা সম্পর্কে জানতে চাইলে লিটন বলেন, 'কুকুর যদি গন্ধ শুঁকে চোর কিংবা মাদকদ্রব্য খুঁজে বের করতে পারে, সেখানে আমরা তো মানুষ। আমরা কেন পারব না?'
তিনি আরও জানান, প্রতিদিন তার কাছে অন্তত ১০ জন লোক আসেন ভাগ্য জানতে। প্রত্যেকের কাছ থেকে তিনি ৬০০ টাকা করে ফি রাখেন। অধিকাংশ মানুষ ব্যবসায় লোকসানের পর তার কাছে আসে বলেও জানান তিনি।
'কিছু মানুষ স্রেফ কৌতুহলবশত আমার কাছে আসে। কেউ কেউ বিশ্বাস করে, আবার কেউ করে না,' বলেন তিনি। আরও বলেন, 'সমস্ত সমাধান আল্লাহর হাতে।' এমনকি অফিশিয়াল প্যাডেও এই কথা লিখে রেখেছেন।
বিপদে পড়লে মানুষ যেকোনো কিছু করতে রাজি থাকে। লিটন বলেন, মানুষ যখন নিরুপায় হয়ে তার কাছে আসে, তিনি মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা শুনেন। তাদের প্রতি সহমর্মী আচরণ করেন। এরপর তিনি তাদের সমাধান দেন। সেইসঙ্গে উপযুক্ত রত্ন পাথর ধারণের পরামর্শও দেন।
'আমি সবসময় সৌভাগ্যের জন্য রত্ন পাথরের কথা বলি। তারা ব্যবহার করবে কি না, সেটা তাদের ব্যাপার,' বলেন লিটন। প্রায় ৩৩ বছর ধরে এ পেশায় আছেন বলেও দাবি তার।
তবে রত্ন পাথর সবসময় কাজ করবে না বলেও সতর্ক করে দিলেন তিনি।
'আপনি রত্ন পাথর পরতে পারেন, কিন্তু সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য আগে আপনাকে নিজের আচরণ পরিবর্তন করতে হবে। আপনি যদি নিজের স্বভাব-চরিত্র পরিবর্তন করতে না পারেন, তাহলে কোনো পাথরেই কাজে দিবে না,' বলেন লিটন দেওয়ান।
তিনি আরও বলেন, 'সঠিক রত্ন পাথর ধারণের পাশাপাশি আপনাকে আল্লাহর ওপর ভরসা রাখতে হবে। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে হবে। সেইসঙ্গে অবশ্যই সৎ পথে চলতে হবে।'
বিজ্ঞানের অগ্রগতি সত্ত্বেও দিন দিন মানুষের ভাগ্য জানার আগ্রহ বাড়ছে বলে জানান তিনি। এ কারণে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পত্র-পত্রিকাগুলো নিয়মিত রাশিফল প্রকাশ করে। 'রাশিফলগুলোতে যে বার্তা থাকে, তা প্রায় সবার ক্ষেত্রেই খাটে। আর যদি সবসময় না-ও খাটে, তবু অন্তত কিছু মানুষের কাছে সেই ভবিষ্যৎ বাণী সত্যি বলেই মনে হবে,' বলেন লিটন।
'আমরা মানুষের সেবা করি। যদি কারও উপকার না-ও করতে পারি, অন্তত ক্ষতি তো করি না,' দাবী এই জ্যোতিষীর।
- মূল লেখা: The good fortune of fortune-tellers
অনুবাদ: তামারা ইয়াসমীন তমা