মানব হাড়ের পাঠাগার
পাঠাগারের প্রবেশমুখেই একটি কঙ্কাল। ভেতরে যেতেই চোখে পড়বে টেবিলের উপর পাশাপাশি সাজানো মানুষের মাথা, পাঁজর, মেরুদণ্ড, হাত, পাসহ নানা অঙ্গের হাড়। প্রতিটির হাড়ের সঙ্গে রয়েছে বৈজ্ঞানিক নাম, শারীরিক অবস্থানের তথ্য। এরকম ৩৬টি মানবের হাড় রয়েছে পাঠাগারটিতে। রয়েছে এনাটমির ওপর দেড়শ’ বই। ফিমার, প্যাটেলা, টিবিয়া, ফিবুলা, কার্পাস, স্ক্যাফয়েড, লুনেট, ক্ল্যাভিকল, স্ক্যাপুলাসহ প্রায় সাত হাজার ৪১৬টি হাড় নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেলে কলেজে (চমেক) গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের প্রথম মানব হাড়ের পাঠাগার।
প্রায় এক হাজার বর্গফুট জায়গার ওপর কলেজের নতুন অ্যাকাডেমিক ভবনের দ্বিতীয় তলায় এই পাঠাগার গড়ে তোলা হয়েছে। পাঠাগারটির নামকরণ হয়েছে কলেজের এনাটমি বিভাগের সাবেক প্রধান প্রফেসর ডা. মনসুর খলিলের নামে।
ফিমার নামে হাড়টি মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন চমেকের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী বায়েজিদ হোসেন। পাশাপাশি এটি সম্পর্কে খাতায় লিখছিলেন তিনি।
‘আগে এক সেট হাড় কিনতে প্রায় ৪০ হাজার টাকা লাগতো। অনেকের পক্ষে এতো টাকা দিয়ে এক সেট হাড় কেনা সম্ভব হতো না। তাই অনেকে ভোগান্তিতে পড়তেন। এই পাঠাগার ভোগান্তি কমিয়েছে।’ বললেন বায়েজিদ।
প্রথম বর্ষের সাদিয়া সুলতানা ক্ল্যাভিকলের মুভমেন্ট বুঝার চেষ্টা করছিলেন। তিনি বলেন, ‘এখানে সহপাঠীরাসহ বসে পড়ার সুবিধা আছে। এটি একটি আলাদা সুবিধা। অনেক সময় ক্লাসে না বুঝলে নিজেদের মধ্যে এখানে আলোচনা করে পড়তে পারি। রুমের মধ্যে হয়তো সেই সুযোগ হতো না।’
পাঠাগারে রয়েছে ১২টি টেবিল। সেখানে একসঙ্গে ৪৮ জন শিক্ষার্থী বসতে পারবেন। পড়া শেষে হাড়গুলো রাখার জন্য রয়েছে দুটো আলমারি। এছাড়া দেয়ালজুড়ে থাকা স্টিল আর কাঠের ফ্রেমেও আছে কিছু হাড়।
পাঁচ বছরের এমবিবিএস কোর্সের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের এনাটমি পড়তে হয়। এজন্য দরকার হয় মানব হাড়। তবে এক সেট মানব হাড়ের দাম ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা হওয়ায় অনেকের পক্ষে কেনা সম্ভব হয় না। এ পাঠাগারটি এখন তাদের সহায় হয়েছে।
চমেক ছাত্রসংসদ ও ছাত্রলীগের উদ্যোগে এই পাঠাগারটি তৈরি হয়েছে। পাঠাগার তৈরিকে তারা শিক্ষকসহ বিভিন্নজনের কাছ থেকে অনুদান নিয়েছেন। সংগঠন দুইটি এই পাঠাগারটি রক্ষণাবেক্ষণ করছে।
চমেক ছাত্রলীগের সভাপতি হাবিবুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এখানে ৩৬ সেট মানব হাড় রয়েছে। পর্যায়ক্রমে ৫০ সেট করা হবে।
‘এনাটমি কোর্সে দরকার হয় মানব হাড়। একসময় ১৫ হাজার টাকায় একসেট মানব হাড় পাওয়া যেতো। কিন্তু একটি সিন্ডিকেট সেটির দাম ৪০ হাজার পর্যন্ত নিয়ে গেছে। সরকারি মেডিকেলে পড়াশোনা করেন বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত্ব পরিবারের সন্তান। এজন্য অনেকের পক্ষে এতটাকা দিয়ে হাড়ের সেট কেনা সম্ভব হয় না। মূলত তাদের কথা চিন্তা করে আমরা এই উদ্যোগটা নিয়েছি।’
কলেজের এনাটমি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. আশরাফুজ্জামান বলেন, অনেক গরীব শিক্ষার্থী এই পাঠাগারের মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছেন।
‘আমরা মাত্র এক হাজার টাকা দিয়ে একসেট মানবহাড় কিনেছি। কিন্তু এটি এখন গড়ে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। তাই সবার পক্ষে কেনা সম্ভব হয় না। পাঠাগারটি তাদের জন্য ভরসা।’
চমেক অধ্যক্ষ ডা. শামীম হাসান বলেন, এনাটমিতে প্রত্যেকটা হাড় সম্পর্কে আলাদাভাবে ধারণা দেয়া হয়। এর মাধ্যমে চিকিৎসা পদ্ধতি জানা যায়।
‘পাঠাগার করার আইডিয়াটি দারুণ। এ ধরনের পাঠাগার বাংলাদেশে আর নেই। তাছাড়া এটি শিক্ষার্থীদের জন্য অনেক উপকারী।’
পাঠাগারটি উদ্বোধন করা হয়েছে ২০১৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। প্রাথমিকভাবে ১৩ সেট হাড় নিয়ে সেটি চালু হয়। এসব হাড় ব্যবহার করলে কোনো টাকা দিতে হয় না শিক্ষার্থীদের।