যেভাবে ভেসে বেড়ায় মাকড়সা
অক্টোবর ৩১, ১৮৩২। এইচএমএস বিগলসে প্রকৃতিবিদ হিসেবে সমুদ্রযাত্রা শুরু করা তরুণ জীববিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন জাহাজের ডেকে খেয়াল করেন উপকূল থেকে ৬০ মাইল দূরে এসেও জাহাজে ভীড় করছে হাজার হাজার মাকড়সা। অন্তত ১ মিলিমিটারের লাল রঙের অদ্ভূতদর্শন প্রাণিগুলোর অস্তিত্ব খেয়াল করেন তিনি জাহাজের প্রতিটি আনাচে কানাচে। জাহাজটি উপকূল থেকে দূরে থাকায়, মাকড়সা গুলোর আগমনের উপায় ছিল একটিই, আর্জেন্টিনার মূল ভূখন্ড থেকে ভেসে আসা। বিবর্তনবাদের ভিত রচনা হয়েছিল ডারউইনের এ যাত্রায়-ই, যাত্রার বর্ণনায় তিনি মাকড়সা সম্পর্কে লিখেছিলেন, 'সবগুলো রশিই পাতলা জালে জড়ানো ছিল'।
মাকড়সার কোনো পাখা নেই, কিন্তু তারপরও তারা বাতাসে উড়ে বেড়াতে পারে। কোনো উপায়ে একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় ওঠার পর তারা বাতাসে পেটের সম্মুখভাগ ভাসিয়ে স্পিনারেট গ্রন্থি থেকে সিল্ক বা রেশম ছুঁড়ে দেয়, এভাবেই মাকড়সা বাতাসে ভেসে বেড়ায়। এ পদ্ধতি 'বেলুনিং' নামেও পরিচিত। এ পদ্ধতিতে মাকড়সা আক্রমণকারী থেকে নিজেকে রক্ষা করে বা স্বজাতির প্রতিদ্বন্দ্বীর থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখে। খাদ্যের খোঁজে দূরবর্তী কোনো অঞ্চলেও যায় এ পদ্ধতিতেই। ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় আড়াই মাইল উপরে বাতাসে বা উপকূল থেকে ১০০০ মাইল দূরে সমুদ্রেও মাকড়সার অস্তিত্ব দেখা গেছে।
একারণে মনে হতেই পারে মাকড়সার বাতাসে সিল্ক ছুঁড়ে দেয়ার জন্যই বেলুনিং পদ্ধতি কাজ করে। তবে এ ধারণাও পুরোপুরি সত্য নয়। কারণ মাকড়সা শুধু বাতাসের সল্প গতি থাকলেই বেলুনিং পদ্ধতি ব্যবহার করে। মাকড়সা পেট থেকেও সিল্ক উৎপাদন করেনা, বাতাসের স্বল্প গতি সিল্কের তন্তুসহ মাকড়সাকে ভাসিয়ে নিতেও পারেনা। একারণেই ডারউইনও মাকড়সার ভেসে বেড়ানো দেখে অবাক হন। বিষয়টি ব্যখ্যাতীত-ই মনে হয় তার কাছে।
তবে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেয়েছেন ইউনিভার্সিটি অব ব্রিস্টলের এরিকা মরলি ও ড্যানিয়েল রবার্ট। মাকড়সা বাতাসের তড়িৎ ক্ষেত্র অনুভব করতে পারে এবং তা কাজে লাগিয়েই ভেসে বেড়ায় বলে জানিয়েছেন তারা।
প্রতিদিন বিশ্বজুড়ে অন্তত ৪০ হাজার বজ্রপাত হয়, ফলে আমাদের বায়ুমন্ডলকেই একটি বিশাল তড়িৎক্ষেত্র বলা যায়। বায়ুমন্ডলের উপরের অংশে থাকে ধনাত্মক আয়ন ও ভূপৃষ্ঠে থাকে ঋণাত্মক আয়ন। রৌদ্রজ্জ্বল বা মেঘমুক্ত দিনেও বাতাসের প্রতি মিটার উচ্চতায় বিদ্যুতের পরিমাণ অন্তত ১০০ ভোল্ট বৃদ্ধি পায়। কুয়াশাচ্ছন্ন বা ঝড়ো আবহাওয়ায় প্রতি মিটারে এ পরিমাণ হাজার হাজার ভোল্ট করেও বৃদ্ধি পেতে পারে।
পৃথিবীর এ তড়িৎক্ষেত্রের মধ্যেই মাকড়সার বেলুনিং পদ্ধতি কাজ করে। তাদের দেহ থেকে সিল্ক নির্গত হওয়ার পরই সাধারণত ঋণাত্মক আয়নের সাথে ক্রিয়া করে। ফলে মাকড়সার বসে থাকার জায়গায় সমপরিমাণ ঋণাত্মক আয়ন নির্গত হয় এবং এ বলই মাকড়সাকে বাতাসে ভেসে বেড়াতে সাহায্য করে। গাছের ডাল, পাতা, ঘাসের উপর বসে জায়গাভেদে মাকড়সা এই বল বৃদ্ধি করে তার গতি বৃদ্ধি করে। গাছপালার ঋণাত্মক আয়ন থাকলেও তা বাতাসে ধনাত্মক আয়নের সৃষ্টি করে। ফলে আশেপাশে তড়িৎক্ষেত্রের সৃষ্টি হয় যা মাকড়সার বেলুনিং পদ্ধতিতে সাহায্য করে।
তড়িৎশক্তির বিকর্ষণের মাধ্যমেই মাকড়সা ভেসে বেড়ায়, ১৮০০-র শতকের শুরুতেই এ ধারণা প্রস্তাবিত হয়েছিল। ২০১৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানী পিটার গোরহাম পুণরায় এ ধারণা সামনে নিয়ে আসেন। তিনি গাণিতিক উপায়ে দেখিয়েছিলেন ধারণাটি গাণিতিকভাবে সম্ভব। তারপরই মরলি এবং রবার্ট গবেষণাগারে আসল মাকড়সা ব্যবহার করেই পরীক্ষা চালান।
প্রথমেই তারা দেখান, মাকড়সা তড়িৎক্ষেত্র শনাক্ত করতে পারে। তারা মাকড়সাগুলোকে একটি প্লাস্টিকের বক্সের ভেতরে রাখেন যেখানে প্রাকৃতিক পরিবেশের মতো তড়িৎক্ষেত্র সৃষ্টি করা হয়। এর ফলে তারা মাকড়সার পায়ের চুলের মতো ট্রাইকোবথরিয়া তন্তুতে তড়িৎ সংবেদনশীলতার উপস্থিতি লক্ষ করেন। "বেলুন ঘষে তা চুলের পাশে ধরলে যেমন দৃশ্য দেখা যায় ব্যাপারটি অনেকটা সেরকম।" বলেন মরলি।
এরপরই মাকড়সাগুলো তাদের পায়ের ওপর ভর করে বাতাসে পেটের সম্মুখদিক উন্মুক্ত করে। মরলি জানান, শুধু বেলুনিং এর সময়েই এমনটা দেখা যায়। গবেষণাগারের বাক্সে বায়ুপ্রবাহ না থাকলেও অনেক মাকড়সা ভেসে বেড়াতে সক্ষম হয়। বাক্সের ভেতরের তড়িৎক্ষেত্রের সংযোগ বন্ধ করে দেয়ার পরই ভেসে বেড়াতে থাকা মাকড়সাগুলো নিচে পড়ে যায়।
চুলের মতো দেখতে যে অঙ্গের সাহায্যে মাকড়সা তড়িৎক্ষেত্র শনাক্ত করতে পারে, একই অঙ্গই বাতাসের গতি ও দিকনির্দেশনা বোঝার কাজেও সাহায্য করে। টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব বার্লিনের মুনসাং চো সম্প্রতি তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, মাকড়সা বাতাসে ভেসে বেড়ানোর আগে সামনের পা বাতাসে ভাসিয়ে বাতাসের গতি পরখ করে নেয়।
মরলি এবং রবার্টের গবেষণা থেকে পরিষ্কার যে, বাতাসের তড়িৎক্ষেত্রের বিকর্ষণ বলই মাকড়সার বাতাসে ভেসে বেড়ানোর ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখে। গোরহাম জানান, "একজন পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে এটি আমার কাছে পরিষ্কার ছিল যে তড়িৎক্ষেত্রই এক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখে। তবে এটি জীববিজ্ঞান গবেষণায় কিরূপ ফল দেখাবে তা আমি শুধু ধারণাই করতে পারতাম। মরলি ও রবার্টের গবেষণা এতোদূর এগিয়েছে যা আমি ধারণাই করতে পারিনি।"
"আমি মনে করি তাদের গবেষণা দেখে আমার মতোই ডারউইনও রোমাঞ্চিত হতেন।"
- সূত্র: দ্য আটলান্টিক