এখনও টিয়াপাখি যেখানে ভাগ্য বলে দেয়!
চার বছর আগে পাখিটা কিনেছিলেন সলিম মিয়া। তখন এর বয়স ছিল ১ বছর। তারপর একে শিখিয়ে-পড়িয়ে ভাগ্য গণনার কাজে লাগিয়েছেন। 'ইন্টেলিজেন্ট পাখি এই টিয়া। দ্রুতই সব শিখে নেয়। অন্য পাখি দিয়ে কাজটা হয় না।' বলতে বলতে সলিম মিয়া একবার উঠে দাঁড়িয়ে আবার বসলেন। বুঝলাম দীর্ঘসময় বসে থেকে কোমর ধরে গেছে।
তারপর আবার বললেন, 'দ্যাখেন, মানুষ বিপদগ্রস্ত প্রাণী। সমস্যা সব মানুষের আছে, তা সে রাজা হোক আর প্রজা। কারুর টাকা আছে কিন্তু সন্তান নেই, কারুর সন্তান আছে কিন্তু স্ত্রীর সঙ্গে মিল নেই। বনিবনা বলতে নাই। অনেকে আছে ঘুমের মধ্যে হাসে, কারুর আবার পানি আটকে যায় গলায়। এমনও মানুষ আছে যারা বিয়ে করতে পারছে না। খালি প্যাঁচ লাগে! আমাদের কাছে এরা আসে নিদানের জন্য।'
সলিম মিয়ার কথার মাঝেই আমার চোখ বারবার পাখিটার দিকে চলে যাচ্ছে। বেশ ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারী পাখিটি। ঘুরে ঘুরে পেয়ারা আর মটরশুঁটি খাচ্ছে।
পাখি দিয়ে ভাগ্য গোনাতে ১০ টাকা লাগে। সলিম মিয়া পাখিটার নাম রেখেছেন মানিক চান। আমি আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারলাম না, জিজ্ঞেস করে ফেললাম, পাখি কীভাবে মানুষের ভাগ্য গুনতে পারে?
সলিম মিয়া: বনের পশু-পাখির অনেক গুণাগুন আছে। আধ্যাত্মিক গুণ। সাধারণ মানুষ এগুলো টের পায় না।
৪০-৪৫টি সাদা খাম সাজানো সলিম মিয়ার (আসল নাম নয়) সামনে। এগুলো এয়ার মেইলের খাম। প্রতিটির ভিতরে একটি করে টুকরো কাগজ আছে। সে কাগজে ৫-৭টি লাইন লেখা আছে। বাক্যগুলোর ওপরে আউলিয়া বা নানা নবীর নাম লেখা। যেমন, ধরা যাক কোনো কাগজের ওপর ইউনূস নবীর নাম লেখা আছে। এই কাগজটি যার ভাগ্যে ওঠে তার অতিশয় মন্দ কপাল? ইউনূস নবীকে মাছে গিলে নিয়েছিল তাই তিনি আছেন শনির ফেরে। তবে তিনি শেষ পর্যন্ত রক্ষা পাবেন। এরকম কাগজ আছে খাজা মইনুদ্দিন চিশতী, জুনায়েদ বোগদাদী বা বড়পীর সাহেবের নামেও।
বাক্যগুলো সাধু ভাষায় লেখা, সলিম মিয়া সুর করে পড়েন। শুরুর বাক্যে ব্যক্তির চরিত্র সম্পর্কে দু-চার কথা বলা থাকে। তারপর থাকে আদেশ, নির্দেশ আর উপদেশ—মানে কী করতে হবে, কী না করা ভালো এবং কী করা উচিত। তবে আরো বিস্তারিত জানতে চাইলে বই দেখতে হবে। এই বই থেকে মিলবে আরো তথ্য, সমাধান ইত্যাদি। আর এ জন্য বাড়তি গুনতে হবে ৫০ টাকা। বইটির পৃষ্ঠাসংখ্যা ৩০ হয়ে থাকে। এর মধ্যে কয়েকটি পৃষ্ঠায় ছক কাটা থাকে, যেমন সংখ্যা লেখা ছক, নবীদের নাম লেখা ছক, আরবী হরফের ছক ইত্যাদি। কাস্টমারকে সলিম মিয়া ছকের কোনো একটি ঘরে আঙুল রাখতে বলেন, তারপর সে ঘরের বিশদ বর্ণনা করেন পরের পৃষ্ঠার লেখা দেখে।
এ সময় একজন টিয়া পাখির কাছে নিদানে এলেন। আলেয়া খাতুন, আলাপের এক পর্যায়ে নাম জানা গেল। আলেয়া খাতুনকে দেখে মনে হলো সলিম মিয়ার শরণাপন্ন হয়েছেন তিনি আগেও।
তিনি ছয়টি পৃষ্ঠার ছয়টি ছকের ওপর আঙুল রাখলেন। প্রায় সব বর্ণনায় কিছু সাধারণ মিল থাকে যা কোনো নির্দিষ্ট সমস্যাকে উপস্থিত করে, সেসঙ্গে সমস্যা থেকে উত্তরণের পথও নির্দেশ করে। সলিম মিয়া বলেন, জ্যোতিষশাস্ত্রে গ্রহের দোষকে মানুষের বিপদের কারণ মনে করা হয়। বিপদ থেকে উত্তরণের পথ হলো গ্রহের দোষ কাটানো, রত্ন পরিধানের মাধ্যমে এ দোষ কাটানো যায়। জ্যোতিষশাস্ত্রের একটা বড় অংশজুড়েই আছে রত্ন। নীলা, পান্না, পোখরাজ, গোমেদ হলো একেকটি রত্ন। ভূত্বকে, ভূগর্ভে ও সমুদ্রতলে লুকিয়ে থাকা রত্নগুলো তেমন সব পরমাণুর সমন্বয়ে গঠিত যার উপস্থিতি মানব দেহেও প্রবল।
সলিম মিয়া বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রলজার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য। জ্যোতিষশাস্ত্রে ডিপ্লোমা করেছেন। রত্ন কিভাবে মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে, তা নিয়েও সলিম মিয়ার কিছু পড়াশোনা আছে। ডিপ্লোমা করার সময় তিনি জেনেছেন, মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, যেমন পরমাণুর সমন্বয়ে গঠিত সৌরমণ্ডলের গ্রহগুলোও তেমনি পরমাণুর সমষ্টি। মহাজাগতিক রশ্মিগুলি আমাদের শরীরে প্রবেশ করলে স্নায়ুতন্ত্রকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে। একই ক্ষমতার অধিকারী রত্নও। বিভিন্ন রত্ন বিভিন্ন মহাজাগতিক রশ্মিগুলিকে প্রতিফলিত বা বিকিরিত করতে পারে। রশ্মির প্রভাবে মানবদেহে বিদ্যমান পরমাণুগুলোয় যেসব বিশৃংঙ্খলা তৈরি হয়, রত্ন সেগুলোয় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনে। রত্নবিষয়ক বইপত্র, যেগুলো এই জোত্যিষশাসেত্রর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তার সব বইয়েই এ ধরনের ব্যাখ্যা থাকে।
উদাহরণ হিসাবে সলিম অতিবেগুনী রশ্মির কথা বললেন। এটি শরীরে প্রবেশ করলে যেমন নানা রকম রোগের সৃষ্টি হয় আবার এর যথাযথ ব্যবহারে ক্যান্সার নির্মূলও সম্ভব।
সলিম মিয়া আরো জানালেন, সব রত্ন সবার জন্য নয়। যেমন যাদের মাথা গরম তাদের জন্য নীলা নয়, বরং ক্ষতিকর। উৎকৃষ্ট নীলা পাথরের জন্য কাশ্মীর, শ্রীলংকা আর মিয়ানমার খ্যাত। শনির দোষ কাটাতে নীলা ব্যবহৃত হয়। যার যে রাশি তার সে রত্ন দরকার। মানে রাশির সঙ্গে রত্নের যোগ আছে। যেমন তুলা ও বৃষ রাশির জাতকদের জন্য হীরা অনুকূল যদিও এটি শুক্র গ্রহের রত্ন। এটি শুভ ফল আনতে পারে কন্যা, মকর, মিথুন আর কুম্ভের জন্যও। রুবি হলো রবি মানে সূর্যের রত্ন। যদি রাশিতে সূর্যের অবস্থান ভালো না হয়, তবে রুবি পরতে হয়। এছাড়া কর্কট, ধনু, বৃশ্চিক, মেষ আর সিংহ রাশির জাতকদের জন্যও রুবি সৌভাগ্য আনতে পারে।
তবে সলিম মিয়া হুশিয়ারি দিলেন, বিজ্ঞ জ্যোতিষের পরামর্শ ছাড়া রত্ন ধারণ একেবারেই উচিত নয়। সলিম মিয়া জ্যোতিষশাস্ত্রকে বিজ্ঞান মানেন। আর টিয়া পাখি দিয়ে ভাগ্য গণনাকেও বেঠিক মনে করেন না। তাঁর মতে, বিশ্বাস মানুষকে অনেক কিছু পাইয়ে দেয় আর তা অনেক সময় যুক্তি দিয়ে বিচার করা যায় না। লালন সাই একটা গানে বলেছেন, বিশ্বাসে ধন নিকটে পায় আর প্রবাদ তো আছেই, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর।
তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন, স্বামী-স্ত্রীর মিল ঘটানোর বা অবাধ্য সন্তানকে বাধ্য করার ওষুধ আপনি কোনো এমবিবিএস ডাক্তারের কাছে পাবেন? শরীরের দাওয়াই পাবেন ফার্মেসিতে কিন্তু মনের দাওয়াই পেতে আমাদের কাছে আসতে হবে।
আমি বললাম, মানসিক রোগের ডাক্তার তো আছে। তাদের চিকিৎসা ভালো নয় বলবেন?
সলিম মিয়া: তাঁরা রোগীদের বুঝ-পরামর্শ দেন ঠিকই, তবে তাদের নিজেদের ঘরেও অশান্তি হয় আর চিকিৎসা নিতে আমাদের কাছেই আসেন। আমরা গায়েবী এলেম দিয়ে তদবীর করি। এতে দ্যাও-দানো, ভুত-প্রেত মানে অশুভ যা কিছু আছে সবাই বশে আসে। সুলতানুল আউলিয়া শাহ আলী বোগদাদীর দোয়া আছে আমাদের ওপর।
সলিম মিয়া ইলেকট্রিক মালপত্র সাপ্লাইয়ের বিজনেস করেছিলেন কিছুদিন। কিন্তু বেশ কিছু টাকা একবার বাকি পড়ে গিয়েছিল, পরে আর উশুল করতে পারেননি। তাঁর এক দূর সম্পর্কের মামা কবিরাজ ছিলেন। ব্যবসায় ভালো করতে না পেরে মামার দ্বারস্থ হলেন সলিম। মামার সঙ্গে ছয় মাস থেকে কাজ শিখলেন। টিয়া পাখিকে ট্রেনিং দেওয়ার কাজটি আয়ত্ত্বে এনে ফেললেন। পাখিটা ইন্টেলিজেন্ট হওয়ায় ঝামেলা হয়নি বেশি।
সলিম মিয়া বসেন ফুটপাথের শেষ ধারে। খুব অল্প তার আসবাব। একটা তিন থাকের ছোট আলমারি যার মধ্যে টিয়া পাখিটি থাকে আর কাঠের তৈরি অনুচ্চ একটি লম্বা টুল। খামগুলো টুলের ওপরে রাখেন। টুলটি যত বড় তার সমান বড় একটি লাঠি রাখেন সঙ্গে। কাস্টমার এলে লাঠিটি দিয়ে পাখিটাকে তাক থেকে বের করে আনেন। কাস্টমারকে প্রথমেই নাম বলতে বলেন, কারণ নামের আদ্যাক্ষর দিয়ে রাশি বের করা যায়। যেমন অ, ল দিয়ে যাদের নাম শুরু তারা মেষ রাশির জাতক। সলিম মিয়া নিজেও নামটি উচ্চারণ করেন যেন পাখি তা শুনতে পায়। তারপর পাখিকে খামের ওপর ছেড়ে দেন। পাখি হাঁটাচলা করে একটি খাম ঠোট দিয়ে টেনে বের করে আনে।
তবে বেশিক্ষণ পাখিটাকে খামের ওপর থাকতে দেন না সলিম মিয়া। কারণ পাখি বোকার মতো দু তিনটি খামও টেনে বের করে আনে। এটা বেশি হয় যে পাখির ট্রেনিং শেষ হয়নি সে পাখির বেলায়। তাঁর থেকে জানলাম, পাখি সবসময় এক ধ্যানে (খেয়ালে) থাকে না, খাম টানার কাজ দিলাম কিন্তু সে আছে অন্য চিন্তায়, একটার জায়গায় দুই তিনটা খাম টেনে বের করে ফেলে। নামও শোনে না ভালো করে। তখন হুশ ফেরানোর জন্য কি করেন? জানতে চাইলে উত্তর দিলেন, 'খাওয়া-দাওয়া বন্ধ রাখি। তাতেই অনেকটা সোজা হয়ে যায়।'
সলিম মিয়ার একটি সাইড বিজনেস আছে। সেটা হলো কোকা পণ্ডিতের সূত্র বিক্রি করা। কোক শাস্ত্র। একটা স্বচ্ছ কাচের বাক্সের ভিতর বেশ কয়েক রকমের কাগজের বান্ডিল দেখেছিলাম আগেই। কাগজগুলোর নকশা কিম্ভূত এবং কৌতূহলউদ্দীপক। এগুলোর কোনোটা স্বামী-স্ত্রীর মিল-মোহাব্বত জ্বালানি, কোনোটা শত্রু ধ্বংস জ্বালানি। কোনোটা ব্যবসায় উন্নতি।
সলিম মিয়া বললেন, প্রতিটির নির্দিষ্ট মাত্রার ডোজ আছে। একটি শিট ১০ টাকা করে বিক্রি হয়। কোনো ডোজে ৭টি কাগজ, কোনোটিতে ১২টি। তিনি আরো বিস্তারিত বললেন, যে ঘরে স্বামী-স্ত্রীর বিবাদ মৃদু তারা ৭টি শিট ৭ দিনে জ্বালাবেন, আর যাদের ঘরে অশান্তি তীব্র তারা ১২ থেকে ১৫টি জ্বালাবেন। মানে পুড়িয়ে দেবেন।
সমাধান পেতে স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলেই কি আসেন আপনাদের কাছে? জানতে চাইলে একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, বোকার মতো একটা প্রশ্ন করে ফেললেন, স্বামী-স্ত্রীর অমিলের কারণটা আগে ভাবুন তারপর প্রশ্ন করুন। এসব ক্ষেত্রে তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি থাকে বেশি, হয় স্বামী অন্য নারীর প্রতি আসক্তি অথবা নারী অন্য পুরুষের প্রতি। সেক্ষেত্রে দুজনে একসঙ্গে আসলে তো গোলমাল আরো বাড়বে। নাকি?
আবার জানতে চাইলাম, এক্ষেত্রে জানাজানি হয়ে গেলে কি আপনার কোনো অসুবিধা হয়?
সলিম মিয়া: আমার বেশি অসুবিধা নেই, তবে স্ত্রীকে স্বামীর ক্রোধের শিকার হতে হয়। আর ভাই, এই সমস্যাই বেশি।
এসব ক্ষেত্রে সাফল্যের হার কেমন?
সলিম মিয়া: এসবের কাস্টমার বেশি হয় নারীরা। তাদের কাছে টাকা বেশি থাকে না। তাই অনেকেই মাঝপথে কেটে পড়ে। এগুলোতে খরচ অনেক। যেমন ধরেন আট রতির নীচে কোনো রত্ন হয় না। কোনো কোনো পাথরের এক রতির দাম ২০০০ টাকা।
আচ্ছা ব্যাপারটি কি একরকম লোক ঠকানো মনে হয় না আপনার?
সলিম মিয়া: না, লোক ঠকানো হবে কেন? রাহুর দশা কাটবে না — এটাই যদি কারুর নিয়তি হয় তবে তো শত চেষ্টা করেও ফল মিলবে না।
কিন্তু এটা কি আগেই বোঝার উপায় নেই, মানে আপনারা আগেই বলে দিতে পারেন না?
সলিম মিয়া: না, তা আমরা বলতে পারি না।
আচ্ছা, ওই যে কোকা পণ্ডিত বললেন, উনি কে ?
সলিম মিয়া: তিনি ভারতের লোক। তিন-চারশ বছর আগের মানুষ। তান্ত্রিক জ্ঞানী মানুষ।
পরে উইকিপিডিয়া থেকে খবর মিলল, রতিরহস্যের লেখক ওই কোকা পণ্ডিত। অনুমান করা হয়, একাদশ বা দ্বাদশ শতাব্দিতে এটি লেখা হয়েছিল বেণুদত্ত নামক এক রাজাকে খুশি করার জন্য। বইটিতে কোকা বা কোকোকা নিজেকে সিদ্ধ পণ্ডিত হিসাবে বর্ণনা করেছেন। এই বইয়ের আরবি, ফার্সি অনুবাদের নাম লজ্জত উন নিসা। দ্য জয় অব সেক্সের লেখক আলেক্স কমফোর্ট ১৯৬৪ সালে এর একটি ইংরেজী অনুবাদ করেছিলেন যার শিরোনাম দ্য কোকা শাস্ত্র, বিইং দ্য রতিরহস্য অব কোকোকা।
শেষ প্রশ্ন: আপনা নিজের ভাগ্য জানতে পারে না?
জবাব না দিয়ে সলিম টিয়া পাখি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
সালিম মিয়াসহ আরো চারজন টিয়াপাখিওয়ালা মিরপুর ১ নম্বরের শাহ আলী (রহ.)-এর মাজারের কাছে বসেন। একটা সময় ইনকাম তাদের ভালোই ছিল। বিশেষ করে কোভিডপূর্ব আমলে। ব্যবসায় ভাটা লাগার আরেকটা বড় কারণ মাজারে গান-বাজনা বন্ধ হওয়া। এতে মাজারে জমায়েত কমে গেছে উল্লেখযোগ্য হারে। টিয়া পাখিওয়ালারা বসেন কোনো একটি পাথর বিক্রির দোকান বা জেম হাউজের কাছে। সাধারণত টিয়া পাখিওয়ালাদের পরামর্শ শুনেই লোকে রত্ন কিনতে দোকানে যায়।
সলিম মিয়া জানিয়েছেন, রত্নগুলো সবই আসে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা নয়তো রাজস্থানের জয়পুর থেকে। সেসব জায়গায় রত্ন কাটার মেশিন যেমন আছে, দক্ষ মেশিনম্যানও আছে। এ পেশায় ৩০ বছর হতে চলল সলিম মিয়ার। অনেক রকম মানুষ দেখেছেন তিনি, অনেক মানুষের সঙ্গেও মিশেছেন। ভালো মন্দ মিলিয়েই গেল সময়টা।
রাত ৯টা বাজতে চলল। সলিম মিয়া দোকান গোছাবেন। প্রতিদিন ১২-১৪ ঘণ্টা ডিউটি দেন। সপ্তাহে একদিনও ছুটি নেন না। এখন দিনে ৫০০-৬০০ টাকা ইনকাম হয়। তবে খোরাকী বাবদই চলে যায় ২০০ টাকা। পরিবারের অন্য সদস্যরা গ্রামের বাড়ি থাকেন। তিনি দোকান গোছানোর জন্য তাড়াহুড়া করছিলেন। আমি প্রশ্নটি আরেকবার করলাম, মানুষের ভাগ্য বদলের জন্য কাজ করেন, নিজের ভাগ্যের বদল হয় না কেন?
এবার জবাব দিলেন।
সলিম মিয়া: কিভাবে বুঝলেন, আমার ভাগ্যের বদল হয় নাই। আমি তো বলব আমি বেশ সুখে আছি। দশতলা বাড়ি, ৫টা গাড়ি হলেই কি মানুষ সুখী হয়? দ্যাখেন যদি সুখ না থাকে তবে গাড়ি-বাড়ি দিয়ে কোনো ফায়দা নেই। সে অর্থে গাড়ি-বাড়িওয়ালার চেয়ে আমি সুখী মানে আমার উন্নতি বেশি।
পাখি দিয়ে ভাগ্য গণনার বিষয়টি নতুন নয়। উপমহাদেশ ও ইরানে এ পেশা বহুকালের। ইরানে তো হাফিজের কবিতার মাধ্যমে ভাগ্য গণনা করা হয় আজও। এ প্রথা পরিচিত ফাল-ই হাফিজ নামে। ইরানসহ আফগানিস্তানের মতো ফারসিভাষী অন্যান্য অঞ্চলেও বহু শতাব্দী এভাবে টিয়া পাখির মাধ্যমে হাফিজের কবিতা দিয়ে ভাগ্য গণনার প্রথা রয়েছে।
এছাড়া পৃথিবীজুড়েই পাখির ব্যবহার করে ভবিষ্যদ্বাণীর ইতিহাস বহুপ্রাচীন। যেমন ওয়েলসে বসন্তে আগে আগে কোকিল ডাকলে ধরে নেওয়া হতো এবার ফসল ভালো হবে। দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজে আয়মারাভাষীদের বিশ্বাস, হলুদমাথা শকুন দেখা সৌভাগ্যের লক্ষণ। আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে, কালাহারিতে কালো শকুন দেখাকে দুর্ভাগ্যের লক্ষণ মনে করা হয়।
আর টিয়া দিয়ে ভাগ্য গণনা ভারতীয় উপমহাদেশে বহু প্রাচীন পেশা। মূলত দক্ষিণ ভারতে (তামিলনাড়ু, অন্ধ্র প্রদেশ) ভাগ্য গণনার এই প্রথা বেশি জনপ্রিয় ছিল। বাংলাদেশেও একসময় কমবেশি এ ধরনের ভাগ্য গণনার প্রচল দেখা যেত। কিন্তু মানুষ আগের চেয়ে সচেতন হয়ে ওঠায় ধীরে ধীরে এই পেশা এখন বিলুপ্তির পথে।